বিশ্বের ধনীদের তালিকায় শীর্ষে জায়গা করে নেয়া ইলন মাস্কের নামটি সবার কাছে পরিচিত। অসাধারণ মেধা, কঠোর পরিশ্রম, এবং ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রাখা মানসিকতার জন্য তিনি শুধু অর্থবিত্তের দিক থেকেই নয়, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। আসুন, জানি তার জীবন ও সাফল্যের পেছনের গল্প।

ইলন মাস্কের জন্ম ১৯৭১ সালের ২৮ জুন, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াতে। তার বাবা ছিলেন একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং মা একজন মডেল ও ডায়েটিশিয়ান। ছোটবেলাতেই তিনি প্রযুক্তির প্রতি গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি প্রথম কম্পিউটার হাতে পান এবং তখন থেকেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখা শুরু করেন। ১২ বছর বয়সে তিনি নিজেই একটি ভিডিও গেম তৈরি করে বিক্রি করেন এবং সেটি থেকে ৫০০ ডলার আয় করেন।
মাস্ক ক্যানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও পরবর্তীতে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান এবং অর্থনীতিতে পড়াশোনা করতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। এরপর স্নাতকোত্তর শেষে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পেলেও মাস্ক ঠিক করলেন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে হাঁটবেন।
শৈশবে তিনি অনেকটা একাকী ছিলেন এবং তার বন্ধুদের মধ্যে খুব বেশি জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু তার উচ্চাভিলাষ ও উদ্ভাবনের নেশা তাকে ধীরে ধীরে বিশ্বসেরা উদ্যোক্তা হতে সাহায্য করেছে।
আমরা যদি ইলন মাস্ক এর ব্যক্তিজীবনের দিকে যায় তবে দেখা যাবে তার ব্যক্তিজীবন খুব একটা আনন্দের ছিল না।সময়ের পরিক্রমায় প্রিয়তমার সাথে বিচ্ছেদ সহ পুনরায় বিয়ের খবর শুনা যায়।২০০০সালে কানাডিয়ান লেখিকা জাস্টিনকে বিয়ে করেছিলেন ইলন মাস্ক এবং আট বছর অতিবাহিত হতে না হতেই শুনা যায় বিবাহ বিচ্ছেদের গুঞ্জন।যদিও এইটাই সত্যি যে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায় ২০০৮ সালে।এবং তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় তাদের ছেলে মেয়ের জন্ম হয়।
এরপর বছর দুয়েক পর ২০১০ সালে বিয়ে করেন অভিনেত্রী টালুলাহ রিলেইকে।বিয়ে টিকে ছিল প্রায় ২বছর।২০১২ সালে টালুলাহর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।২০১৩ সালে টালুলাহকেই পুনরায় বিয়ে করেন ইলন মাস্ক।২০১৬ সালে আবার টালুলাহর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে বলে জানা যায়।সঙীতশিল্পী গ্রিমসের সঙে ২০১৮ সালে ইলন মাস্ক সম্পর্কে জড়ান।
প্রথম উদ্যোগ ও জিপ-টু
ইলন মাস্ক তার ভাইকে সাথে নিয়ে প্রথমে জিপ-টু নামের একটি সফটওয়্যার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল একটি অনলাইন নেভিগেশন সিস্টেম, যা পরবর্তীতে সফলভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ১৯৯৯ সালে কমপ্যাক কোম্পানির কাছে এটি ২২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেন মাস্ক। এই সফল বিক্রির মাধ্যমে মাস্ক তার পরবর্তী বড় উদ্যোগের জন্য প্রস্তুতি নেন।
পেপ্যালের উত্থান ও মাস্কের অভাবনীয় সাফল্য
১৯৯৯ সালে ইলন মাস্ক এক্স.কম নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে অনলাইন লেনদেন সেবার জন্য বিখ্যাত পেপ্যাল নামে পরিচিত হয়। ২০০২ সালে ই-বে কোম্পানি এটি ১.৫ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়, যার থেকে মাস্কের লাভ হয় ১৬৫ মিলিয়ন ডলার। এই অভিজ্ঞতা তার উদ্যোক্তা জীবনকে আরও উৎসাহিত করে এবং নতুন সাফল্যের দ্বার উন্মুক্ত করে।
স্পেসএক্স: মহাকাশে মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন
ইলন মাস্ক স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠা করেন মহাকাশ গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার লক্ষ্যে। তার মূল লক্ষ্য ছিল কম খরচে মহাকাশে ভ্রমণের ব্যবস্থা করা এবং ২০৫০ সালের মধ্যে মঙ্গলে একটি শহর স্থাপন করা। স্পেসএক্সের ফ্যালকন হেভি এবং ফ্যালকন ৯ রকেটের সফল উৎক্ষেপণ প্রমাণ করেছে যে মাস্কের এই স্বপ্ন খুবই বাস্তব এবং সম্ভবপর।
ইলন মাস্ক মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের কথা বলেছেন এবং একবার উল্লেখ করেছেন:
- “আমার অর্ধেক সম্পদ পৃথিবীর সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হবে এবং বাকি অর্ধেক ব্যয় হবে মঙ্গলে স্বনির্ভর শহর গড়ে তোলার জন্য। যদি পৃথিবীতে কোনো সংকট আসে, মঙ্গল আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনধারা অব্যাহত রাখতে সহায়ক হবে।”
টেসলা: বৈদ্যুতিক গাড়ির বিপ্লব
২০০৪ সালে ইলন মাস্ক টেসলা মোটরসে বোর্ডের সদস্য হিসেবে যোগ দেন এবং এরপর কোম্পানির নেতৃত্বে আসেন। টেসলা বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়। বর্তমানে ইলন মাস্ক টেসলার সিইও ও প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। টেসলার বিদ্যুৎচালিত গাড়িগুলি বর্তমানে প্রচুর জনপ্রিয় এবং এর সাফল্যের ধারাবাহিকতা মাস্ককে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় স্থান দিয়েছে।
দ্য বোরিং কোম্পানি এবং হাইপারলুপ প্রযুক্তি
ইলন মাস্ক ২০১৬ সালে দ্য বোরিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যার লক্ষ্য হল অত্যন্ত উচ্চ গতির পরিবহণ ব্যবস্থা স্থাপন করা। তার উদ্ভাবিত হাইপারলুপ প্রযুক্তি ঘণ্টায় প্রায় ১০০০ কিমি গতিতে চলতে সক্ষম, যা বর্তমান পরিবহণ ব্যবস্থায় নতুন এক ধাপ যোগ করেছে। সম্প্রতি এই প্রযুক্তির প্রথম পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
নিউরালিঙ্ক: মানব মস্তিষ্কে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজন
মাস্কের আরেকটি নতুন উদ্যোগ নিউরালিঙ্ক, যা মানুষের মস্তিষ্কের সাথে কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের সংযোগ ঘটাতে কাজ করছে। নিউরালিঙ্কের মাধ্যমে মাস্ক এমন একটি ব্রেইন-মেশিন ইন্টারফেস তৈরি করতে চান, যা ভবিষ্যতে মানুষের মস্তিষ্ক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একত্রিত করবে। এটি মানুষের মস্তিষ্কের উন্নতির জন্য এক অভূতপূর্ব প্রযুক্তি।
বিতর্কিত এবং সাহসী উদ্যোগ
ইলন মাস্ক সাহসী উদ্যোগ এবং বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য পরিচিত। টেসলার মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেও তাকে মাঝেমধ্যে বিতর্কিত মন্তব্য ও বিভিন্ন ঘটনার কারণে শিরোনামে থাকতে দেখা যায়। কমেডিয়ান জো রোগানের পডকাস্টে সরাসরি গাঁজা সেবন করায় তিনি ব্যাপক আলোচিত হন।
বিশ্বসেরা ধনী হওয়ার যাত্রা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ইলন মাস্কের সম্পদ বর্তমানে ১৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। বিগত বছরগুলোতে তার টেসলার শেয়ার মূল্য আট গুণ বৃদ্ধি পায়, যা তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। এদিকে আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস দীর্ঘদিন শীর্ষে ছিলেন, কিন্তু ইলন মাস্ক তাকে পিছনে ফেলে সবার উপরে উঠে আসেন।
ইলন মাস্ক এমন একজন ব্যক্তি যিনি সৃষ্টিশীলতা, সাহসিকতা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পৃথিবীতে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করেছেন। ব্যবসার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পথে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ভবিষ্যৎকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলছে।