ডোনাল্ড ট্রাম্প, জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১৪ জুন, নিউইয়র্কের কুইন্সে। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হন এবং ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেন। ব্যবসায়ী, টিভি ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিতর্কিত উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে একজন বিশেষ কৌশলী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাবা, ফ্রেড ট্রাম্প, ছিলেন একজন সফল রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী। বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন তিনি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে স্কুলে শৃঙ্খলার অভাবে বাবা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন নিউইয়র্ক মিলিটারি একাডেমিতে। এই মিলিটারি স্কুলের কঠোর পরিবেশ তাকে শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করতে শিখিয়েছিল।
এরপর ট্রাম্প পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্টন স্কুল থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। অনেকেই ধারণা করতেন, বাবা-প্রদত্ত বিপুল সম্পত্তি থাকার কারণে ট্রাম্প হয়তো বাবার কোম্পানির বাইরে কিছু করবেন না, তবে ট্রাম্প নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা থেকে ব্যবসায়ে নামেন এবং শিগগিরই বাবার কাছ থেকে এক মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে নিউইয়র্ক শহরে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় প্রবেশ করেন।
ব্যবসায়ী হিসেবে সাফল্য ও ব্যার্থতা
প্রথমদিকে ট্রাম্প রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ শুরু করেন এবং বেশ কিছু প্রজেক্টে সফলতা অর্জন করেন। শীঘ্রই তিনি নিউইয়র্কের রিয়েল এস্টেট সংগঠনের সভাপতি হয়ে উঠেন। পরে, ক্যাসিনো, গলফ কোর্স এবং হোটেলসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। তার কোম্পানি নিউইয়র্ক শহরসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বড় শহরে প্রজেক্ট চালায় এবং ভারত, তুরস্ক ও ফিলিপিন্সসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
ট্রাম্পের ব্যবসায়িক জীবনেও নানা চড়াই-উৎরাই রয়েছে। তার ব্যবসা একাধিকবার দেউলিয়াত্ব ঘোষণা করেছে এবং তিনি নিজেও ছয়বার দেউলিয়া ঘোষণার পথে গিয়েছেন। তবে এর মধ্যেও তিনি আত্মবিশ্বাস ধরে রেখেছেন এবং বহু বাধা সত্ত্বেও নিজের কর্মজীবনকে সফলতার পথে এগিয়ে নিয়েছেন।
বিনোদন জগতে পরিচিতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন সেলিব্রিটি হিসেবে পরিচিত ছিলেন অনেক আগে থেকেই। তিনি প্রথম আলোচনায় আসেন যখন তিনি মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএসএ এবং মিস টিন ইউএসএ প্রতিযোগিতার আয়োজন শুরু করেন। পরে, এনবিসি টেলিভিশনের জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো দ্য অ্যাপ্রেন্টিস অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। তার ‘ইউ আর ফায়ার্ড’ উক্তিটি তখন প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হলেও ট্রাম্প কিছু উদ্যোগেও ব্যর্থ হন, যেমন ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরও কিছু বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। তার সত্ত্বেও তিনি প্রচুর বই লিখেছেন, যা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং তাকে আরও বড় পরিসরে পরিচিত করেছে।
ব্যক্তিগত জীবন
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবন ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত। প্রথমে তার বিয়ে হয়েছিল ইভানা জেলনিকোভার সঙ্গে। তাদের তিন সন্তান—ডোনাল্ড জুনিয়র, ইভাঙ্কা এবং এরিক—এই ঘরেই জন্ম নেয়। তবে, ১৯৯০ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় স্ত্রী মার্লা ম্যাপলস, যার সঙ্গে তার একটি মেয়ে টিফানি রয়েছে। তবে, ১৯৯৯ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। ট্রাম্পের বর্তমান স্ত্রী মেলানিয়া, যার সঙ্গে তাদের এক ছেলে ব্যারন রয়েছে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একাধিকবার যৌন নির্যাতন এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে, যা তার ব্যক্তিগত জীবনে বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তোলে।
রাজনীতিতে প্রবেশ ও সাফল্য
২০১৫ সালের জুন মাসে ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেন। নির্বাচনী প্রচারণায় নিজের ব্যবসায়িক সাফল্য এবং সম্পদকে বারবার উল্লেখ করেন তিনি। “মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন” স্লোগান নিয়ে তিনি প্রচারণায় নামেন এবং মেক্সিকোসহ বিভিন্ন দেশের ওপর কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন।
এই প্রচারণার মাধ্যমে সহজেই রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন পান এবং পরবর্তীতে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে নির্বাচনে বিজয়ী হন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। তার শাসনকালে করপোরেট ট্যাক্স কমানো এবং অভিবাসন নিয়ন্ত্রণসহ একাধিক বিতর্কিত পদক্ষেপ নেন।
২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হলেও তার প্রভাব রাজনীতিতে বিদ্যমান। তিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনেও অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন এবং উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী কমলা হ্যারিসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা রয়েছে।
ক্যাপিটল হামলা ও রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল ভবনে হামলার পর তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও ট্রাম্পের অনুগত সমর্থকদের একটি বড় অংশ এখনও তাকে সমর্থন করে যাচ্ছে। রিপাবলিকান পার্টির ওপর তার প্রভাব এখনও বজায় রয়েছে, যা তাকে ২০২৪ সালের নির্বাচনেও প্রার্থিতা করার সুযোগ দিয়েছে।
বর্তমানে বাইডেন প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং অবৈধ অভিবাসন ইস্যুতে সমালোচনা বাড়ছে, যা ট্রাম্পের সমর্থকদের তার পক্ষে আবারো সংঘবদ্ধ করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব যিনি ব্যবসা, বিনোদন এবং রাজনীতি—এই তিনটি ক্ষেত্রেই খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার উত্থান-পতনের গল্প প্রমাণ করে যে আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ় সংকল্প থাকলে মানুষ বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম।