ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। দুনিয়ার অনেক শাসককে এ জন্য খেসারত দিতে হয়েছে। ক্ষমতায় থাকতে যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন তারাই পড়েছেন করুণ পরিণতিতে। হতে হয়েছে নাজেহাল ও ইতিহাসের নির্মম শিকার। খেসারত দিতে হয়েছে তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরকেও। এমনই একজন উগান্ডার স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও ফিল্ড মার্শাল ইদি আমিন
‘দ্য বুচার অব উগান্ডা’ নামে সমধিক পরিচিত ইদি আমিন দাদা আফ্রিকার ইতিহাসে অন্যতম বর্বর ও স্বৈরাচারী একনায়ক। ১৯৭০ এর দশকে উগান্ডায় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ করেন এবং আট বছরের শাসনামলে ১ লক্ষের অধিক মানুষকে হত্যা, গুম, নির্যাতন, নির্বাসন কিংবা ফাঁসি দেন এই উগান্ডান কসাই। তবে এই সংখ্যাটি অনেক হিসেবে ৫ লক্ষও ছাড়িয়েছে! এই স্বৈরাচারী শাসকের মৃত্যু হয়েছিল ২০০৩ সালের ১৬ই আগস্ট। চলুন দেখে আসি কীভাবে সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এক সাধারণ বালক হয়ে উঠলো ‘বর্বর’ খুনী।
জন্ম:
১৯২৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত নীল নদের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশের কোবোকো নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন ইদি আমিন। ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা লাভ করে উগান্ডা প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত হয় এই অঞ্চল। এই অঞ্চলে বসবাস করতো ‘কাকওয়া’ নামক ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছোট্ট একটি আদিবাসী গোষ্ঠী। আমিন তেমনই এক আদিবাসী পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন।
কেএআর:
শৈশবে বাবা হারানো আমিন বড় হয়েছিলেন তার মায়ের কাছে। দারিদ্র্যক্লিষ্ট আমিন প্রাথমিক শিক্ষা কতটুকু লাভ করেছিলেন, সে সম্বন্ধে বিতর্ক আছে। তবে বাল্যকালেই যে সংসারের অভাবমোচনের কাজে নেমে পড়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ১৯৪৬ সালে ২১ বছর বয়সী আমিন যোগ দেন কেএআর তথা কিংস আফ্রিকান রাইফেলস-এ। এই কেএআর হচ্ছে ব্রিটিশদের আফ্রিকান ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনী। আমিন এই সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন বার্মা, সোমালিয়া, উগান্ডা আর কেনিয়ায় কাজ করেছেন। স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সশরীরে অংশ নিয়েছেন কেনিয়ার ‘মাউ মাউ’ বিদ্রোহীদের উপর ব্রিটিশদের বর্বরতায়। মনের মধ্যে স্বৈরাচারের বীজ সম্ভবত তখনই রোপিত হয়েছিল তার।
বিশেষ দক্ষতা:
ইদি আমিন দাদা একজন দক্ষ বক্সার ছিলেন। বেশ কয়েকবার তিনি ‘উগান্ডা লাইট হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ’ জিতেছিলেন। তবে যে বিষয়ে তিনি অধিক দক্ষ ছিলেন, সেটি হচ্ছে বর্বরতা। কেএআরে কাজ করার সময় তিনি যতটা না একজন সৈনিক হিসেবে দক্ষতা ও সুনাম অর্জন করেন, তার চেয়ে বেশি কুখ্যাত হন একজন নিষ্ঠুর অফিসার হিসেবে। খুব দ্রুতই তিনি প্রমোশনের সিঁড়ি বেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হন এবং শেষ পর্যন্ত ‘ইফেন্ডি’ পদ লাভ করেন। ইফেন্ডি ছিল ব্রিটিশ আর্মিতে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদের জন্য সর্বোচ্চ পদ, লেফটেন্যান্টের সমতুল্য।
ওবোতের সাথে বন্ধুত্ব:
কেনিয়ার মাউ মাউ বিদ্রোহীদের দমনের সময় ইদি আমিনের বর্বর ভূমিকাই মূলত তার পদোন্নতি ত্বরান্বিত করেছিল। ১৯৫১ সালে যিনি হয়েছিলেন একজন সাধারণ সার্জেন্ট, সেই ইদি আমিন মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে ১৯৬১ সালে লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। তবে বহুরূপী ব্রিটিশরা উগান্ডার স্বাধীনতার পর আমিনের এই নিষ্ঠুরতাকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করলো! ১৯৬২ সালে উগান্ডা এবং কানাডার দুটি আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে গবাদি পশু নিয়ে বিবাদ ও দাঙ্গার সৃষ্টি হলে, ইদি আমিন সেখানে আক্ষরিক অর্থে নরবলি চালান। তার এই নিষ্ঠুর দমনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যা দিয়ে তৎকালীন উগান্ডার প্রধানমন্ত্রী অ্যাপোলো মিল্টন ওবোতের কাছে তার বিচারের দাবি জানায় তার একসময়কার সমর্থক ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তারা!
ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, একজন হন্তারক, যাকে কিনা ঘৃণা ভরে মানুষ ‘কসাই’ ডেকেছিল, সেই ইদি আমিনের এত দূর আসা আরো আগেই বন্ধ হতে পারতো। কিন্তু শীঘ্রই ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেতে যাওয়া উগান্ডার প্রধানমন্ত্রী ওবোতে হিতে বিপরীত হবার ভয়ে আমিনকে শাস্তি তো দিলেনই না, বরং তাকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করলেন! পরের বছর ১৯৬৩ সালে ইদি আমিন হয়ে গেলেন মেজর। এরপর ব্রিটেনের উইল্টশায়ারের কয়েকটি সেনা ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিয়ে আমিন কর্নেল পদে উন্নীত হলেন। সেই থেকে আমিন-ওবোতে বন্ধুত্ব শুরু হয়। এই বন্ধুত্বের ধারাবাহিকতায় ইদি আমিন ১৯৬৬ সালে ‘চিফ অব স্টাফ’ এবং পরের বছর মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।
ক্যু ডেটা:
অধিকাংশ সামরিক স্বৈরশাসকেরই ক্ষমতায় আরোহণ ঘটে ‘ক্যু ডেটা’ (ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ) বা মিলিটারি ক্যু (সামরিক অভ্যুত্থান) এর মাধ্যমে। ‘বুচার অব উগান্ডা’ খ্যাত ইদি আমিন দাদা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি ওবোতের সাথে বন্ধুত্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের সামরিক ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, তলে তলে তিনি ব্রিটিশ ও ইসরায়েলি গুপ্তচরদের সাথেও হাত মেলান। তবে বিশ্বস্ত বন্ধুর অবিশ্বস্ততার তথ্য চলে যায় ওবোতের কাছে। প্রথমে তিনি আমিনকে গৃহবন্দী করেন। কিন্তু ততদিনে আমিনের বেশ প্রভাব ও সেনাবাহিনীতে একটা সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। ফলে তাকে গৃহবন্দী রাখা সম্ভব হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে ওবোতে আমিনকে মুক্ত করে দেন এবং একটি অ-প্রসাশনিক পদে নিয়োগ করেন। তবে সর্বনাশ যা হবার তা ততদিনে হয়েই গেছে, আমিন কেবল সুযোগ খুঁজছিলেন। অবশেষে সেই সুযোগ এলো ১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি। ওবোতে তখন রাষ্ট্রীয় সফরে সিঙ্গাপুর ছিলেন। আমিন এই সুযোগে ক্যু করলেন এবং দেশের ক্ষমতা দখল করে নিলেন।
ক্ষমতা দখল করেই নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে তার দেওয়া প্রথম ভাষণের শুরুতে তার পরিচিতিমূলক প্রথম কয়েকটি লাইন শুনলে যে কেউ বিস্মিত হতে বাধ্য!
“His Excellency President for Life, Field Marshal Al Hadji Doctor Idi Amin, Lord of All the Beasts of the Earth and Fishes of the Sea, and Conqueror of the British Empire in Africa in General and Uganda in Particular!”
বাংলা অর্থ :”মহামান্য রাষ্ট্রপতি জীবন, ফিল্ড মার্শাল আল হাডজি ডাক্তার ইদি আমিন, সমুদ্রের সমস্ত প্রাণী এবং মাছের লর্ড এবং আফ্রিকায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিজয়ী এবং বিশেষত উগান্ডার!”
স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও ফিল্ড মার্শাল:
১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উগান্ডার ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইদি আমিন। কেনিয়ায় ব্রিটিশবিরোধী দমনে ভূমিকা রাখেন তিনি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশবাহিনীর সদস্য হিসেবে বার্মায় যুদ্ধও করেন। সেখানেও নিজের দক্ষতা ও সামরিক কৌশলের পরিচয় দেন তিনি। এসব কাজের পুরস্কার হিসেবে কিংস আফ্রিকান রাইফেলসের দুই পদস্থ কর্মকর্তা মিলটন ওবাটে এবং ইদি আমিনকে স্বাধীনতার প্রাক্কালে সার্জেন্ট মেজর থেকে ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ইদিকে ইংল্যান্ডে সামরিক প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। সেখান থেকে দেশে ফিরলে ১৯৬৪ সালে মেজর পদে উন্নীত হন। পরের বছর কর্নেল পদোন্নতি পান ইদি আমিন। উগান্ডা স্বাধীনতা লাভ করলে উগান্ডার রাজা অ্যাডওয়ার্ড মুনেভি মুতেসা (দ্বিতীয়) দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পান। ইদির বন্ধু মিলটন ওবাটে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। ইদি আমিনের ভাগ্যে জোটে সেনাবাহিনী প্রধানের পদ। দুই উচ্চাকাক্সক্ষী মিলটন ওবাটে ও ইদি আমিন ষড়যন্ত্র করে ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট মুতেসা দ্বিতীয়কে ক্ষমতাচ্যুত করেন। রাজপ্রাসাদে ইদি আমিনের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে রাজা তথা প্রেসিডেন্টকে দেশ থেকে বের করে দেন। মিলটন ওবাটে প্রেসিডেন্ট পদে বসেন ইদি আমিনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। তবে দুই ষড়যন্ত্রীর মধুচন্দ্রিমা বেশি দিন টেকেনি। ১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি ওবাটে যখন কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছিলেন, তখন অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইদি আমিন ক্ষমতায় আসেন। দুনিয়ার অন্যান্য সামরিক জান্তার মতো ইদি আমিন ক্ষমতায় এসে ঘোষণা করেন তিনি সৈনিক, রাজনীতিক নন; কিন্তু পরবর্তীতে এ কথাটি আর ধরে রাখতে পারেননি স্বঘোষিত এই প্রেসিডেন্ট ও ফিল্ড মার্শাল।
আমিনের দুঃশাসনের শুরু:
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রাথমিকভাবে ইদি আমিনকে উগান্ডার শাসনব্যবস্থায় স্বাগত জানিয়েছিল উগান্ডার জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ক্ষমতায় বসে প্রথমেই আমিন রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী ভেঙে দিলেন এবং নিজস্ব এক ‘কিলার’ বাহিনী গঠন করলেন। এরপর শুরু হলো ওবোতের সমর্থকদের উপর তার নির্মম অত্যাচার।আট বছরের শাসনামলে ১ লক্ষের অধিক মানুষকে হত্যা, গুম, নির্যাতন, নির্বাসন কিংবা ফাঁসি দেন এই উগান্ডান কসাই। তবে এই সংখ্যাটি অনেক হিসেবে ৫ লক্ষও ছাড়িয়েছে!
বর্ণবাদী দাঙ্গা:
ইদি আমিনের ক্ষমতা গ্রহণের পর ওবোতে তানজানিয়াতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে ১৯৭২ সালে তিনি নিজের সমর্থকদের নিয়ে একটি ক্যু করার চেষ্টা চালান। তার ক্যুয়ের সমর্থনে উগান্ডার সেনাবাহিনীর একটি অংশ ছাড়াও তানজানিয়ার আচোলি এবং ল্যাঙ্গো সম্প্রদায়ের সামরিক কর্মকতারাও যোগ দেন। কিন্তু ক্যু ব্যর্থ হয়। আমিন সেই সামরিক কর্মকতাদের ঘরবাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেন। পাশাপাশি উগান্ডার সেনাবাহিনী থেকে তিনি আচোলি এবং ল্যাঙ্গো সম্প্রদায়ের লোকজনকে ছাঁটাই করতে শুরু করেন। ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরু হয় বর্ণবাদী এক দাঙ্গা, যা ধীরে ধীরে উগান্ডার সাধারণ জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
এই বর্ণবাদী দাঙ্গার সময়ই ইদি আমিনের বীভৎস রূপ প্রকাশ পায়। তিনি নীল নদের তীরের ‘নাইল ম্যানসন’ এবং হোটেলগুলো সব দখল করে নিজের জিজ্ঞাসাবাদ ও টর্চার সেলে রূপান্তর করেন। দ্রুত সময়ে টর্চার সেলগুলো থেকে রক্তের স্রোত বয়ে যায় নীল নদে। কেবল দাঙ্গা চলাকালীন এই টর্চার সেলগুলোতে ইদি আমিনের অনুগত বাহিনী দশ হাজারের অধিক মানুষ হত্যা করে! এই বাহিনীর দুটি শাখা হচ্ছে ‘স্টেট রিসার্চ ব্যুরো’ এবং ‘পাবলিক সেফটি ইউনিট’। ইদি আমিনের সরাসরি নির্দেশে এ সময় হত্যা করা হয় ‘আর্চবিশপ অব উগান্ডা’ জানানি লুয়ামকে, উগান্ডার বিচারপতি, ম্যাকারেরে কলেজের উপাচার্য, উগান্ডার রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সহ ওবোতের অনেক সাবেক মন্ত্রীকে। এ সময় গুপ্তঘাতকের ভয়ে বারবার নিজের বাসস্থান পরিবর্তন করতে থাকেন ইদি আমিন।
বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ইদি আমিনের অর্থনৈতিক যুদ্ধ:
১৯৭২ সালে ইদি আমিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো তার ‘দ্য ইকোনমিক ওয়্যার’ ঘোষণা। তবে এই ঘোষণা ছিল কেবল এশিয়ানদের বিরুদ্ধে। কেননা তখনকার সময়ে উগান্ডার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সিভিল সার্ভিস উভয় ক্ষেত্রেই প্রধানত এশিয়ানদের দাপট ছিল। বহিরাগতদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ আবার ব্রিটিশও ছিল। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর অনেক উচ্চপদে ছিল অনেক ইসরায়েলি। আমিন সামরিক বাহিনী থেকে সকল ইসরায়েলি ছাঁটাই করে দিলেন। এশিয়ান ও ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের তিনি তিন মাসের সময় দিলেন উগান্ডা ছাড়ার জন্য। সিভিল সার্ভিস থেকেও ব্যাপক কাটছাঁট করলেন। আর তাদের ছেড়ে যাওয়া পদগুলো এবং ব্যবসা-বাণিজ্য তিনি নিজের সমর্থকদের মধ্যে বণ্টন করেন। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ আর ইসরায়েলিদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয় ইদি আমিনের। আর এবার তিনি বন্ধুত্ব করলেন রাশিয়া এবং লিবিয়ার সাথে।
পাচকের চোখে ইদি আমিন:
অঞ্চলভেদে পৃথিবীতে খাদ্যের বৈচিত্র্য রয়েছে, কিন্তু কম-বেশি সব অঞ্চলের মানুষই রসনাবিলাসী। তবে সবার সেই বিলাসের সুযোগ থাকে না। খাদ্য সংকট, দারিদ্র্য ইত্যাদি নানা কারণে পৃথিবীর অনেক মানুষ আজও খালি পেটে ঘুমাতে যায়। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এ সংকট অনেক কেটে গেছে কিন্তু গত শতাব্দীর শেষপাদেও খাদ্য সংকট ছিল তীব্র। কিন্তু অর্থের যেখানে অভাব নেই সেখানে খাদ্যেরও অভাব হয় না, বরং খাদ্য নিয়ে নানা গবেষণা হয় যে কীভাবে তা রসনাকে আরো তৃপ্ত করতে পারে। তাই সব সময়েই শাসক শ্রেণীর ছিল বিশেষায়িত পাকশালা এবং পাচক। রাজপরিবার থেকে শুরু করে এখনকার আধুনিক যুগে রাষ্ট্রপ্রধান ও ক্ষমতাধরদের দৈনন্দিন জীবনে তাদের পাকশালা ও পাচকের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এমনকি আজ অবধি অনেক পাচক তাদের মনিব সম্পর্কে বহু আগ্রহোদ্দীপক তথ্য দিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে উগান্ডার বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত শাসক ইদি আমিনের পাচকও ব্যতিক্রম নয়।
কেনিয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে মায়ের চতুর্দশ সন্তান হিসেবে জন্ম ওতোন্দে ওদেরার, জন্ম মুহূর্তে দৈববলে হায়নার থাবা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তখনো জানতেন না, একসময় আরো বড় কোনো বিপদেও পড়বেন। ওদেরার ভাগ্য ভালো ছিল বলে চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন এক শ্বেতাঙ্গ পরিবারে। রবার্টসন নামক এক ব্রিটিশ সিভিলিয়ানের মালী হিসেবে কাজ করতে করতে একসময় মিসেস রবার্টসন তাকে রান্নার কাজ শেখাতে শুরু করেন। খুব দ্রুত কাজ শিখেছিলেন ওদেরা। তার নিজের ভাষায়, ‘এক বছরের মাথায় মেমসাহেব আমাকে ইঙ্গিতে বোঝালেন যে এখন তার সাহায্য ছাড়াই আমি হেঁশেল সামলাতে পারব।’
ঔপনিবেশিক আফ্রিকায় ব্রিটিশ সিভিলিয়ানের অধীনে এ কাজ ওদেরার বাকি জীবনের পাথেয় হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের কাছে যখন তাদের উপনিবেশগুলো বোঝা হয়ে উঠল, তখন অন্যান্য অঞ্চলের মতো উগান্ডাও স্বাধীনতাপ্রত্যাশী হয়ে উঠলে ১৯৬২ সালে উগান্ডা স্বাধীন হয়ে যায়। রবার্টসন পরিবার উগান্ডা ত্যাগ করলে বেকার ওদেরা একদিন খবর পান যে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মিল্টন ওবোতের জন্য পাচক প্রয়োজন। সে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ওদেরা সহজেই পাস করলেন। কেননা ওদেরা ব্রিটিশদের খাবার রান্না করতে জানতেন। পরবর্তী সময়ে ওবোতের অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠা ওতোন্দে ওদেরা একসময় ইদি আমিনেরও প্রিয় পাচকে পরিণত হন।
ওবোতে প্রধানমন্ত্রিত্ব পাওয়ার আগে থেকেই ইদি আমিন উগান্ডার সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। উগান্ডার স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ কমান্ডিং অফিসারদের অধীনে ইদি আমিন একজন সৈন্য হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। প্রায় নিরক্ষর ইদি আমিন সম্পর্কে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, ‘ইদি কেবল নির্দেশ মানতে জানে।’ ওবোতেও সে রকমই মনে করতেন। প্রথম পর্যায়ে ইদি আমিনের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৬৯ সালে দুজনের সমঝোতায় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি কাবাকাকে সরিয়ে দিয়ে ওবোতে নিজেই রাষ্ট্রপতি হন।
প্রায় একইভাবে ওবোতেকেও ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন ইদি আমিন। ১৯৭১-এর জানুয়ারিতে ওবোতের সিঙ্গাপুর সফরের সময় ইদি আমিন উগান্ডার ক্ষমতা দখল করেন। ইদি আমিনের চাতুরী কিংবা পরিকল্পনার একটি সূক্ষ্ম পরিচয় এখান থেকে পাওয়া যায়। ওবোতে দেশ ছাড়ার পর পরই রেডিওতে তার সম্পর্কে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই কাম্পালার রাস্তায় মিলিটারি কনভয় নেমে যায়। এটেনবি থেকে কাম্পালার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে একসময় স্পষ্ট হয়ে যায় যে একটি অভ্যুত্থান হয়েছে। মানুষ অনেকদিন ধরেই ওবোতের শাসন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল এবং শেষ হতে না হতে তারা যেন খুশিই হলো।
অভ্যুত্থানের রাতে রাষ্ট্রপতি ভবন যখন সৈন্যদের দ্বারা ঘেরাও করা হয় তখন ভেতরের সবাই ভেবেছিল তাদের হত্যা করা হবে। সবাইকে সার বেঁধে বাইরে বের করে আনা হলে ঠিক তখনই ইদি আমিন একটি জিপে করে সেখানে আসেন এবং ভীতদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমরা যে যেখানে কাজ করতে, সেখানেই কাজ করবে। এখন রাতের খাবারের ব্যবস্থা করো।’
ওদেরা বলেন, ‘আমি শিখেছিলাম একজন পাচকের প্রধান দায়িত্ব, তার মনিবের পাকস্থলী পূর্ণ করার জন্য উপাদেয় খাদ্য তৈরি করা। আগের অভ্যুত্থান থেকে আরো শিখেছিলাম যে এ রকম অভ্যুত্থান উগান্ডায় আরো হবে। এবারের অভ্যুত্থানের খবর আমরা আন্দাজ করেছিলাম আর আমি জানতাম প্রাসাদ দখলের পর প্রথমেই প্রয়োজন হবে খাদ্যের। আমি সে ব্যবস্থা করেই রেখেছিলাম। কেননা ক্লান্ত হয়ে তিনি যখন আসবেন তখন ক্ষুধার কারণেই হয়তো কাউকে হত্যা করতে পারেন। আমি অনেক ঠেকে শিখেছি, ক্ষুধা মিটলে মানুষের মেজাজ অনেক ঠান্ডা থাকে।’
সে রাতে তেলাপিয়া মাছ, ছাগলের মাংস এবং পোলাউ পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে ওদেরা নিজের পাশাপাশি অনেকের জীবন নিশ্চিত করেছিলেন, কেননা সত্যিই ইদি আমিন উন্মত্ত হয়ে তালজ্ঞান হারায়, যা তিনি পরে জেনেছিলেন। পাশাপাশি ইদি আমিনের মনোযোগ আকর্ষণ করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। আমিনের ক্ষমতা দখলের কিছুদিন পর কিছু ব্রিটিশ অতিথি তার রান্না খেয়ে ইদি আমিনকে তার পাচক সম্পর্কে প্রশ্ন করেন যে সেই পাচক শ্বেতাঙ্গ কিনা। রসিকতা করে ইদি আমিনের উত্তর ছিল, ‘সে আমার মতোই শ্বেতাঙ্গ।’
পছন্দের মানুষদের প্রতি ইদি আমিন ছিলেন অত্যন্ত উদার। ব্রিটিশ অতিথিদের সামনে গর্বিত প্রেসিডেন্ট বুঝলেন এসব সম্ভব হয়েছিল ওদেরার জন্য। তিনি ওদেরাকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমার বেতন কত?’ ৩৯০ শিলিঙে কাজ করা ওদেরা, তার ভূতপূর্ব মনিব ওবোতেকে পছন্দ করলেও তার কৃপণতা নিয়ে কিছুটা হলেও অসন্তুষ্ট ছিলেন। ওবোতের মুখ থেকে যেমন প্রশংসা আসত না, তেমনি বেতনের বেলায়ও কৃপণতা করতেন। ওদেরার বেতনের পরিমাণ শুনে ইদি তত্ক্ষণাৎ তার প্রধান তত্ত্বাবধায়ককে বললেন, ‘লেক ভিক্টোরিয়া হোটেলে ফোন করে সেখানকার প্রধান বাবুর্চির বেতন জিজ্ঞেস করো।’ সে মুহূর্ত থেকেই পাঁচ তারকা হোটেলের প্রধান পাচকের মতো ওদেরার বেতন ১,০১৭ শিলিং নির্ধারণ করা হয় এবং ইদি আমিন ক্ষমতা নেয়ার শুরু থেকে সেই বেতন কার্যকর হওয়া হিসেবে তিন মাসের অতিরিক্ত বেতনও দেয়া হয়। এখানেই শেষ হয়নি। কিছুদিনের মধ্যে ইদি আমিন তাকে একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ উপহার দেন।
ইদি আমিনের খামখেয়াল নিয়ে একটা গল্প শোনান তার ভূতপূর্ব মেজর গ্রাহাম। হিথরো বিমানবন্দরে একটি বিমান হঠাৎ করেই অবতরণের অনুমতি চাইতে থাকে এবং বলে এই বিমানে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। সে মুহূর্তে ‘প্রেসিডেন্ট’-কে অভ্যর্থনা করার মতো তেমন কেউ ছিল না। কেউ জানতও না তিনি কেন এসেছেন। সৌভাগ্যক্রমে রানী তার বাসভবনেই ছিলেন এবং মধ্যাহ্নভোজের পর তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আমি কি জানতে পারি আপনার এ অপ্রত্যাশিত ভ্রমণের মাধ্যমে আমাদের সম্মানিত করার উদ্দেশ্য কী?’ ইদি আমিন তার চায়ের কাপ নিয়ে উচ্চস্বরে হেসে বললেন, ‘মাননীয়া, উগান্ডায় ১৪ মাপের জুতো পাওয়া যায় না।’
ইদি আমিন লন্ডন গিয়েছিলেন অস্ত্র কেনার উদ্দেশ্যে। পাশাপাশি তানজানিয়ায় অবস্থানরত ওবোতের বিরুদ্ধে ইউরোপ থেকে সমর্থন লাভ করার চেষ্টাও ছিল। সে উদ্দেশ্য বিফল হওয়ার পর থেকেই ব্রিটেনকে তিনি প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেন। তার আগ পর্যন্ত ব্রিটেনের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল তীব্র। ইদি আমিনের নানা উপাধি ছিল। নিজেই নিজেকে ফিল্ড মার্শাল ঘোষণা করেছিলেন। পাশাপাশি প্রাচীন আমলের মতো লম্বা খেতাবও ধারণ করতেন। সেগুলো বেশ অদ্ভুত। রেডিওতে তার নামের সঙ্গে ‘বিশ্বের সব পশুর রাজা এবং সমুদ্রের মাছেদের অধীশ্বর’ বলা হতো এবং একপর্যায়ে নিজেকে ‘কিং অব স্কটল্যান্ড’ এবং ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংসকারী’ ঘোষণা করেন।
মেজর গ্রাহাম বলেন, ‘স্কটল্যান্ডের প্রতি তার ভালো লাগা তৈরি হওয়ার জন্য আমি দায়ী। আমি একজন স্কট। একসময় আমরা তাঁবুতে বসে গল্প করতাম। আমিই তাকে স্কটল্যান্ডের গল্প শুনিয়েছি।’ ইদি আমিন তার বাহিনীতে ব্যান্ড দল তৈরি করিয়েছিলেন, যারা নানা অনুষ্ঠানে ‘ব্যাগপাইপ’ বাজাত।
ইদির খামখেয়ালিপনার দৃষ্টান্ত হিসেবে ওদেরা আরেকটি গল্প শোনান। ইদি আমিন একসময় ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি ভবনে কাজ করতে হলে সব পুরুষকে খত্না করতে হবে। ইদি এবং তার পরিবার যে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেন সেই হাসপাতালেই এ ব্যবস্থা করা হবে। অগত্যা সবাই আদেশ মেনে নিজেদের খত্না করিয়ে নেয়। এদের মধ্যে প্রধান খানসামা ওদেরো ওশোরে এক ধাপ এগিয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে চাইলে ইদি আমিন আপত্তি করেন। যদিও ওশোরে মুসলিম হয়েছিল কিন্তু ইদি তাকে কোনো আলাদা খাতির করেননি। কিন্তু ধর্ম পরিবর্তন না করে কেবল খত্নার প্রতি এ আদেশের কোনো উপযোগিতা খুঁজে পাওয়া যায় না।
ততদিনে বেশ অর্থ কামিয়ে ফেলেছেন ওতোন্দে ওদেরা। ইদি আমিন তাকে প্রায় সময়েই বলতেন একজন স্ত্রী তার জন্য যথেষ্ট নয়। ওদেরাকে আরো একটি বিয়ে করার জন্য তিনি প্রলুব্ধ করতে থাকেন। একদিন একটি অনুষ্ঠানে ওদেরা যখন একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলছিলেন, প্রেসিডেন্ট সেখানে এসে দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে মেয়েটিকে প্রশ্ন করেন, ‘আমাদের পাচক ওদেরাকে আপনার কেমন লাগে?’ এবং এরপর ওদেরার প্রশংসা চলতে থাকে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট যেখানে ‘ঘটক’, ওদেরা দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে বাধ্য হন। এ বিয়ে উপলক্ষে ইদি আমিন বর, কনে উভয়কে খামে করে মোটা অংকের অর্থ ‘উপহার’ দেন। ওতোন্দে ওদেরা বলেন, ইদি আমিন এই কাজটি মাঝে মাঝেই করতেন। কারো কোনো কাজ পছন্দ হলেই একটি ‘খাম’ তাদের দিতেন উপহার হিসেবে।
নারীদের নিয়ে ইদি আমিন বেশ আগ্রহী ছিলেন। ওদেরার ভাষ্য অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের পাঁচজন স্ত্রী ছিলেন। এর বাইরেও ইদি আমিনের আসক্তি ছিল। প্রথম জীবনে একবার এক নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রকাশিত হলে ইদি আমিন তাকে নিজের বোন বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আর এমন কিছুর পরোয়া করেননি। পাশাপাশি তিনি তার কাছের মানুষদেরও নানাভাবে প্রলুব্ধ করতেন। ইদি আমিনের একজন খাস লোক একটি ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে বসে থাকত। কোনো অনুষ্ঠানে একজন নারী একজন পুরুষের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছে দেখলেই সে ব্রিফকেস নিয়ে এগিয়ে যেতেন। ওদেরাকে এভাবে টাকা দিতে চেয়েছেন তিনি। ওদেরার মতে, ‘তিনি এসব পছন্দ করতেন। উপভোগ করতেন বলা যায়।’
পাশাপাশি এক অদ্ভুত চাতুর্য ছিল ইদি আমিনের এ কাজে, যা ওদেরা পরে বুঝতে পেরেছিলেন। ইদি আমিন আসলে এভাবে তার আশপাশের প্রতিটা মানুষকে নিজের ওপর নির্ভরশীল করে তোলেন। কেননা, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ বাদেও ওদেরা একটি ভক্সওয়াগন কিনেছিলেন। অর্থাৎ, তার খরচের বহর বেড়ে গিয়েছিল। যেখানে ৩৯০ শিলিং নিয়ে তিনি জীবনযাপন করতেন, সেখানে এর তিন গুণ অফিশিয়াল বেতনেও তার পোষাচ্ছিল না, কেননা ওদেরা ততদিনে ইদি আমিনের দেয়া ‘খামগুলো’ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
উগান্ডার এ কুখ্যাত খামখেয়ালি প্রেসিডেন্ট রগচটা ছিলেন এবং তার প্রমাণ ওদেরা দেখেছিলেন নিজের চোখে। প্রেসিডেন্ট একা গাড়ি চালিয়ে শহরের বাইরে যেতেন না বললেই চলে। কিন্তু একবার এভাবে গেলেন এবং সড়ক দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়। তখন তার একজন স্ত্রী সাদামাটা পোশাক পরে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্যোগ করলে প্রায় তখনই ইদি উপস্থিত হন। প্রেসিডেন্টের কেবল একটি হাত হালকা জখম হয়েছিল। ওই অবস্থায় ফিরে স্ত্রীকে দেখে ক্ষিপ্ত প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘কী ভেবেছিলে? আমি মরে গেছি?’
ওই অবস্থাতেই ইদি আমিন তাকে মারতে শুরু করেন। রাষ্ট্রপতি ভবনের সব কর্মচারী অসহায়ের মতো এ ঘটনা দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না। সেই স্ত্রীকে উন্মত্তের মতো মারতে থাকলে এক পর্যায়ে ইদি আমিনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক কিজিতো কেবল একবার চিত্কার করে বললেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, এবার বন্ধ করুন।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কিজিতোকে লক্ষ্য করে ইদি আমিন পরপর তিনটি গুলি করেন। যদিও একটা গুলিও কিজিতোর গায়ে লাগেনি।
ইদি আমিন নিজেকে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়েছিলেন এবং চাইতেন মানুষ তাকে ভয় করুক। প্রাসাদে এমন একটা দৃষ্টান্ত তিনি রাখলেন যে তিনি যে কাউকে যা কিছু করার ক্ষমতা রাখেন। এমনকি পরবর্তী সময়ে তার দুই স্ত্রীকেও সম্ভবত তিনিই হত্যা করিয়েছিলেন। এমনকি ওশোরের অভিযোগে পাচক ওদেরাকেও গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগ ছিল ওদেরা নাকি প্রেসিডেন্টকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। ওদেরা ভেবেই নিয়েছিলেন পরিবারসহ তাকে হত্যা করা হবে কিন্তু কোনো দৈববলে যেন বেঁচে গিয়েছিলেন আবার। তাকে হত্যা না করে কেনিয়ায় তার গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
ইদি আমিনের কতটা কাছে ছিলেন ওদেরা, তা বোঝা যায় ওদেরার নিজের কথা থেকেই, যখন তিনি বলেন যে কীভাবে অনুষ্ঠানে ইদি আমিন তার কাঁধে হাত রেখে গল্প করেছিলেন। ফলে ইদি আমিনের অনেক কথাই তার জানার কথা এবং বিষয়টি যখন খাওয়া-দাওয়া প্রসঙ্গে, তখন ওদেরার চেয়ে ভালো কে জানবে! ভণিতা না করে স্পষ্ট করেই বলা যাক। ইদি আমিন সম্পর্কে একটি প্রচলিত কথা রয়েছে, তিনি মানুষের মাংস খেতেন। তিনি যাদের হত্যা করতেন তাদের রক্ত পান করতেন।
ওতোন্দে ওদেরাকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলেন, ‘তার এবং ভবনের সব মাংস, আনাজ আমার হাত হয়েই যেত। আমি কখনো অপরিচিত ধরনের কোনো মাংস খুঁজে পাইনি। আমিও শুনেছি লোকে এসব কথা বলে। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেসও করেছে আমি কখনো প্রেসিডেন্টের জন্য মানুষের মাংস রান্না করেছি কিনা। রান্নার জন্য কখনো আমি বাজার করতাম, কখনো সৈন্যরা পৌঁছে দিত। না আমি কোনোদিন এমন কোনো মাংস কিনেছি, না তারা সরবরাহ করেছে। তিনি এমন কিছু ভক্ষণ করতেন না।’
ইদি আমিন সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে কদর্য অভিযোগটি নরখাদক হওয়ার। এ সম্পর্কে তার ভূতপূর্ব মন্ত্রী হেনরি কায়েম্বা বলেছিলেন, ‘যেকোনো হত্যার পরই ইদি আমিন লাশের পাশে একা থাকতে চাইতেন। তিনি একাকী সেখানে কী করতেন তা অজানা।’ এখান থেকে অনেকের সন্দেহ পোক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় কিন্তু অন্যত্র কায়েম্বা নিজেই বলেছেন, ইদি আমিন তার প্রতি মানুষের ভয় সৃষ্টি করার জন্য অনেক কাজই করতেন। মানুষের মাংস খাওয়া প্রসঙ্গে মেজর গ্রাহাম বলেন, ‘নিঃসন্দেহে ইদি অনেক মানুষকে হত্যা করেছে এবং আমি এজন্য ক্রুদ্ধ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে সে নরখাদক।’ মূলত ইদি আমিন সম্পর্কে নানা গুজব তো ছিলই পাশাপাশি এ নরখাদক তত্ত্ব প্রমাণ করা গেলে উগান্ডার ওপর ইউরোপীয় আধিপত্য বাড়ানো যাবে বলে এসব গল্পে ইন্ধন দেয়া হতো বলেও অনেকে মনে করেন।
প্রশ্ন হলো ইদি আমিনের নিয়মিত খাবার তাহলে কী ছিল? ওদেরার কথা থেকে বোঝা যায় ইদি আমিনের পছন্দের খাদ্য উগান্ডার অন্যান্য শাসকদের মতোই স্বাভাবিক ছিল। তিনি পোলাওয়ের সঙ্গে মুরগির তরকারি, ছাগলের মাংস যার মধ্যে ওদেরার বিশেষভাবে তৈরি আস্ত ছাগলের রোস্ট পছন্দ করতেন। এর বাইরে ইউরোপীয় খাবারও পছন্দ করতেন। ইদি আমিনের স্ত্রীরা যদিও অন্য ভবনে বাস করতেন, খাবার সময় হলে তারাও ওদেরার হেঁশেল থেকেই খাবার খেতে পছন্দ করতেন। কেননা ওতোন্দে ওদেরা জানতেন কেমন করে পাকস্থলীকে আনন্দ দেয়া যায় আর ‘পেট ঠান্ডা তো দুনিয়া ঠান্ডা’—হোক সে একনায়ক কি এক সাধারণ মানুষ।
জাতীয়তাবাদীদের উত্থান ও আমিনের পতন:
আমিনের শাসনামলে ঠিক কত লোক নিহত হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে কোনো সংখ্যা এক লক্ষের নিচে নামেনি। বিরোধী দলের সদস্য থেকে শুরু করে সমর্থক এবং ভিন্নমতের মানুষ, কেউই বাদ যায়নি আমিনের ক্রোধ থেকে; এমনকি যদি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা একজন স্বনামধন্য ডাক্তার হন, তারপরও। দেশের অর্থনীতি দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছিল, তথাপি আমিনের সেদিকে কোনো নজর ছিল না। তিনি দেশের যেকোনো খাতের চেয়ে সামরিক খাতে এবং নিজের সুরক্ষার জন্য বিশেষ বাহিনীর পেছনে বেশি অর্থ ঢালতে থাকেন। ১৯৭৫ সালে উগান্ডার মুদ্রাস্ফীতি দশ বছর আগের তুলনায় এক হাজার গুণে গিয়ে দাঁড়ায়! অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে মানুষের মনে; ধীরে ধীরে নয়, দ্রুত।
উগান্ডা-তানজানিয়ার সেই যুদ্ধ:
উগান্ডাকে বলা হয় পার্ল অব আফ্রিকা। দেশটির পূর্বে আছে কেনিয়া, উত্তর-দক্ষিণ সুদান, পশ্চিমে গণতান্ত্রিক কঙ্গো, দক্ষিণ-পূর্বে রুয়ান্ডা এবং দক্ষিণে তানজানিয়া। নীল নদের উৎসের দেশ হিসেবেও এর একটি পরিচয় আছে। তবে দেশটির পরিচিতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ইদি আমিন যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন। তার শাসনামলে প্রায় তিন লাখ লোক প্রাণ হারান। কারও কারও মতে এই সংখ্যা পাঁচ লাখের মতো। তার স্বৈরশাসনের ইতিহাস আজো এই অঞ্চলের মানুষের মনে দগদগে ক্ষত হয়ে আছে।
মূলত ইদি আমিনের শাসনামলের পতন ঘটে এক যুদ্ধের মাধ্যমে। সেই যুদ্ধটি হয় পার্শ্ববর্তী তানজানিয়ার সঙ্গে। সেই যুদ্ধে উগান্ডা পরাজিত হয় শোচনীয়ভাবে এবং ইদি আমিনের পতন ঘটে। এই যুদ্ধকে উগান্ডার স্বাধীনতা যুদ্ধও বলা হয়। ১৯৭৮-৭৯ সালের এই যুদ্ধে ইদি আমিনকে সহায়তা করেছিলেন লিবিয়ার একনায়ক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং পিএলও। এই যুদ্ধের বিস্তারিত জানার আগে জানতে হবে একটু পেছনের কথা। ১৯৭১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ইদি আমিন উগান্ডার ক্ষমতা দখল করেন। তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারে উগান্ডার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মিলটন ওবাটেকে আশ্রয় দেন ২০ হাজার উদ্বাস্তুসহ। এক বছর পর তারা উগান্ডাকে আক্রমণের ব্যর্থ চেষ্টাও করেন। ইদি আমিন নায়ারেকে দোষারোপ করেন তার শত্র“কে সমর্থনের জন্য। এরই সূত্র ধরে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। ১৯৭৮-এর অক্টোবরের শুরুর দিকে কাম্পালাতে বিদ্রোহীরা ইদির বাসভবন আক্রমণ করে। তিনি হেলিকপ্টারে করে সপরিবারে পালিয়ে রক্ষা পান।
এদিকে ইদি আমিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা আদ্রিসি সন্দেহজনক গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হন। আদ্রিসির অনুগত সৈন্যরা বিদ্রোহ করলে বিদ্রোহ দমন করা হয়। মুস্তাফা আদ্রিসির কিছু সৈন্য তানজানিয়ায় পালিয়ে যায়। বিদ্রোহ তানজানিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। আদ্রিসির সৈন্যরা মিলটন ওবাটের সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এদিকে ইদি আমিন তানজানিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। উগান্ডার সরকারি বাহিনী তানজানিয়ার কাগারা অঞ্চলের বিরোধপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয়। নায়ারে তানজানিয়া পিপলস ডিফেন্স ফোর্সকে উগান্ডার আর্মির বিরুদ্ধে মোতায়েন করেন। কয়েক সপ্তাহের ভেতর ৪০ হাজার নিয়মিত সৈনিকের সঙ্গে ৬০ হাজার পুলিশ, মিলিশিয়া, কারারক্ষী যোগ দেন। উগান্ডার ইদি আমিন-বিরোধীরা উগান্ডান ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি গঠন করে নায়ারের সঙ্গে যোগ দেন। রাশিয়ান বিএম কাতুস্কা দিয়ে তানজানিয়ানরা উগান্ডার সেনাদের ওপর গোলাবর্ষণ করে। এতে উগান্ডা সেনাবাহিনী পিছিয়ে যায়। লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি ২৫০০ সৈন্য, টি-৫৪, টি-৫৫ ট্যাংক, মিগ-২১, টু-২২ বিমান ও গোলা-বারুদ দিয়ে সাহায্য করেন। কিন্তু লিবিয়ানরা খুব দ্রুত টের পায় তারাই সম্মুখ যুদ্ধ করছে এবং উগান্ডান সেনারা পরিবহন ট্রাক দিয়ে তানজানিয়া থেকে লুটের মাল উগান্ডাতে নিয়ে যাচ্ছে। তানজানিয়া ও উগান্ডার বিদ্রোহীরা কাম্পালা অভিমুখে যাত্রা করে কিন্তু লুকাইয়া অঞ্চলে জলাভূমির কারণে থেমে যায়। তানজানিয়ার ২০১তম ব্রিগেড জলাভূমি পাড়ির সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে ২০৮তম জলাভূমির পশ্চিম দিক দিয়ে বিকল্প পথে অগ্রসর হয়। ১৯৭৯ এর ১০ মার্চ লিবিয়ানদের একটি ব্রিগেডের সঙ্গে সংঘর্ষে ২০১তম ব্রিগেড পিছু হঠে। কিন্তু ২০১ ব্রিগেড সুসংঘটিত হয়। তারা দক্ষিণ ও ২০৮ ব্রিগেড উত্তর দিক দিয়ে ১১-১২ তারিখের রাতে লিবিয়ানদের ওপর হামলা করে। লিবিয়ানদের প্রতিরোধ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। ওই দিন ২০০ লিবিয়ান ও ২০০ উগান্ডার সরকারি সৈন্য নিহত হয়। এর পরপরই শুরু হয় ইদি আমিন সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা।
বিদ্রোহীরা ১৯৭৮ সালের অক্টোবরের মধ্যে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা দখল করে নেয়। আর স্বৈরাচারী, প্রতাপশালী ইদি আমিন লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন।
ইদি আমিনের উপাধি:
ইদি আমিন। তুঘলকি রাজত্ব কায়েমের উদ্দেশ্যেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন এই জেনারেল। ইদি আমিন অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসার পর যে উপাধি গ্রহণ করেন তাতে তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। উপাধিটি হলো ‘হিজ এক্সলেন্সি প্রেসিডেন্ট অব লাইফ, ফিল্ড মার্শাল আলহাজ ডক্টর ইদি আমিন বিসি, ডিএসও, এমসি, লর্ড অব অল দ্য বিস্টস অব দ্য আর্থ অ্যান্ড ফিসেস অব দ্য সি অ্যান্ড কনকুয়েরর অব দ্য ব্রিটিশ ইম্পিয়ার ইন আফ্রিকান জেনারেল অ্যান্ড উগান্ডা ইন পার্টিকুলার।’ যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘উগান্ডা তথা আফ্রিকায় ব্রিটিশ আধিপত্য ক্ষুণ্নকারী, দুনিয়ার সব পশু এবং সাগরের মৎস্যকুলের অধীশ্বর মহামান্য আজীবন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আলহাজ ডক্টর ইদি আমিন ভিসি, ডিএসও এমসি। উপাধিই বটে!
মৃত্যু:
লিবিয়ায় দশ বছর কাটানোর পর ১৯৮৯ সালে সৌদি আরবে চলে যান ইদি আমিন।২০০৩ সালের ২০শে জুলাই ইদি আমিনের স্ত্রীদের একজন, মদিনা, জানান যে, আমিন সৌদি আরবের জেদ্দার কিং ফাহাদ হাসপাতালে কোমায় সংজ্ঞাহীন ও মরণাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। তিনি উগান্ডার রাষ্ট্রপতি ইয়োয়েরি মুসাভেনির কাছে আবেদন জানান, যাতে আমিন দেশের মাটিতে মরতে পারেন। মুসাভেনি জবাব দেন, আমিন দেশে ফেরা মাত্র তার অপরাধের বিচার করা হবে।
এর এক মাস পরে ২০০৩ সালের ১৬ই আগস্ট আমিনের মৃত্যু হয়, এবং তাকে জেদ্দার রুয়াইস কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এতে আরো একবার প্রমাণ হয়ে যায় যে, স্বৈরাচারী শাসক যত শক্তিশালীই হোক, তার পতন অনিবার্য, তার শেষটা হয় করুণভাবে। বরং নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য তারা চিরকাল মানুষের ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকেন।
ইদি আমিনকে সৌদি আরবের জিদাহের রুওয়াইস কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, রোয়ার বাংলা, বিশ্বকোষ