ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেখান থেকে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। পরে ওই ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধন ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেই থেকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বেও সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিজ দেশেই গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ছিলেন কোণঠাসা। কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন নিজের প্রতিষ্ঠিত সেই গ্রামীণ ব্যাংকের।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বাংলাদেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও সমাজসেবী, দারিদ্র্য বিমোচনে অনন্য অবদান রেখে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। চলুন এই অনন্য ব্যক্তিত্বের জীবন ও কর্মের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিশদে জানি।
জন্ম ও শৈশব
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৮ জুন, চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বথুয়া গ্রামে। তার পিতা হাজী দুলা মিয়া সওদাগর পেশায় ছিলেন একজন জহুরি, আর তার মা সুফিয়া খাতুন ছিলেন এক গৃহিণী। দুই ভাই এবং নয় বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় সন্তান। তার পরিবার শুরু থেকেই শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী ছিল। ফলে ছোট থেকেই তিনি চট্টগ্রাম শহরে পড়াশোনার সুযোগ পান।
শিক্ষা জীবন: স্কুল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. ইউনূসের প্রাথমিক শিক্ষার শুরু হয় তার গ্রামের মহাজন ফকিরের স্কুল নামে এক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে পরিবারসহ চট্টগ্রাম শহরে চলে আসায় তিনি লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মাধ্যমিক শিক্ষায় তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন, যেখানে ৩৯ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনি ১৬তম স্থান অর্জন করেন। ছোট বয়সেই বয়েজ স্কাউটসের সদস্য হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুযোগ পান।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন এবং এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কলেজ জীবনে নাটকে অভিনয়ের জন্য পুরস্কার এবং আজাদী পত্রিকায় লেখালেখির অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পরে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
উচ্চশিক্ষা ও কর্মজীবনের সূচনা
১৯৬৫ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। তবে, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করে তিনি ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
মুহাম্মদ ইউনূস মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তিনি সেখানে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। তিনি ও তার সহযোগীরা মিলে বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র পরিচালনা করেন যা বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে তিনি বুঝতে পারেন, সামান্য পরিমাণে ঋণ দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই উপলব্ধি থেকেই ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ধারণা আসে তার মধ্যে। তিনি চট্টগ্রামের একটি গ্রামের মহিলাদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের মাধ্যমে এই কার্যক্রম শুরু করেন। এর মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ অর্থনীতির প্রকল্প চালু করেন এবং পরবর্তীতে গ্রামীণ ব্যাংক নামে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।
গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ করে দেয়। মূলত নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দিকে লক্ষ্য রেখেই এই ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই মডেল অত্যন্ত কার্যকরী প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্বের অনেক উন্নত দেশও এই মডেল অনুসরণ করে।
পরিবারের জীবনে মুহাম্মদ ইউনূস
ড. ইউনূসের সহধর্মিণী ড. আফরোজী ইউনূস এবং তাদের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। তাদের এক কন্যার নাম মনিকা ইউনুস এবং অন্যজনের নাম দীনা আফরোজ ইউনুস। পরিবারিক জীবনে তিনি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রতি দায়িত্বশীল।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
২০০৬ সালে, মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই সম্মানে ভূষিত হন, যা তাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলে। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল এবং বিভিন্ন দেশের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি সহ ১১২টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। এই পুরস্কারগুলো তার কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও অনুপ্রেরণার প্রতিফলন হিসেবে গৃহীত।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। দেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তার নেতৃত্ব নিয়ে নতুন আশার সঞ্চার হয়। তার নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বিখ্যাত উক্তি: দারিদ্র্য বিমোচনে প্রেরণা
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিখ্যাত উক্তিগুলো তার দারিদ্র্য বিমোচনের লড়াই ও জীবনদর্শনকে ফুটিয়ে তুলেছে। তার কিছু উল্লেখযোগ্য উক্তি হলো:
- “Poverty does not belong in civilized human society. Its proper place is in a museum. That’s where it will be.”
- “Once we know where we want to go, getting there will be so much easier.”
- “If you think creating a world without any poverty is impossible, let’s do it. Because it is the right thing to do.”
- “We can remove poverty from the surface of the earth only if we can redesign our institutions – like the banking institutions, and other institutions; if we redesign our policies, if we look back on our concepts, so that we have a different idea of poor people.”
- “If we are looking for one single action which will enable the poor to overcome their poverty, I would focus on credit.”
সমাপ্তি: মুহাম্মদ ইউনূসের অবদান ও প্রভাব
ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন অর্থনীতিবিদ ও সমাজ সংস্কারক যিনি ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তার ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা ও গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নব দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তার জীবনদর্শন, কাজ ও বিশ্বজুড়ে অর্জিত সম্মান তাকে দেশের অন্যতম গর্বিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত করেছে।