ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ: সাহস, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের এক প্রতীক
ভারতের ইতিহাসে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ এমন এক নাম, যা সাহস, আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের প্রতীক হয়ে রয়েছে। ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অসাধারণ সাহসের পরিচয় দেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। আসুন, রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের জীবন ও সংগ্রামের এই মহান কাহিনী বিস্তারিতভাবে জানি।
লক্ষ্মীবাঈ কে ছিলেন?
ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ ভারতের বিপ্লবী ইতিহাসের এক অমূল্য রত্ন। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অন্যতম পথিকৃৎ। রানি লক্ষ্মীবাঈ ঝাঁসির রাজ্যের অধিপতি হয়ে ব্রিটিশদের শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাহসিকতা ও দৃঢ়তার কারণে তিনি আজও জাতির কাছে এক আইকন হিসেবে বিবেচিত।
লক্ষ্মীবাঈ এর জীবনী – Laxmi Bai Biography in Bengali
নাম (Name) | মণিকর্ণিকা (Laxmi Bai) |
জন্ম (Birthday) | ১৯ নভেম্বর ১৮২৮ (19th November 1828) |
জন্মস্থান (Birthplace) | বারাণসী, ব্রিটিশ ভারত |
পিতামাতা | মরুপান্ত তাম্বে এবং ভাগীরথী বাঈ তাম্বে |
পেশা | রাণী, শাসক |
পরিচিতির কারণ | ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহে ভূমিকা, গোয়ালিয়র দখল |
দাম্পত্য সঙ্গী | গঙ্গাধর রাও নিওয়াকর |
মৃত্যু (Death) | ১৭ জুন ১৮৫৮ (17th June 1858) |
প্রারম্ভিক জীবন: মণিকর্ণিকা থেকে লক্ষ্মীবাঈ
রানি লক্ষ্মীবাঈ ১৮২৮ সালের ১৯ নভেম্বর ভারতের বারাণসীতে একটি মারাঠা ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশবের নাম ছিল মণিকর্ণিকা তাম্বে, এবং ভালোবেসে সবাই তাকে মনু বলে ডাকত। তার পিতা মোরোপন্ত তাম্বে ছিলেন শেষ পেশোয়া বাজিরাও দ্বিতীয়ের অধীনস্ত একজন কর্মচারী, আর তার মা ভাগীরথী সপ্রে ছিলেন এক সাধারণ গৃহিণী।
মাত্র চার বছর বয়সে মা-কে হারানোর পর মণিকর্ণিকা তার পিতার সঙ্গে পেশোয়া বাজিরাওয়ের দরবারে থাকতে শুরু করেন। দরবারে ছোট্ট মনুর কৌতুকপূর্ণ আচরণ এবং বুদ্ধিমত্তা সবার মন জয় করেছিল। পেশোয়া তাকে আদর করে ছবিলি নামে ডাকতেন।
শৈশব থেকে শিক্ষা ও অস্ত্রবিদ্যার প্রতি আগ্রহ
পেশোয়া বাজিরাওয়ের দরবারে তার সন্তানদের শিক্ষার জন্য নিয়মিত শিক্ষক আসতেন। মনু সেখানেই তাদের সঙ্গে পড়াশোনা শুরু করেন। মাত্র সাত বছর বয়সেই তিনি তলোয়ার চালানো, ঘোড়ায় চড়া এবং তীরন্দাজিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। ছোটবেলা থেকেই মণিকর্ণিকার অস্ত্র ও যুদ্ধবিদ্যার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। এই আগ্রহই পরবর্তীতে তাকে একজন দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলে।
বিবাহিত জীবন: মণিকর্ণিকা থেকে রানি লক্ষ্মীবাঈ
১৮৪২ সালে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে মণিকর্ণিকার বিয়ে হয় ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও নিওয়ালকার-এর সঙ্গে। বিয়ের পর তার নাম রাখা হয় লক্ষ্মীবাঈ। ১৮৫১ সালে লক্ষ্মীবাঈ একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু সেই সন্তান মাত্র চার মাস বয়সে মারা যায়।
এরপর ১৮৫৩ সালে রাজা গঙ্গাধর রাও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে তিনি একটি পাঁচ বছরের শিশুকে দত্তক নিয়ে তার নাম দামোদর রাও রাখেন। কিন্তু রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা দামোদর রাওকে উত্তরাধিকারী মানতে অস্বীকার করে, এবং ঝাঁসি রাজ্যকে দখল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা
রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি তার কুখ্যাত “ডকট্রিন অব ল্যাপস” নীতি অনুযায়ী ঝাঁসি দখল করতে চান। ব্রিটিশরা ঝাঁসির কোষাগার দখল করে এবং রানি লক্ষ্মীবাঈকে ঝাঁসির দুর্গ ছেড়ে চলে যেতে বলে। কিন্তু লক্ষ্মীবাঈ এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
রানি লক্ষ্মীবাঈ ঝাঁসির জন্য এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন, যেখানে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি তাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করেন।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের যুদ্ধ
১৮৫৮ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ঝাঁসিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। লক্ষ্মীবাঈ তার সেনাবাহিনী নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে ব্রিটিশদের মোকাবিলা করেন। যুদ্ধে তার ছেলেকে পিঠে বেঁধে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
কিন্তু ব্রিটিশরা যখন ঝাঁসির দুর্গ সম্পূর্ণরূপে দখল করে নেয়, তখন রানি কাল্পি শহরে পালিয়ে যান এবং সেখান থেকে আরও শক্তি সংগ্রহ করেন। কাল্পিতেও ব্রিটিশদের সঙ্গে তার বাহিনীর একটি ভয়াবহ যুদ্ধ হয়।
গোয়ালিয়রের যুদ্ধ ও শেষ সংগ্রাম
কাল্পি থেকে রানি লক্ষ্মীবাঈ গোয়ালিয়রে পৌঁছান এবং তাত্য টোপের সঙ্গে মিলে শহরটি দখল করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাকে অনুসরণ করে গোয়ালিয়রেও পৌঁছায়। ১৮৫৮ সালের ১৮ জুন গোয়ালিয়রের কাছে কোটার যুদ্ধক্ষেত্রে রানি লক্ষ্মীবাঈ তার শেষ যুদ্ধটি করেন।
দুই হাতে তলোয়ার নিয়ে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। তবে একটি বর্শার আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে তিনি মন্দিরে আশ্রয় নেন। সেখানেই তিনি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, তার দেহ ব্রিটিশদের হাতে পড়তে দেওয়া হয়নি। সৈন্যরা তার মৃতদেহ দাহ করে।
মৃত্যুর পরও অমর রানি লক্ষ্মীবাঈ
১৮৫৮ সালের ১৮ জুন রানী লক্ষ্মীবাঈ মৃত্যুবরণ করলেও তার সাহসিকতা ও দেশপ্রেম আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি শুধুমাত্র ঝাঁসির রানি নন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম আলো। তার জীবনী আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে চরম প্রতিকূলতায়ও আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়।
রানি লক্ষ্মীবাঈ শুধু ভারতের ইতিহাসের এক অধ্যায় নন, তিনি এক চিরন্তন অনুপ্রেরণা। তার জীবন আমাদের শেখায় যে সাহসিকতা, দায়িত্ববোধ, এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে কোনো বাধাকেই অপরাজেয় নয়। আজও লক্ষ্মীবাঈয়ের কাহিনী কোটি মানুষের মনে দেশপ্রেমের অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে রাখে।
“মে মেরি ঝাঁসি নেহি দুঙ্গি” – তার এই বিখ্যাত উক্তি আজও ভারতীয়দের মনে গর্বের সঞ্চার করে।