নীলিমা ইব্রাহিম নারী আত্মোন্নয়নের মধ্যে অন্যতম নক্ষত্র একজন। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর অনমনীয় দৃঢ়তা সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক এবং সমাজকর্মী। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি- সবকিছুতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন মহীয়সী এই নারী। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনে তাঁর অবদান এবং ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইয়ের মাধ্যমে এ সকল নারীদের সংগ্রাম যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
১৯২১ সালের ১১ অক্টোবর বাগেরহাটের মূলঘর গ্রামের এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নীলিমা রায় চৌধুরী। বাবা ছিলেন প্রফুল্ল কুমার রায় চৌধুরী আর মাতা কুসুম কুমার দেবী। পিতা ছিলেন পেশায় একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। তিনি খুলনা নাট্য মন্দিরের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন লম্বা সময় ধরে। নীলিমার বাবা পেশায় একজন আইনজীবী হলেও থিয়েটারের প্রতি তার অগাধ আগ্রহ ভালোবাসা ছিল। এই ভালোবাসা তিনি নীলিমা ও তার বাকি সন্তানদের মনে সঞ্চারিত করেন।
নীলিমা ইব্রাহিম ছোটবেলা থেকেই শিক্ষাজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৩৫ সালে খুলনা করোনেশন গার্লস স্কুল থেকে চারটি বিষয়ে লেটার নম্বর নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে কলকাতার ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ অর্থনীতিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন। এরপর লরেটো হাউজ এবং ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৪৫ সালে নীলিমা ইব্রাহিম‘সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক’—উক্ত বিষয়ে ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম কোন বাঙালি নারী যিনি বাংলায় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
নীলিমা চৌধুরীর ১৯৪৫ সালে তৎকালীন ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিকেল কোরের ক্যাপ্টেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সাথে বিয়ে হয়। বিয়ের পরে নীলিমা রায় চৌধুরী থেকে নীলিমা ইব্রাহিম নামেই অধিক পরিচিত হয়ে ওঠেন। নীলিমা ইব্রাহিম যখন ডক্টরেট শেষ করেন তখন তিনি পাঁচ কন্যাসন্তানের জননী।
১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীলিমা ইব্রাহিমের বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। সেই থেকেই পাঠদানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে নানাবিধ শিক্ষা, সাহিত্যে, সমাজ সবায়, অর্থনীতি চিন্তায়, রাজনীতির বাস্তবতায় এবং নারীর সঠিক পরিচয় নির্ণয়ে তাঁর আছে নিরলস সাধনা। নীলিমা ইব্রাহিমের জীবনের যে দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়, সে দিকেই তিনি উজ্জ্বল তারার মতো দীপ্যমান। বাবার মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই নীলিমার থিয়েটার এবং সাহিত্যচর্চাই ভালোবাসা জন্মে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার সুযোগ হয় যখন, তখন গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক’ স্থির করেন। নীলিমা তাঁর গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে দুটি বইও লিখেছেন। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম বই ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা বাঙালি সমাজ ও বাংলা নাটক’ এবং ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তার দ্বিতীয় ‘উৎস ও ধারা’।
নীলিমা ইব্রাহিম শক্তিশালী লেখিকা হিসেবে নিজের আসনটি পোক্ত করেন ষাটের দশকে। তার প্রকাশিত বেশ কিছু উপন্যাস ‘বিশ শতকের মেয়ে’, ‘একপথ দুইবাঁক’, ‘কেয়াবন সঞ্চারিণী’তা ছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এ সময় সাহিত্যিক সমাজে তোলপাড় সৃষ্টি করে। ‘শরৎ প্রতিভা’, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’, ‘বাংলার কবি মধুসূদন’ এবং তাঁর গবেষণাধর্মী বই ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ ও বাংলা নাটক’ সুধীমহলে ব্যাপকভাবে প্রশংশিত হয়। নীলিমা ইব্রাহিম নারীদের মনের কথা,সমাজসচেতনতার চেষ্টা ও নারীর স্বাবলম্বী হওয়া দৃষ্টিভঙ্গীর কথাই যেন তার গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় ছিল। তিনি বাঙালি নারীদের দেখতে চেয়েছেন মেরুদণ্ড ও মাথা উঁচু করে চলবে। নারীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ এ কথাটি তিনি বিভিন্নভাবে প্রবন্ধ ও উপন্যাসে উপস্থাপন করে পাঠকের চিন্তাকে বিস্তৃত করার চেষ্টা করেন। তার এই চিন্তা স্বাধীন ধারার জন্য সমাজে নারীর যথাযোগ্য স্থান নির্ণয়ের প্রয়াস পেয়েছেন তিনি। তবে নীলিমা ইব্রাহিম নারীবাদী লেখিকা নন। তবে তিনি সমাজে নারী–পুরুষের সুস্থ, স্বাভাবিক ও আত্মসম্মানসম্পন্ন জীবন লাভই তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এ জন্য তাকে এক মানবতাবাদী লেখক বলা হয়। তিনি বিশ্বাস করেন, নারী–পুরুষের মিলিত প্রয়াসেই মানবমুক্তি সম্ভব।
১৯৫৬ সালে যখন তিনি প্রভাষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন, তখন বাংলাদেশে তথা পূর্ব বাংলায় সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে পাকিস্তানি বাহিনীর শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে। এ সময়ে তিনি পাঠদানের পাশাপাশি নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালনে পাকিস্তানি বাহিনী বাধা দিলে তিনি প্রত্যক্ষভাবে এর বিরোধিতা করেন। আর ১৯৬৪ সালে দাঙ্গা হলে সাধারণ জনগণের সহায়তায়ও এগিয়ে যান। স্বাধীনতা লাভের পূর্বে তিনি প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সেই সময়ের অনেক ছাত্রনেতাকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ দায়িত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নতুন গঠিত বাংলাদেশ সরকারের জন্য এটাও ছিল একটি জটিল সমস্যা। এই বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন কে এম সোবহান। নীলিমাও এই বোর্ডের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন। এই পুনর্বাসন বোর্ডে যুক্ত হওয়ার সুবাদে এবং ১৯৭২ সালে পাকিস্তানি বন্দীদের সাথে দেশত্যাগ করা ধর্ষণের শিকার কিছু নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাওয়ায় নীলিমা তাদের উপর চালানো মর্মান্তিক নির্যাতনের কথা জানতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সেই সময় বাংলা একাডেমিতে বিশৃঙ্খলার কমতি ছিল না। এর মধ্যে আবার মকবুল নামে এক ভণ্ড এসে একাডেমির চত্বর দখল করে বসে থাকে। এই মকবুলের সাথে ছিল একটি বিশাল ও সুসংগঠিত দল। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ১৪২টি চাঁদা আয়ের বাক্স বসানো হয় এই মকুবলের নির্দেশে যেখানে জমা হওয়া চাঁদা সকলে ভাগাভাগি করে নিত। বাক্সগুলো সর্বদা দলের সদস্যদের তত্ত্বাবধানেই থাকত। প্রশাসনের সহায়তায় নীলিমা এই পুরো দলকে নির্মূল করেন, আর সেই সাথে বাকি অনিয়ম ও অরাজকতাও।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি একাধারে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারপার্সন (১৯৭১-৭৫) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রভোস্ট (১৯৭১-৭৭)। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভাপতি হন ড. নীলিমা। তাঁর উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় মহিলা সমিতির মিলনায়তন এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়মিত নাটক উপস্থাপন করা শুরু হয় সেখানে যা আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক উন্নতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন এবং সমাজকল্যাণমূলক ও নারীর উন্নয়ন বিষয়ক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি।
সত্যকে প্রতিষ্ঠা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতে গিয়ে জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে নীলিমাকে কাঠগড়ায়ও দাঁড়াতে হয়। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সরকারবিরোধী ‘মাগো আমি কোয্যাবো’ শীর্ষক উপসম্পাদকীয় লেখার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়। হাইকোর্টে গিয়ে জামিনের আবেদন করলে তাঁকে পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। অবশেষে নিম্ন আদালত আইনজীবীদের তোপের মুখে পড়ে নীলিমাকে জামিন দিতে বাধ্য হয়।
সমাজসেবা এবং সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার কারণে বিভিন্ন সম্মাননাও পেয়েছেন নীলিমা। এর মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৭), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৯), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্মৃতি পদক (১৯৯০), অননয় সাহিত্য পদক (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৯৯৭), শেরে বাংলা পুরস্কার (১৯৯৭), থিয়েটার সম্মাননা পদক (১৯৯৮) এবং একুশে পদক (২০০০)।
ড. নীলিমা ইব্রাহিম ২০০২ সালের ১৮ জুন মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৮১ বছর।