হাবিবুল বাশার সুমন : বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক এবং বাংলাদেশের সফলতম টেস্ট ব্যাটসম্যান। তার পুরো নাম কাজী হাবিবুল বাশার। ক্রিকেটার হাবিবুল বাশার সুমন ১৭ আগস্ট ১৯৭২ ,সালে নাগকান্দা কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন | তিনি একজন ডান-হাতি ব্যাটসম্যান। তার বোলিংয়ের ধরন অফ ব্রেক। বাংলাদেশের সর্বস্তরের ক্রিকেট দর্শকই তাকে এক নামে চিনেন। যদি কেউ এমন থেকে থাকে যে বাংলাদেশের খেলা দেখেন কিন্তু হাবিবুল বাশারকে চিনেন না, তাহলে নিঃসন্দেহে তাকে নতুন ক্রিকেট দর্শক বলা যায়। তিনি কেবল বাংলাদেশেই না, দেশের বাহিরেও সুপরিচিত। বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন দীর্ঘদিন। দেশের মানুষকে ক্রিকেট নিয়ে প্রবল আশাবাদী করে তোলার পিছে যাদের ভূমিকা আছে তাদের মধ্যে হাবিবুল বাশার অন্যতম।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনি অন্যতম একজন উজ্বল নক্ষত্র। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথম বাঘা বাঘা দলদের হারাতে শিখেছে। বাংলাদেশের অন্যতম এই কাণ্ডারি বর্তমানে বিসিবির অন্যতম চিফ সিলেক্টর হিসেবে আছেন। তার সাথে দায়িত্বে আছেন আকরাম খান এবং মিনহাজুল আবেদিন। বাংলাদেশ জাতীয় দল ছাড়াও তিনি জাতীয় ক্রিকেট লীগে খুলনা জেলা এবং ঢাকার প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেটে বাংলাদেশ বিমান দলের হয়ে খেলছেন। তার টেস্ট অভিষেক হয় ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে। আর একদিনের খেলায় অভিষেক হয় ১৯৯৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায়। তার অধীনে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রথম কোন টেস্ট ম্যাচে জয়লাভ করে এবং অস্ট্রেলিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয়লাভ করেছে।
এক নজরে হাবিবুল বাশার | |
পূর্ণ নাম | কাজী হাবিবুল বাশার সুমন |
ডাকনাম | সুমন, মি.ফিফটি |
জন্ম তারিখ | ১৭ই আগস্ট, ১৯৭২ |
জন্ম স্থান | কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ |
উচ্চতা | পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি |
পেশা | ক্রিকেটার |
ভূমিকা | ব্যাটসম্যান |
ব্যাটিংয়ের ধরণ | ডানহাতি ব্যাটসম্যান |
বোলিংয়ের ধরণ | ডানহাতি অফ ব্রেক |
ধর্ম | ইসলাম |
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এর সূচনা
বাশার সর্বপ্রথম ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে ক্রিকেট খেলেন, সেটা ছিল অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেন। ধীরে ধীরে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে থাকেন তিনি। তার সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশে ভালো ক্রিকেট খেলে এমন মানুষ কমই ছিল। আর দেশের ক্রিকেটের উন্নতির জন্যে যথেষ্ট সুযোগেরও অভাব ছিল। তবুও সকল বাঁধা অতিক্রম করে ধীরে ধীরে নির্বাচক দলের নজরে আসতে শুরু করেন হাবিবুল বাশার। অবশেষে ১৯৯৫ সালের এশিয়া কাপের আসরে বাংলাদেশ বনাম শ্রীলংকার ম্যাচের মাধ্যমে তার অভিষেক ঘটে একদিনের ক্রিকেটে।
বাংলাদেশ যেবার আইসিসি ট্রফি জিতল (১৯৯৭) সেবার তিনি দলের বাহিরে ছিলেন। ৯৯ এর বিশ্বকাপেও তাকে দলের বাহিরে রাখা হয়। পরে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে আবার দলে জায়গা করে নেন হাবিবুল বাশার।
টেস্ট ক্রিকেট এ হাবিবুল বাশার
টেস্টে বাংলাদেশের তামিম ইকবাল, মুশফিক আর সাকিব আল হাসান ছাড়া আর যিনি ৩০+ গড়ের অধিকারী তিনি আমাদের হাবিবুল বাশার। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে রেকর্ড সংখ্যক ২৪টি টেস্ট ফিফটি করেন, যা এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি। ভারতের বিপক্ষে ২০০০ সালে ১০ই নভেম্বর তার টেস্ট অভিষেক হয়। তিনি সর্বশেষ টেস্ট খেলেন ২০০৮-এ দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ফিফটি (৭১) করেন হাবিবুল বাশার সুমন। অবশ্য এর আগে উদ্বোধনী টেস্টেই আমিনুল ইসলাম বুলবুল ১৪৫ রান করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে… এক নজরে দেখে নেয়া যাক হাবিবুল বাশারের টেস্ট ক্যারিয়ার –
ম্যাচ | ৫০ টি |
ইনিংস | ৯৯টি |
মোট রান | ৩০২৬ রান |
সর্বোচ্চ রান | ১১৩ রান |
স্ট্রাইক রেট | ৬০.২৭ |
গড় | ৩০.৮৭ |
ফিফটি | ২৪টি |
সেঞ্চুরি | ৩ টি |
চার | ৪০১টি |
ছয় | ৪টি |
ক্যাচ | ২২টি |
১৯৯৫ এর ৬ এপ্রিল শারজাহ-তে শ্রীলংকার বিপক্ষে তার ওয়ানডে অভিষেক হয়। সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেন ভারতের বিপক্ষে ২০০৭ সালে। ওয়ানডে ক্রিকেটে কোন সেঞ্চুরির দেখা না পেলেও তার ঝোলায় রয়েছে ১৪টি হাফ সেঞ্চুরি। ২১.৬৮ গড়ে করেছেন মোট ২১৬৮ রান। তার ওয়ানডে ক্যারিয়ার-

ম্যাচ | ১১১ টি |
ইনিংস | ১০৫টি |
মোট রান | ২১৬৮ রান |
সর্বোচ্চ রান | ৭৮ রান |
স্ট্রাইক রেট | ৬০.২৭ |
গড় | ২১.৬৮ |
ফিফটি | ১৪টি |
ক্যাচ | ২২টি |
ঘরোয়া ক্রিকেটে হাবিবুল বাশার
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট | |
ম্যাচ | ৯১ টি |
ইনিংস | ১৭০টি |
মোট রান | ৫৫৭১ রান |
সর্বোচ্চ রান | ২২৪ রান |
গড় | ৩৩.৭৬ |
ফিফটি | ৪১টি |
সেঞ্চুরি | ৭টি |
ক্যাচ | ৪০টি |
ঘরোয়া সীমিত ওভারের খেলায় –

ম্যাচ | ১৫৬ টি |
ইনিংস | ১৪৯টি |
মোট রান | ৩৪১৮ রান |
সর্বোচ্চ রান | ৮৩ রান |
গড় | ২৪.৭৪ |
ফিফটি | ২৪টি |
ক্যাচ | ৩৩টি |
অধিনায়ক হিসেবে হাবিবুল বাশার সুমন
সর্বপ্রথম ২০০৪ এ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অধিনায়কত্ব পালন করেন তিনি। সিরিজ শুরুর পূর্বেই তাকে অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তিনি টেস্ট এ বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তার নেতৃত্ব পায় মোট ১৮টি টেস্টে। বাংলাদেশ সর্বপ্রথম টেস্ট এবং একই সাথে সিরিজ জয় নিশ্চিত করে তার নেতৃত্বে। সেটা ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৫ সালে।
আর ওয়ানডেতে অধিনায়ক হিসেবে বেশ সফল আমাদের হাবিবুল বাশার। সীমিত ওভারের খেলায় তিনি বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেন নোট ৬৯টিতে। বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলা শুরু করেছে তখনও খুব বেশি সময় হয়নি। এই সময়েই হাবিবুল বাশার সুমন বাংলাদেশের মানুষকে নতুন আশায় উজ্জীবিত করেন তার অধিনায়কতে বাংলাদেশ ২৯ টি জয়ের মাধ্যমে। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ প্রথম বাঘা বাঘা দলগুলোকে হারাতে শিখে। জিম্বাবুয়েকে আর কেনিয়াকে বার বার হারিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়ও তার অধিনায়কত্বেই পায় বাংলাদেশ। এছাড়া শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতকেও হারিয়েছেন তিনি।
২০০৭ বিশ্বকাপেও হাবিবুল বাশার ছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। সেবারই প্রথম বাংলাদেশ কোন বিশ্বকাপে সুপার সিক্স পর্বে উঠতে পেরেছিল। ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে এসে তাক লাগিয়ে দেয় সবাইকে।
আইসিএল-এ যোগদান

তিনি যে বয়সে জাতীয় দল থেকে অবসরগ্রহণ করেন, সেটাকে যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই সর্বোচ্চ পরিপক্বতার বয়স। তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর সার্ভিস যে মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের কাছে হয়ে উঠতে পারতো পরম মূল্যবান, সেই সময়টাতে তাঁকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিলো। জাতীয় দলের বাইরে থাকায় এবং যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়ায় একবুক অভিমান নিয়ে ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০০৮ ১৩ সদস্যের দল নিয়ে তৎকালীন ‘নিষিদ্ধ’ ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ আইসিএলে যোগ দেন । ঢাকা ওয়ারিয়র্স নামে আইসিএল-এ খেলেন তারা। টুর্নামেন্ট এ সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়(৬২ রান) পায় ঢাকা ওয়ারিয়র্স, সেটাও হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে। পরে তাকে সহ অন্যান্য খেলোয়াড়দের বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে ১০ বছরের জন্যে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে অবশ্য সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
নাটকেও অভিনয়

বর্ণিল এই জীবনে অভিনয়টাও করেছেন একবার। ২০০৯ সালে আইসিএল অভিজ্ঞতার পর ফিরে ‘পাসওয়ার্ড নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন তিনি। তাঁর ভাষায় অভিজ্ঞতাটা অনেকটা এরকম, “আগে ভাবতাম অভিনয় করা সোজা। কিন্তু করতে গিয়ে দেখলাম, বেশ কঠিন আছে। অনেক মনোযোগ দিয়ে করতে হয়; এমনকি শেন ওয়ার্নকে ফেস করার সময় যতটা মনোযোগ দিতে হয়, তাঁর চেয়েও বেশি।”
তিনি অবসর নেওয়ার পর সময় কেটে গেছে অনেকটা। বাংলাদেশকে এখন আর কেউ ‘মিনোজ’ বলে ডাকে না, এখন তাঁরা বলে-কয়ে বড় দলকে হারাতে জানে। এখন টেস্ট খেলাটা বেশ ধরতে শিখে গেছে বাংলাদেশ, এমনকি গত বেশ কিছুদিনে নিয়মিত জিততেও শিখে গেছে। আর এই অর্জনগুলোর বেশিরভাগই শুরু হয়েছিলো তাঁর হাত ধরেই। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে হাবিবুল বাশার সুমনের পরিচয় নেহায়েত একজন ব্যাটসম্যান কিংবা একজন অধিনায়ক হিসেবে নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম অভিভাবকও। আর তাই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম এক নক্ষত্র হিসেবে তিনি সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবেন অনন্তকাল ধরে।