Image default
জীবনী

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জীবনী

এমন একদিন ছিল যেদিন বাংলার মুসলিম নারীদের ঘরের চতুষ্কোণের মধ্যেই আটক থাকতে হত। বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা-দীক্ষা ছিল নারীদের জন্যে পাপের কাজ। এদেশের নারীদের প্রথম শিক্ষার আলো দেখিয়েছিলেন যিনি, বাঙালি মুসলিম নারীদের শিক্ষার অধিকারের জন্য লড়েছিলেন যিনি, সেই মহীয়সী নারী হলেন বেগম রোকেয়া। তিনিই প্রথম নারীদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার কথা ভেবেছিলেন। বঙ্গীয় নারীদের মধ্যে তিনিই কলম ধরেন। কলম ধরেন নারীকে পণ্যকরণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাতে। যার লেখনীতে ঘোষিত হয়েছিল মানুষ হিসেবে ভগিনীদের আত্মসম্মান ও নিজস্ব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার কথা। ঠিক সেই সময় বাংলাদেশে যে সমস্ত নারী নিজ কর্মদক্ষতার গুণে বাংলার ইতিহাসে অক্ষয়, সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেছেন, বেগম রোকেয়া তাদের অন্যতম।

আজকে আমরা সেই মহিয়সী নারীর জীবনী সম্পর্কে জানবো –

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া

জন্ম পরিচয়:

রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে ‘সাবির বংশে’ ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জহির উদ্দীন মোহাম্মাদ আবু আলী সাবির আরবি ও ফারসিতে সুপণ্ডিত ছিলেন। বেগম রোকেয়াকে পাঁচ বছর বয়স থেকেই পর্দা রক্ষা করে চলতে হত। নিজেদের একান্ত আপনজন বা চাকরানি ছাড়া অন্য কোনো লোকের সামনে যাওয়া ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ। তখন মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা কেবলমাত্র তাদের শিক্ষণীয় বিষয় ছিল। অনেকেই আমপারা পান্দেনামা’র অধিক শিক্ষালাভ করতে পারতোনা ।

বাল্যকাল ও শিক্ষা জীবন:

বেগম রোকেয়াকে তার বাবা কেবলমাত্র কোরআন শরীফের আয়াতগুলো মুখস্থ করাতেন। তার ভায়েরা মুন্সি সাহেবের কাছে বাংলা ও ইংরেজি পড়তেন। তাদের পড়া শুনে রোকেয়ারও পড়ার তৃষ্ণা জেগে উঠল। তারপর তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইব্রাহীমের কাছে বাংলা ও ফারসি বয়াত মুখস্থ করতে লাগলেন এবং ঘরের মেঝেতে দাগ কেটে কেটে লেখার চেষ্টা করেন। বড় ভাই আবুল আসাদ ইব্রাহীম রোকেয়াকে ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষা দিতে লাগলেন। বড় ভাইয়ের মুখে রোকেয়া নানা দেশের গল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শুনে জ্ঞান আহরণের জন্যে প্রলুব্ধ হয়ে ওঠেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বড় ভাইয়ের যত্নে, নিজের একান্ত চেষ্টায় ও কঠোর অধ্যবসায়ের ফলে বাংলা ও ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

বিবাহ ও কর্মজীবন :

বেগম রোকেয়া ও তার স্বামী

বিহারের অধিবাসী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে রোকেয়া পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। সাখাওয়াৎ ছিলেন অতিশয় উদার হৃদয় যুবক। তাই তিনি রোকেয়াকে বিদ্যাচর্চায় কোনো বাধা তো দেনই নি, পরন্ত তাকে বিদ্যার্জনে ও বিদ্যাচর্চায় সহানুভূতি দান করেছেন। সাখাওয়াৎ হোসেন ১৯১১ সালে পরলোক গমন করেন। বেগম রোকেয়া বিধবা হন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান অবিরা। অতঃপর তিনি স্ত্রী শিক্ষার জন্যে জনগণের মধ্যে উৎসাহ দিতে লাগলেন। মৃত্যুর পূর্বে বেগম রোকেয়ার স্বামী স্ত্রী শিক্ষার জন্যে দশ হাজার টাকা রেখে যান। রোকেয়া তাঁর স্বামীর নামানুসারে শ্বশুরালয় ভাগলপুরে ‘ভাগলপুর সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। অতঃপর তিনি মাত্র পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে শিক্ষা-দীক্ষার কাজ আরম্ভ করেন। কিন্তু সেখানে তার কাজ বেশি দিন চললো না। অবশেষে ১৯১৯ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার একটি ক্ষুদ্র গলিতে ভিণি ছোট একখানা ঘর সংগ্রহ করেন। সেখানে তিনি মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল স্থাপন করেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর গুনে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে লাগলো , ফুল ঘরেরও উন্নতি হতে লাগলো। এরূপে তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় সবদিক দিয়েই স্কুলের উন্নতি হতে লাগলো। তিনি ছিলেন ঐ কুলের পরিচালিকা ও শিক্ষয়িত্রী। তদুপরি মাত্র একজন সহকারী শিক্ষয়িত্রী নিয়ে স্কুল পরিচালনা করেন। বাংলার মুসলিম নারী জাগরণে বেগম রোকেয়াই অন্যতম। অতঃপর তিনি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতীন-ই-ইসলাম” নামে একটি মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন।

সাহিত্যচর্চার সূচনাঃ

বেগম রোকেয়া

সাহিত্যিক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯০২ সালে।কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘নভপ্রভা’ পত্রিকায় ছাপা হয়”পিপাসা”।বিভিন্ন সময়ে তার রচনা নানা পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে।১৯৫০ সালে প্রথম ইংরেজি রচনা “সুলতানাজ কড্রিম” মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপা হয়।সবাই তার রচনা পছন্দ করে।তিনি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

১৮৯৮ সালে রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াৎ হোসেন মারা যান। ইতোপূর্বে তাঁদের দুটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে অকালেই মারা যায়। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যজগতে তার অবদান রাখা শুরু হয়। এরপর একে একে লিখে ফেলেন মতিচূর-এর প্রবন্ধগুলো এবং সুলতানার স্বপ্ন-এর মতো নারীবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনী।

কীর্তি ও সাহিত্য সাধনাঃ

রোকেয়ার সমাজসেবা শুধু মেয়ে-কুল প্রতিষ্ঠা ও মহিলা সমিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি সমাজ সংস্কারক ও সুলেখিকা ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম নারী আন্দোলন বিপুল সাড়া জাগায়। সাহিত্যানুরাগ সমাজসেবাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন। তাঁর রচিত মতিচুর, পদ্মরাগ, সুলতানার স্বপ্ন, অবরোধবাসিনী, মুক্তি প্রভৃতি গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার আগে তার লেখাগুলো নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তার প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তার রচনা দিহয়ে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না –তা বলেছেন।

রোকেয়া অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক বিবেচনা করেছেন এবং নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থরাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন।

মৃত্যুঃ

১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন। তার কবর উত্তর কলকাতার সোদপুরে অবস্থিত যা পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অমলেন্দু দে আবিষ্কার করেন ।

বেগম রোকেয়ার সমাধি, সোদপুর, কলকাতা

স্বীকৃতিঃ

♦ বাংলাদেশের ৭ম বিভাগ হিসেবে রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ২০০৯ সালে ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে তার নামকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়টির বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করেন । উল্লেখ্য, নারীর নামে বাংলাদেশে প্রথম কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এটি।

♦ বেগম রোকেয়ার নামে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬০-এর দশকে ছাত্রীনিবাস ‘রোকেয়া হল’ খোলা হয় যার নাম আগে ছিলো ‘উইমেন্স হল’ তবে ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৮ সালে ‘চামেলি হাউজ’ নামে প্রথমে হলটি চালু হয়েছিলো।

♦ মহীয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য আবাসিক হল “রোকেয়া হল” নামকরণ করা হয়।

♦ প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর তার জন্মদিনে বেগম রোকেয়া দিবস পালন করা হয় এবং নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য বিশিষ্ট নারীদেরকে বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়।

♦ ১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

♦ তার ১৩৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগল তাদের হোমপেজে বেগম রোকেয়ার গুগল ডুডল প্রদর্শন করে তার জন্মদিন উদ্‌যাপন করে। গুগল ডুডলটিতে দেখা যায় সাদা পোশাকে চশমা পরা বেগম রোকেয়া বই হাতে হেঁটে যাচ্ছেন।

বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রঃ

বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্মরণে বাংলাদেশ সরকার একটি গণউন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে পৈতৃক ভিটায় ৩ দশমিক ১৫ একর ভূমির উপর নির্মিত হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। এতে অফিস ভবন, সর্বাধুনিক গেস্ট হাউজ, ৪ তলা ডরমেটরি ভবন, গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরি ইত্যাদি রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে স্মৃতিকেন্দ্রটি পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বাংলা একাডেমি।

Related posts

সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী

News Desk

বাংলাদেশী মারকুটে ব্যাটসম্যান আফতাব আহমেদ চৌধুরীর জীবনী

News Desk

চিত্তরঞ্জন দাশ:উদার জাতীয়তাবাদের দিশারি

News Desk

Leave a Comment