সম্রাট আকবর যিনি একজন বিজয়ী বীর-প্রশাসক ও শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কৃতিত্বপূর্ণ কাজের মাধ্যমে তার সমসাময়িক বিখ্যাত শাসকদের মধ্যে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন।তিনি 1556 থেকে 1605 সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ অংশে মুঘল ক্ষমতা প্রসারিত করেন । তার সাম্রাজ্যের ঐক্য রক্ষা করার জন্য, আকবর তার রাজ্যের অমুসলিম জনগণের আনুগত্য অর্জন করে এমন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে সংস্কার ও শক্তিশালী করেন এবং তার আর্থিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভূত করেন এবং কর-সংগ্রহ প্রক্রিয়া পুনর্গঠিত করেন। যদিও তিনি কখনই ইসলাম ত্যাগ করেননি , তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতি সক্রিয় আগ্রহ নিয়েছিলেন, হিন্দু, পার্সি এবং খ্রিস্টানদের পাশাপাশি মুসলমানদেরকেও তাঁর সামনে ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নিতে প্ররোচিত করেছিলেন। নিজে নিরক্ষর, তিনি পণ্ডিত, কবি, চিত্রশিল্পী এবং সঙ্গীতজ্ঞদের উত্সাহিত করেছিলেন, তাঁর দরবারকে সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন ।
নাম : | আকবর اکبر |
সম্পূর্ণনাম : | মির্জা আব্দুল-ফতহ-জালাল উদ্দিন মহম্মদ আকবর। |
পিতার নাম : | নাসিরুদ্দিন মহম্মদ হুমায়ুন। |
মাতার নাম : | হামিদা বানু বেগম। |
জন্ম : | 1542 খ্রিস্টাব্দের 15 ই অক্টোবর। |
পূর্বসূরী : | হুমায়ুন |
উত্তরসূরি : | জাহাঙ্গীর |
রাজপ্রতিভু : | বৈরাম খাঁ |
পত্নীগণ : | 1.রুকাইয়া সুলতান বেগম 2. বেগম নাথি বাঈ 3. মারিয়াম-উজ-জামানি বেগম 4.সেলিনা সুলতানা বেগম 5. বেগম রাজ কানয়ারি বাঈ 6. রাজিয়া সুলতান বেগম 7. বিবি দৌলত শাদ বেগম |
বংশধর :- পুত্র | 1. জাহাঙ্গীর (পুত্র) 2. মুরাদ (পুত্র) 3. দানিয়েল (পুত্র) 4. হাসান (পুত্র) 5. হুসেইন (পুত্র) |
বংশধর :- কন্যা | 1.আরাম বানু বেগম (কন্যা) 2.শাকর উন্নিসা বেগম (কন্যা) 3.শেহজাদী খানুম (কন্যা) |
রাজবংশ : | মুঘল রাজবংশ (তৈমুরীয় বংশ)। |
ধর্ম : | দীন-ই-ইলাহী |
মৃত্যু : | 1605 খ্রিস্টাব্দের 27শে অক্টোবর ফতেপুর সিক্রিতে (আগ্রায়) |
সমাধি স্থল: | সিকেন্দ্রায় (আগ্রা) |
প্রারম্ভিক জীবন
আবু আল-ফাতহ জালাল আল-দীন মুহম্মদ আকবর তুর্কি, মঙ্গোল এবং ইরানিদের বংশধর ছিলেন – মধ্যযুগীয় সময়ে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তারকারী তিনটি মানুষ । তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিলেন তৈমুর (টেমেরলেন) এবং চেঙ্গিস খান । তার বাবা,হুমায়ুন , সুরের আফগান দখলদার শের শাহ তার রাজধানী দিল্লি থেকে বিতাড়িত , সিন্ধু অঞ্চলে (বর্তমানে সিন্ধু প্রদেশ, পাকিস্তান ) তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নিরর্থক চেষ্টা করছিলেন। শীঘ্রই হুমায়ুনকে ভারত ছেড়ে আফগানিস্তান ও ইরানে যেতে হয়েছিল , যেখানে শাহ তাকে কিছু সৈন্য ধার দিয়েছিলেন। শের শাহের মৃত্যুর 10 বছর পর 1555 সালে হুমায়ুন তার সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। আকবর, 13 বছর বয়সে, পাঞ্জাব অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত হন (বর্তমানে পাঞ্জাব রাজ্য, ভারত, এবং পাঞ্জাব প্রদেশ, পাকিস্তান দ্বারা অধিকৃত)।
1556 সালে মারা গেলে হুমায়ুন সবেমাত্র তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তার গভর্নররা দিল্লী সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হারান।হেমু , একজন হিন্দু মন্ত্রী যিনি নিজের জন্য সিংহাসন দাবি করেছিলেন। কিন্তু ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে (বর্তমান সময়ের কাছাকাছি) একটি মুঘল বাহিনী হেমুকে পরাজিত করে।পানিপথ ,হরিয়ানা রাজ্য, ভারত), যেটি দিল্লির রুটের নির্দেশ দেয়, এইভাবে আকবরের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করে ।
আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় তার শাসন পাঞ্জাব এবং দিল্লির আশেপাশের অঞ্চলের চেয়ে সামান্য বেশি বিস্তৃত হয়েছিল, কিন্তু, তার মুখ্যমন্ত্রী, বায়রাম খানের নির্দেশনায়, তার কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে একত্রিত এবং প্রসারিত হয়েছিল। আকবর 1560 সালে বেরাম খানকে অবসর নিতে বাধ্য করার পরে এবং নিজে শাসন করতে শুরু করার পরেও প্রক্রিয়াটি অব্যাহত ছিল – প্রথমে এখনও পারিবারিক প্রভাবের অধীনে কিন্তু শীঘ্রই একজন নিরঙ্কুশ রাজা হিসেবে।
সিংহাসন আরোহন
1556 খ্রিস্টাব্দে পিতা হুমায়ুনের মৃত্যুর পর আকবর (হুমায়ুনের জ্যেষ্ঠপুত্র)1556 খ্রিস্টাব্দের 11ই ফেব্রুয়ারি দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন মাত্র 13 বছর 4 মাস বয়সে। কিন্ত তাঁর রাজ্যাভিষেক হয় 14 ই ফেব্রুয়ারি 1556 সালে। এই সময় নাবালক মুঘল সম্রাটের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হুমায়ুনের বিশ্বস্ত বন্ধু বৈরাম খাঁ। আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেই দিল্লীর জামি মসজিদে নিজের নামে খুদবা পাঠ করে “শাহেনসা” উপাধি নেন। অভিভাকক বৈরাম খাঁ প্রধানমন্ত্রী বা “ভকিল-উল্-সুলতানেত”- রূপে নিযুক্ত হন এবং আকবরের কাছ থেকে “খান-ই-খানান“-উপাধিতে ভূষিত হন। এই সময় রাজ্য পরিচালনা করতেন বৈরাম খাঁ কারণ এই সময় আকবর নামে মাত্র সম্রাট ছিলেন।
আকবরের চরিত্র,কৃতিত্ব ও বিদেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক
সম্রাট আকবরের মহানুভবতার সাথে বাস্তব জীবনের কিছু পরিচয় সুস্পষ্ট ভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর কর্মের মাধ্যমে- তাঁরই নিদর্শন হল 1563 খ্রিস্টাব্দে হিন্দুদের উপর থেকে জিজিয়া কর তুলে দেওয়া এবং দাস প্রথা ও সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করে শ্রেষ্ঠ শাসকের পরিচয় দিয়েছিলেন।বিবাহের বয়স ছেলেদের ক্ষেত্রে 16 বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে 14 বছর নির্দিষ্ট করে দেন। আকবরের সাথে অন্যান্য দেশের বৈদেশিক সম্পর্ক ভালো ছিল যার দরুন তার রাজসভায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের এসেছেন। তাঁর সময়ে পর্তুগিজ দূত হিসেবে অ্যান্টিনিও ক্যাব্রাল আকবরের দরবারে আসনে।আকবর হাজী আব্দুল্লাকে দূত হিসেবে পর্তুগিজদের কাছে পাঠান।ফাদার রুডলফ দূত হিসেবে তাঁর রাজসভায় আসেন।1583 খ্রিস্টাব্দে লিও গ্রেমন্ট পর্তুগিজ দূত হিসেবে আকবরের রাজসভায় আসেন। 1594 খ্রিস্টাব্দে জেরম জেভিয়ার ও ফাদার এমানুয়েল পিনরো আকবরের দরবারে আসেন।1595 খ্রিস্টাব্দে বেনেডিক্ট দিয়োগ লাহোরে আসেন।এই ভাবে আকবর বৈদেশিক সম্পর্কের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যকে ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আকবর পারসিক উৎসব নওরোজ চালু করেন এবং সেই সঙ্গে চালু করেন পারসিক সৌর ক্যালেন্ডার।আকবর জৈন পন্ডিত হরিবিজয়সুরীকে “জগতগুরু”-উপাধি দেন এবং জিনচন্দ্রসূরীকে “জগপ্রধান”- উপাধি দেন। আকবরের সময় প্রথম দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় 1594 – 1598 খ্রিস্টাব্দে। আকবরের নির্দেশে বৈরাম খাঁকে হত্যা করেন মুবারক খান। আকবর খুব সুন্দর নাগারা বাজাতে পারতেন।আকবরের রাজসভায় বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ছিলেন তানসেন। তাঁর আসল নাম রামতনু পান্ডে।মল্লার, তোড়ি,সরং ইত্যাদি হল তানসেনের আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ রাগ-রাগিনী।
শেষ জীবন
1605 খ্রিস্টাব্দের 27 শে অক্টোবর মধ্যরাতে আমাশয়ে আক্রান্ত হয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক আকবর মৃত্যু বরণ করেন ফতেপুর সিক্রিতে(আগ্রা)। এই মহান সম্রাটকে সেকেন্দ্রায় সমাধিস্থ করা হয়। মুঘল সম্রাট আকবরের রাজপুত তথা হিন্দুদের প্রতি যেমন তাঁর নমনীয়তা-শ্রদ্ধা তাঁকে সাম্রাজ্যের ভিত্তি ও সুদৃঢ়করণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল তেমনি তাঁর স্থাপত্য,সাহিত্য চিত্র শিল্পগুলি বর্ণে ও রেখায় ভাবে ও ব্যঞ্জনায় আবাল বৃদ্ধ বনিতার মন জয় করে নিয়েছিল যা তাঁর সাম্রাজ্যের নতুন দিগন্তের পথকে প্রসস্থ করেছিল।