একজন প্রাক্তন আর্জেন্টিনীয়-স্পেনীয় ফুটবলার এবং কোচ। তাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার গণ্য করা হয়। আলফ্রেদো দি স্টেফানো ১৯২৬ বুয়েনোস আইরেস নগরীর বারাকাসে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আলফ্রেদো দি স্তেফানো । তার দাদা মাইকেল ১৯ শতকে ইতালির নিকোলোসি থেকে আর্জেন্টিনার অভিবাসী হয়ে আসেন। তবে আর্জেন্টিনীয় হলেও তার মূল পরিচিতি স্পেনের ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড় হিসেবে। আলফ্রেদো দি স্টেফানো সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলতেন । ১৯৪৩ আর্জেন্টিনার রিভারপ্লেট ক্লাবে তার খেলোয়াড়ী জীবন শুরু হয়। পরবর্তী এক দশক তিনি আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়ার বিভিন্ন ক্লাবে খেলেন। ১৯৫৩ সালে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর ফেরেঙ্ক পুসকাসের সাথে তার ফরোয়ার্ড লাইনে অনবদ্য জুটি গড়ে উঠে, যা ক্লাবটিকে অনেক সাফল্য এনে দেয়।১৯৬৪ পর্যন্ত রিয়ালের হয়ে তিনি ২৮২টি ম্যাচ খেলে ২১৯টি গোল করেন, যা ক্লাবটির ইতিহাসে তাকে লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতায় পরিণত করে।
টুর্নামেন্ট জেতার জন্য একজন ফুটবলারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কোনটা? ভালো খেলার ক্ষমতা, ভালো সতীর্থ, ভালো কোচ এবং সবশেষে কিছুটা ভাগ্য। তবে সবার আগে যে জিনিসটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে সুযোগ। ‘সুযোগ পেয়েও ব্যর্থ আর সুযোগের অভাবে নিজেকে যাচাই করতে ব্যর্থ’– এই দুয়ের মাঝে অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে।‘সুযোগের অভাবে নিজেকে যাচাই করতে ব্যর্থ’– এমন ফুটবলারদের মাঝে সর্বপ্রথমেই আসবে খুব সম্ভবত জর্জ বেস্টের নাম। ভদ্রলোক এমন একটা জাতীয় দলের হয়ে খেলতেন যে দলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা তো দূরে থাক, বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়াটাও কল্পনা ছিল।
অবশ্য সুযোগ পেলেই সফল হবেন সেটাও বলা যায় না। অনেক গ্রেট খেলোয়াড় অনেক ভালো দল নিয়েও বিশ্বকাপের মতো আসরে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সবচেয়ে আদর্শ উদাহরণগুলোর মাঝে একজন সম্ভবত জিকো। ‘সাদা পেলে’ নামে পরিচিত ব্রাজিলের এই খেলোয়াড় ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দলগুলোর একটি নিয়েও শিরোপা জিততে পারেননি।
তবে ফুটবল ইতিহাসে এমনও কিছু খেলোয়াড় আছেন যাদেরকে বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, তিনি সুযোগ পেলে সফল হবার সম্ভাবনাই বেশি থাকতো। ঠিক এরকমই একজন খেলোয়াড় আলফ্রেডো ডি স্টেফানো।‘সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে – এই প্রশ্নে বেশিরভাগ মানুষই পেলে আর ম্যারাডোনায় বিভক্ত হয়ে যান। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে ফিফার বিচারকগণ গত শতাব্দীর সেরা যে খেলোয়াড়ের তালিকা করেছিলেন তাতে পেলের পরেই অবস্থান করেছিলেন ডি স্টেফানো।
শুধুমাত্র ক্লাব ফুটবল বিবেচনা করলে সম্ভবত সর্বকালের সেরা ফুটবলার হয়ে যেতেন ডি স্টেফানো। ক্যারিয়ারের শুরুতে আর্জেন্টিনা আর কলম্বিয়ার কিছু ক্লাবে খেলেছেন এবং সেখানে সফলতাও পেয়েছেন। তবে মূল সফলতা এসেছে স্পেনে আসার পর। স্পেনে অবশ্য তার খেলা নিয়ে কিছুটা জটিলতা ছিল। রিয়াল মাদ্রিদ তার তখনকার ক্লাব মিলোনারিওসের সাথে ট্রান্সফার ফির ব্যাপারে সম্মত হয়। এদিকে বসে থাকেনি মাদ্রিদের চিরশত্রু বার্সেলোনাও, তারাও চুক্তি করে স্টেফানোর সাবেক ক্লাব রিভার প্লেটের সাথে। ডি স্টেফানো তখন আইনত রিভার প্লেটের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। রিভার প্লেটের দাবি- ডি স্টেফানো তখনও তাদের খেলোয়াড়, কারণ কলম্বিয়াতে যাওয়ার পন্থা ছিলো অবৈধ। অবশেষে দুই ক্লাবের এই দ্বন্দ্ব গিয়ে গড়ায় আদালত এবং ফিফা পর্যন্ত। শেষে এই মর্মে রায় দেয়া হয় যে, ডি স্টেফানো এক বছর মাদ্রিদের হয়ে খেলবেন, আরেক বছর খেলবেন বার্সেলোনার হয়ে। ডি স্টেফানোকে প্রথম বছর খেলানোর সুযোগ পায় রিয়াল মাদ্রিদ এবং শুরুর দিকে মানিয়ে নিতে একটু সময় নিলে বার্সালোনার তৎকালীন ম্যানেজমেন্ট তাকে দায়মুক্তি দেয়, যেটির জন্য তারা আজও দুঃখ প্রকাশ করে। ফলে তিনি পুরোপুরি রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড় হয়ে যান।
৪ দিন পরেই তিনি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে বার্সেলোনার বিপক্ষে এক দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করে বসেন এবং সেটি ছিলো সবেমাত্র শুরু। মাত্র ৩০ ম্যাচে ২৭ গোল করে ১৯৫৩-৫৪ সিজনে রিয়াল মাদ্রিদকে ২১ বছর পর লিগ শিরোপা জেতান।
শুধু তা-ই নয়, এরপর ১৯৫৫, ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৩ এবং ১৯৬৮ সালেও লা লিগা জেতেন। সম্ভাব্য এগারোবারের মাঝে আটবারই লিগ শিরোপা জিতেন স্টেফানো। অথচ স্টেফানো মাদ্রিদে আসার আগপর্যন্ত ক্লাবের লিগ শিরোপা ছিল মাত্র ২টি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার ৯টি শিরোপা থেকে তো পেছনে ছিলই, অ্যাথলেটিকো বিলবাও (৫ বার), নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ (৪ বার) এবং ভ্যালেন্সিয়াও (৩ বার) তাদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। লিগ জয়ে অন্যদেরকে পেছনে ফেলার পাশাপাশি আরেকটি কীর্তি ফুটবল ইতিহাসে তাকে অমর করে রেখেছে।
ইউরোপের সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ ফুটবলের আসর ধরা হয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে। ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্টের প্রথম ৫টিতেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইউরোপের সেরা দল হবার পথে অনেকখানিই এগিয়ে যায় তারা। এই ট্রফিগুলো জেতার পেছনে স্টেফানোর ভূমিকা ছিল অসামান্য। প্রতিটি ফাইনালেই তিনি গোল করেছেন, সর্বশেষটাতে করেছেন হ্যাটট্রিক। এছাড়া ১৯৬২ আর ১৯৬৪ সালে রানার্স আপও হয়েছে। সম্ভাব্য ৯টি ফাইনালের মাঝে ৭টিতেই ফাইনাল খেলেছেন, যার মাঝে ৫টিতেই চ্যাম্পিয়ন; নিঃসন্দেহে অবিশ্বাস্য এক কীর্তি। এগুলো ছাড়াও ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জিতেছেন একবার, যা কি না বর্তমানে ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ নামে পরিচিত এবং সেই ফাইনালেও গোল করেছেন।
শুধুমাত্র ক্লাবের হয়ে এতগুলো কীর্তি অর্জনের সৌভাগ্য হয়তো আরো কিছু খেলোয়াড়ের রয়েছে, কিন্তু সুযোগের এতটা সদ্ব্যবহার কি অন্য কেউ এভাবে করতে পেরেছেন?
জাতীয় দলের হয়েও কিন্তু পরিসংখ্যানগতভাবে স্টেফানো ব্যর্থ নন। ৪১টি ম্যাচ খেলে ২৯টি গোল সেই সাক্ষ্যই দেয়। অবশ্য এই ৪১টি ম্যাচ তিনি খেলেছেন ৩টি জাতীয় দলের হয়ে; আর্জেন্টিনার হয়ে ৬টি, কলম্বিয়ার হয়ে ৪টি আর স্পেনের হয়ে ৩১টি। দুঃখ একটাই, এর কোনোটিই বিশ্বকাপের হয়ে নয়। ‘কখনোই বিশ্বকাপ খেলেননি’– এমন খেলোয়াড়দের মাঝে সর্বকালের সেরা ফুটবলার ধরা হয়ে থাকে স্টেফানোকেই।
অথচ তার সময়কালে বিশ্বকাপের আসর বসেছে ৪টি। একজন খেলোয়াড় যে সময়টাতে সবচাইতে বেশি ফর্মে থাকেন, সেই সময়েই আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ বর্জন করে। অথচ ১৯৫০ আর ১৯৫৪ সালের সেই বিশ্বকাপ দুটোতে স্টেফানোর বয়স ছিল যথাক্রমে ২৪ আর ২৮ বছর। পরবর্তীতে স্পেনের হয়ে খেলায় ১৯৫৮ আর ১৯৬২ বিশ্বকাপে খেলার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ১৯৫৮ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব পেরোতেই ব্যর্থ হয় স্পেন। ৪টি ম্যাচ খেলে স্টেফানো ২টি গোল করলেও সেটা যথেষ্ট ছিল না বাছাইপর্ব পেরোনোর জন্য। পরের বিশ্বকাপে স্পেন সুযোগ পেলেও স্টেফানো বাদ পড়েন ইনজুরির জন্য।
‘স্টেফানো বিশ্বকাপ মিস করেছেন নাকি বিশ্বকাপই স্টেফানোকে’– ফুটবলপ্রেমীদের সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আর আর সম্ভব না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সুযোগ পেলেই কি স্টেফানো বিশ্বকাপে সফল হতেন? জিকোর মতো গ্রেট খেলোয়াড়ও কিন্তু গ্রেট দল নিয়ে বিশ্বকাপে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সত্যি কথা হচ্ছে, এর সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। তবে স্টেফানোর ক্যারিয়ার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- সুযোগ পেলে তার সফল হবার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। সেই প্রমাণ তিনি দেখিয়েছিলেন ১৯৪৭ সালের কোপা আমেরিকাতে।
ক্লাব ফুটবলে শিরোপা জয়ের সুযোগ সবসময়ই বেশি থাকে আন্তর্জাতিক ফুটবলের তুলনায়। কারণ প্রতি মৌসুমেই ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ ৬টি ট্রফি জেতার সুযোগ থাকলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলের মর্যাদাসম্পন্ন শিরোপা জেতার সুযোগ থাকে হয়তো দুই বছরে একটি। এজন্য প্রত্যেক ফুটবলারের মনেই আকাঙ্ক্ষা থাকে দেশের হয়ে শিরোপাজয়ী দলের সদস্য হবার। তবে শুধু শিরোপা জয় করলেই সবাইকে সমানভাবে সফল বলা যায় না। শিরোপা জয়ের পাশাপাশি নিজেকেও পারফর্ম করতে হয়। অনেক খেলোয়াড় আবার নিজে পারফর্ম করেও দলীয় ব্যর্থতায় শিরোপা বঞ্চিত থাকতে পারেন। একজন খেলোয়াড় সর্বোচ্চ সফলতা তখনই পান যখন তিনি নিজে ভালো খেলার পাশাপাশি শিরোপাও জিততে পারেন। সেই কাজটিই করেছিলেন স্টেফানো।
কোপা আমেরিকার সেই টুর্নামেন্টের ফরম্যাট ছিল লিগভিত্তিক। ৮টি দলের প্রত্যেকেই একবার করে মুখোমুখি হবে এবং সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া দল চ্যাম্পিয়ন হবে। টুর্নামেন্টে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে স্টেফানো সুযোগ পাননি। তবে বাকি ৬ ম্যাচেই সুযোগ পান। বলিভিয়ার বিপক্ষে ৭-০ গোলে জয় পাওয়া ম্যাচে নিজের প্রথম গোল করেন। পেরুর বিপক্ষে পরের ম্যাচে ৩-২ গোলে জয় পেলে সেটাতেও স্টেফানো একটি গোল করেন। চিলির বিপক্ষে ম্যাচে তার করা একমাত্র গোলেই ১-১ গোলের ড্র করে আর্জেন্টিনা। কলম্বিয়ার বিপক্ষে তো হ্যাটট্রিকই করে ফেলেন।
এরপরের দুই ম্যাচে অবশ্য আর গোল পাননি। আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হবার পাশাপাশি ৬ গোল করে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হন স্টেফানো। ক্যারিয়ারে একটিমাত্র আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন স্টেফানো। মাত্র ২১ বছরে পাওয়া সেই সুযোগ বেশ সুন্দরভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বকাপে সুযোগ পেলে হয়তো বা পেলে-ম্যারডোনাকেও ছাপিয়ে যেতে পারতেন। এখন তাকে ‘বিশ্বকাপ না খেলা খেলোয়াড়দের মাঝে সর্বকালের সেরা’ স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইতিহাস ঘাটলে বোঝা যায়- স্বীকৃতিটি যথার্থই ছিল।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া, ইতিবৃত্ত, প্রথমআলো, সারাবাংলা