Image default
জীবনী

মহানবী (সা.) এর সাহাবী আল বারা ইবনে মালিক (রা) এর জীবনী

আল-বারা’ ইবন মলিক ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী ও রাসূলুল্লাহার (সা) স্নেহের খাদেম হযরত আনাস ইবন মালিকের (রা) বৈমাত্রের ভাই। একথা বলেছেন আবু হতেম। সা’দের মতে তিনি আনাসের সহোদর। তাঁদের উভায়ের মা প্রখ্যাত সাহাবিয়্যা হযরত উম্মু সুলাইম। ইবনুল আছীরের মতও তাই। তবে ইবন হাজার এমত সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, শুরাইক ইবন সামহার জীবনীতে দেখা যায়, তিনি আল-বারা ইবন মালিকের বৈমাত্রেয় ভাই। তাঁদের উভয়ের মা সামহা। পক্ষান্তরে আনাস ইবন মালিকের মা যে উম্মু সুলাইম. এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। এছাড়া উম্মু সুলাইমের সন্তানদের যে পরিচয় বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় তার মোধ্য আল-বারা’র নামটি কোথাও নেই।

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) মদীনায় হিজরাতের পূর্বেই মদীনাবসীদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের হিড়িক পড়ে যায়। দলে দলে লোক মাক্কায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। আবার অনেক মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) বিশেষ দূত হযরত মুস;য়াব ইবন উমাইরের (রা) দা’ওয়াতে মুসলামান হন। মদীনাবাসীদের ইসলাম গ্রহণের এধারা রাসূলুল্লাহার (সা) মদীনাায় আসার পরও অব্যাহত থাকে। হযরত বারা’ এর কোন এক সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।

একমাত্র বদর যুদ্ধ ছাড়া উহুদ, খন্দকসহ বাকী সকল অভিযানে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে অংশগ্রহণ করেন। হুদায়বিয়ার ‘বায়’য়াতে রিদওয়ানে ও তিনি শরীক ছিলেন। প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) খিলাফতকালে গোটা আরবে ভন্ড নবীদের উৎপাত শুরু হয়। এসময় ভন্ডনবী মুসায়ালাম আল কাজ্জাবের সাথে ইয়ামাামর প্রান্তরে মুসলিম বাহিনির যে ভয়াবাহ যুদ্দ হয় তাতে আল বারা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ যুদ্ধে হযরত খালিদ ইবন ওয়ালিদ ছিলেন সেনাপতি। এক পর্যায়ে তিনি সেনাপতিকে লক্ষ করে বলেনঃ আপনি উঠে আদেশ করুন।’ তারপর নিজে ঘোড়ার ওপর সাওয়ার হয়ে আল্লাহর কিছু গুণগান পাঠ করে মুসুিলম বহিনিকে সম্বোধন করে বলেনঃ ওহে মদীনার অধিবাসীগণ! আজ তোমরা অন্তর থেকে মদীনার চিন্তা মুছে ফেলো। আজ তোমাদের অন্তরে শুধু আল্লাহ ও জ্ন্নাাতের স্মরণ বিদ্যমান থাকাই বাঞ্জণীয়। তাঁর এমন হৃদয়গ্রাহী ভাষণের পর গোটা বাহিনীর মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার জোয়ার আসে। সৈন্যরা নিজ নিজ অশ্বে আরোহণ করে তাঁর সাথে সাথে এসে যোগ দেয়।

এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের এক নেতার সাথে হযরত বারা’র হাতাহতি যুদ্ধ হয়। লোকটি ছিল তাগড়া জোয়ান। বারা প্রথমে তার পা লক্ষ্য করে তরবারির এক আঘাত হনেন। আঘাতটি লক্ষ্যভেদী ছিলেন না। তবুও লোকটি ভয়ে গড়াগড়ি যেতে থাকে।এই সুযোগ হযরত বারা মুুর্হূত্যের মধ্যে নিজের তরবারি কোষবদ্ধ করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তার তরবারিটি ছিনিয়ে নিয়ে তাকে এমন একটি ঘা বসিয়ে দেন যে তার দেহটি দ্বিখন্ড হয়ে যায়। তারপর বিদ্যুৎ গতিতে ধর্মত্যাগীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের বাগানের প্রাচীর পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যায়। বাগানের মধ্যে মুসায়লামা অবস্থান করছিল। মুসায়লামার অনুসারী সৈন্যর উদ্যান ঢুকে পড়ে এবং তার পাশে সমবেত হয়ে উদ্যানের ফটক বন্ধ করে দেয়। বারা ইবন মালিক তাদের পিছু ধাওয়া করে প্রাচীরের নিকট পৌঁছে রুদ্ধ ফটকের সামনে থমকে দাঁড়ান। মুহুর্তের মধ্যে তিনি সিংহের মত গর্জে উঠেন এবং হুংকার ছেড়ে বলেনঃ ওহে জনমগুলী! আমি বারা ইবন মালিক। তোমারা আমার দিকে এসো, তোমরা আমার দিকে এসো মহযোদ্ধারা এগিয়ে এলে তিনি তাদের আরো বলেনঃ ওহে জনমগুলী! তোমারা আমাকে উদ্যানের অভ্যন্তারে তাদের মাঝে ছুড়ে মার। লোকেরা বললো: না, তা কেমন করে হয়। তিনি বললেন: আল্লাহর কসম! তোমরপা অবশ্যই আমাকে তাদের নিকট ছুড়ে মারবে। অতঃপর তাঁকে উচুঁ করে তুলে ধরা হয়। তিনি প্রাচীরের উপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখেন এবং মুহুর্তের মধ্যে অপেক্ষমান মুসলিম সৈন্যদের জন্য দরজা খুলে দেন। বিদ্যুৎবেগ মুসলিম সৈন্যরা একযোগে ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। উভয় পক্ষে প্রচুর হতাহত হয়। অভিশপ্ত মুসায়ালামা এখানে নিহত হয় এবং তার বাহিনী পরাজয়বরণ করে। এই ইয়ামামার উদ্যান-ফাটকে বারা উবন মালিকের সাথে যাঁর যাঁর কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে যুদ্ধ করেন তাঁদের মধ্যে হযরত আব্বাদ ইবন বিশ্র শাহাদাহ বরণ করে। আর এভানেই হযরত বারা একাই দশজন প্রতিপক্ষ সৈনিককে হত্যা করেন। এই দুঃসহাসিক অভিযানে তাঁর সারা দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তীর, বর্শা ও বল্লমের আশিটিরও বেশি আঘাত লাগে। বাহনের পিঠে উঠিয়ে তাঁকে শিবিরে আনা হয় এবং মাসাধিককাল চিকিৎসার পর আবার সুস্থ হয়ে ওঠেন। হযরত খালিদ ইবন ওয়ালীদ নিজ হাতে তাঁর ক্ষতে ব্যাঞ্জেজ লাগান এবং সম্পূর্ণ নিজের তত্ববাধানে তাঁর চিকিৎসা করেন।

হিজরী ১৭ সনে খলীফা হযরত উমার (রা) বসারত ওয়ালী হযরত মুগীরা ইবন শুবাকে (রা) অপসারণ করে সেখানে হযরত মূসা আল আশয়ারীকে (রা) নিয়োগ করেন। মদীনা থেকে যাত্রাকালে আবু মূসা যে ২৯ ব্যাক্তি কে সংগে করে নিরয়ে যান তাদের মধ্যে আল-বারা ইবন মালিক একজন। হযরত আল-বারা ইবন মালিক ইরাকের হীরক যুদ্ধেও দারুণ সাহস ও রণকৌশলের পরিচয় দেন। নগরের একটি দুর্গ মুলিম বাহিনী আবরোধ করে রেখেছে। শত্রু বাহিনী ভিতর থেকে আগুনে পোড়ানোর প্রচন্ড গরম কাঁচাওয়ালা শিকল দুর্গ প্রাচীরের ওপর বিছিয়ে রেখেছে যাতে কোন মুসলিম সৈনিক প্রাচীরের কাছেই ঘেঁষতে সাহস না পায়। হযরত আনাস (রা) প্রাচীর টপকানোর জন্য সাহস করে অগ্রসর হলেন। দুর্গবাসীরা কৌশলে তাঁকে শিকলে জড়িযে ওপরের দিকে টেনে তুলতে থাকে। শিকল উপরে উঠছে, এমন সময় হযরত আল-বারা তা দেখে ফেলেন। ত্বরিৎ গতিতে তিনি ছুটে গিয়ে শিকল ধরে এমন হ্যাচকা টাান মারে যে তা ছিড়ে আনাস পড়ে যায় শিকল ধরে টানার কারণে তাঁর হাতের মাংষ উঠে গিয়ে হাঁড় বেরিয়ে যায়। তবে হযরত আনাস (রা) বেঁচে যান।

হিজরী ১৭ থেকে ২০ সনে পারস্যের রামহুরমুয, তুসতার ও সোসা বিজিত হয়। পারস্য বাহিনী যখন রামহুরমুযে প্রতিরোধের উদ্দেশ্য আবার সম্মিলিত হয় তখন রণক্ষেত্র থেকে মুলিম বাহিনীর প্রধান সেনাপতি সা’দ ইবন উবাদাকে লেখা হলো প্রচুর সৈন্য পাঠান এবং তাদের মধ্যে যেন সাহল ইবন আদী, আল-বারা’ ইবন মলিক, মাজা’যা ইবন সাওর প্রমুখ বাক্তিবর্গ থাকেন। পারস্যের তুসতার অভিযাসে তিনি হযরত আবু মূসা আল-আশয়ারীর (রা) বাহিনীর দক্ষিণভাগে অধিনায়ক ছিলেন। এই যুদ্ধে তিনি একাই একশো সৈন্য নিধন করেন। ‘তুসতারে’ যুদ্ধ চলছে। শত্রু বাহিনী সুরক্ষিত দুর্গের অভ্যান্তরে অবস্থান নিয়েছে। এলোপাথাড়ি হামলা চালিয়ে তারা মুসলিম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করছে। ইবনুল আচীর বলেন, এ সময় তারা মুসলিম বাহিনীর ওপর ৮০টি হামলা চালায়। এমন অস্থায় একদিন হযরত আনাস (রা) তাঁর কাছে যেয়ে শোনেন, তিনি সুর করে একটি কবিতা অবৃত্তি করছেন আনাস (রা) বললেন:আল্লাহ আপনাকে এর চেয়ে উত্তম জিনিস আল কোরআন দান করেছেন। তাই সুর করে পাঠ করুন। আল-বারা বললেন সম্ভবতঃ আপনার আশঙ্কা হচ্ছে, না আমি কখন মারা যাই। আল্লাহর কাছে আমার কামনা, তিনি যেন এমনটি না করেন। মরলে আমি ময়দানেয় মরবো। হযারত রাসূলে কারীম (সা) একবার তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেনঃ বিক্ষিপ্ত ও ধুলিমলিন কেশ বিশিষ্ট এমন অনেক ব্যক্তি, মানুষ হিসেবে যাদের কোন গুরুত্ব নেই; কিন্তু তাঁরা আল্লাহর নামে কসম খায়, আল্লাহ তা পূর্ণ করে দেন। আল-বারা ইবন মালিক তাদের অন্যতম। ‘তুসতারে যখন মুসলিম বাহিনী শত্রু বাহিনী দুর্গের পতন ঘটতে অক্ষম হয়ে পড়ে তখন তাঁদের হযরত রাসূলে কারীমের (সা) উপরোক্ত বাণী স্মরণ হয়। তাঁরা হযরত আল-বারা’র (রা) নিকট এসে আবদার করেন, আপনি আল্লাহর নামে একটু কসম খান। তিনি বললেন,‘হে আল্লাহ,আপনার নামে কসম খায়ে বলছি, আজ আপনি মুসলমানদের একটু বিজয় দান করুন এবং আমকে রাসূলুল্লাহর (সা) দর্শন দান করে সম্মানিত করুন। এ সময় মুসলিম সৈন্যর দুর্গ অভ্যান্তরে প্রবেশের একটি সুড়ঙ্গ পথের সন্ধান পায়। হযরত আল-বারা হযরত মাজায’ কে (রা) সংগে নিয়ে সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে দুর্গ অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। সুড়ঙ্গ থেকে বের হতে ইযরত মাজায শত্রুদের নিক্ষিপ্ত একটি বড় পাথরের শাহাদাত বরণ করেন। হযরত আল-বারা ও মুরযাবান আয’রা মুরযাবান আযার নামক এক পারসিক সৈনিকের সামনাসমনি পড়ে যান। সে হযরত আল-বারার (রা) পথ রোধ করে দাঁড়ায়। কিন্তু তিনি মুরযাবানকে হত্যা করে বীর বিক্রমে শত্রু বাহিনীর সকল প্রতিরোধ তছনছ করে দুর্গের দ্বার পর্যন্ত পৌছে যান। সেখানে খোদ হরমুযানের মুখোমুখি হন। দুই জনের মধ্যে তীব্র লড়াই হয়। অবশেষে হরমুযানের হাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেণ।হরমুযান তাকে হত্যা করে তাঁর অস্ত্র-শস্ত্র ও পোষাক-পরিচ্ছেদ হাতিয়ে নেয় এবং তা ত্রিশ হাজারেরও বেশি মুদ্রায় বিক্রি করে। তবে তাঁর এ সহসিকতায় রণক্ষেত্রে মুসরমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্টিত হয়। ঐতিহাসিক ওয়াকিদীর মতে এটা হিজরী ২০ সনের ঘটনা। মতান্তারে হিজরী ১৯ অথবা ২৩ সনের ঘটনা। আল্লামা যিরিক্লী বলেনঃ তিনি তুসতারে পূর্বে ফাটকে শাহাদাত বরণ করেন এবং সেখানেই তাঁরা কবর। হযরত আল-বারা ইবন মালিক ছিলেন হযরত রাসূলে করীমের (সা) বিশিষ্ট সাহাবীদের অন্তর্গত। আনেক বছর যাবত তিনি রাসূলে পাকের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেন। রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ নিঃসৃত অসংখ্য হাদীস নিশ্চয় তিনি শুনে থাকবেন। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তাঁর বর্ণিত হাদীস তেমন দেখা যায় না সম্ভবতঃ জিহাদে ব্যস্ত থাকার কারণে এদিকে মনোযোগ দিতে পারেননি। আল-ইসতঅ’য়াব গ্রন্থকার লিখেছেনঃ আল-বারা ছিলেন মর্যাদাবার সাহাবীদের অন্তুর্গত। আল্লামা জাহাবী বলেছেন: তিনি ছিলেন মহান নেতাদের একজন। চরম সাহসী বীর, অশ্বরোহণ ও কঠিন বিপদের মুকাবিলায় ছিলেন একজন প্রবাদপুরুষ। এ কারণে হযরত উমার (রা) তাঁকে কখনো কোন বাহিনীর অধিনায়ক নিয়োগ করেননি। অন্য সামরিক অফিসারদের একবার তিনি লেখেন: ‘বারা’ কে তোমরা কোন মুলিম বাহিনীর আমীর নিয়োগ করবে না। সে একজন মানুষ, সে একটি বারা বা বিপদ। সামনেই যাবে, পিছনে ফিরতে জানে না। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে: ‘সে একটি ধ্বংস। তবে বাহ্যত: তিনি দেখতে দুর্বল ছিলেন। ‘রিজালুন হাওলার রাসূল’ গ্রন্থকার খালিদ মুহাস্মদ বলেন: তাঁর ঐকান্তিক বাসানা ছিল শহীদ হয়ে মরার। আল্লাহ পাক তাঁর সে বাসনা পূরণ করেন। আল-মুসতাদরিক ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন, আনাস ইবন মালিক বলতেন আল-বারা ইবন মালিক সুমধুর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন। গান গাওয়ার সখও তাঁর ছিল হযরত আনাস বলতেন: বারা পুরুষদেরকে উট চরানোর গান গেয়ে শোনাতেন। একবার রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে এক সফরে তিনি একটি গান গচ্ছেন। রাসূল (সা) তা শুনে আল-বারা কে বলেন: মাহিলাদের কথা একটু মনে রেখ্ একথা শুনে তিনি চুপ হয়ে যান।

– ড. মুহাম্মদ আবদুল মা’বুদ

Related posts

‘ভারতীয়দের থেকে আলাদা বলেই তারা আমার পোশাক নেয়’

News Desk

যার অভিনয়ে ডুব দেয়া যায় অবলীলায় তিনি হলেন ইরফান খান

News Desk

তারিক আনাম খানের জীবনী, শিক্ষা, ফ্যামিলি, চলচ্চিত্র, নাটক, মঞ্চনাটক, ওয়েব, এবং সম্পূর্ণ প্রোফাইল

News Desk

Leave a Comment