বই : বেলা ফুরাবার আগে
লেখক : আরিফ আজাদ
.
রাসুলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পাঁচটি বিষয়ের মুখোমুখি হওয়ার পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে মূল্যায়ন করো; বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকে, অসুস্থতার পূর্বে তোমার সুস্থতাকে, দারিদ্রের পূর্বে তোমার ধনবত্তাকে, ব্যস্ততার পূর্বে তোমার অবসরকে এবং মরণের পূর্বে তোমার জীবনকে।‘ -সহিহ আল-জামি, হাদিস নং : ১০৭৭
উপরোক্ত হাদিস থেকেই বইয়ের নামকরণের যথার্থতা উপলব্ধি করা যায়।
____///
বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য :
‘আঁধারে কি পথ চলা যায়? অন্ধকারে কি সুখ পাওয়া যায়? তাহলে তুমি কেন আঁধারে থাকবে? কেনইবা নিজ ভবিষ্যৎ অন্ধকারে রাখবে? বেলা ফুরাবার আগেই বদলে নাও জীবন। সময় থাকতে নিজেকে আল্লাহর রঙে রাঙিয়ে নাও। জীবন-সূর্য অস্ত যাবার আগেই অন্ধকার কবর জগতের জন্য আলোর মশাল প্রস্তুত করে রাখো। হিসাব গ্রহণের দিন উপস্থিত হবার আগে নিজের হিসাব নিজেই চুকিয়ে নাও।’
শুরুর আগে:
‘শুরুর আগে’ শিরোনামে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাবসানের ঘটনা আলোচনার মধ্য দিয়ে বইটির অবতারণা। ছোট্ট একটি নাসিহা, একটি রিমাইন্ডার, একটি উপদেশ যে আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম—সেটা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই গল্পে। আর বোঝানো হয়েছে, বইটির ছোট্ট একটি কথা কিংবা ছোট্ট একটি উপদেশ হতে পারে আমাদের জীবন পরিবর্তনের অসিলা; জাহিলিয়াতের কালো আঁধার ভেদ করে আমার-আপনার জীবনেও উদিত হতে পারে নয়া সুবহে সাদিক, অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকার মুছে জন্ম নিতে পারে শুভ্র সফেদ প্রভাত।
মন খারাপের দিনে
‘মন খারাপের দিনে’ অধ্যায়টা মন ছুঁয়েছে। কুরআন যে একজন আশাহত, নিশ্চল মানুষের মনে আশার আলো জাগায়, সেটা খুব চমৎকারভাবে ফুটে ওঠেছে এখানে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে- Turn your worry into worship ‘তোমার দুশ্চিন্তাগুলোকে ইবাদতে পরিণত করো’। আসলেই তাই। জীবনের দুঃখ-কষ্টগুলোকে চাইলেই আমরা ইবাদতের রূপ দিতে পারি। বিপদের সময়টাতে মানুষের মন ভাঙা থাকে। দু’হাত তুলতেই টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। দৃশ্যটা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। তিনি তখন পরম মমতায় বান্দাকে তাঁর কাছে টেনে নেন।
জীবনের ইঁদুর-দৌড় কাহিনী
‘জীবনের ইঁদুর-দৌড় কাহিনী’ অধ্যায়টা ইঁদুর দিয়ে শুরু হলেও শেষটা ছিল ইঁদুর-দৌড়ের মতোই দুর্দান্ত, গতিময়।
বলো, সুখ কোথা পাই
কর্পোরেট দুনিয়ায় যারা সুখে আছে, আর যারা তাদের মতন সুখী হতে চায়- উভয়কে নিয়েই ‘বলো, সুখ কোথা পাই’ গল্পটির অবতারণা। নীল দুনিয়ায় সুখের আড়ালে নরক-বাসের পর্দা পুরোপুরি উম্মোচন করে দিয়েছে এই গল্প। এ প্রসঙ্গে আমার ছোট্ট একটি কথা যোগ করতে চাই- ‘অভিনেত্রীদের মনের দাগ যদি ভেসে ওঠতো তাদের চেহারায়, কেউ তাদের মুভি দেখতো না’।
‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা
শিরোনাম পড়ে প্রথমে বুঝতেই পারিনি ‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা’ অধ্যায়টা আসলে কী নিয়ে? যুদ্ধটা কার সাথে কার? যে শত্রু আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে, গল্পটা মূলত তাকে নিয়েই। সেই আদিকাল থেকে বংশ পরম্পরায় যার সাথে আমরা ‘শত্রু শত্রু’ খেলায় মত্ত, সে হচ্ছে এই গল্পের ভিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এই শত্রুতা মহান আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত। স্বয়ং তিনিই এই শত্রুতা পোষণের আদেশদাতা!
চোখের রোগ
চোখের রোগ দু-ধরনের : একটা বাহ্যিক, অপরটা অভ্যন্তরীণ। প্রথমটা নিয়েই আমাদের যত মাতামাতি, যতরকম টেস্ট, যত বাহারি ডিজাইনের চশমার ব্যবহার। দ্বিতীয়টা সম্পর্কে আমরা একেবারেই বেখবর! অথচ প্রথমটার চেয়ে দ্বিতীয়টা গুরুতর। একটাতে আমাদের পার্থিব দৃষ্টিশক্তি হারানোর সম্ভাবনা, আর অপরটাতে পরকালীন দুর্ভাগ্যের হাতছানি!
আমরা বাহ্যিকটার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হই, অভ্যন্তরীণটার জন্য চিকিৎসকের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করি না! এই নিয়ে আমাদের নির্বিকার অবস্থানের ব্যাপারটা ‘চোখের রোগ’ অধ্যায়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমরা তো স্রেফ বন্ধু
‘আমরা তো স্রেফ বন্ধু’ অধ্যায়টি পড়ে জানতে পারি, ইসলামের ডিকশনারীতে ‘জাস্টফ্রেন্ড’ বলে কোনো শব্দ নেই। যারা মনে করে, বান্ধবী থাকাতে সমস্যা কোথায়, মন পবিত্র থাকলেই তো হল, তারা আদতে ‘রাবণের লঙ্কাযাত্রা’য় আছে।
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়
প্রতিটি মানুষের দুটো জীবন। একটা মৃত্যুর আগে অপরটা মৃত্যুর পরে। মৃত্যুর পরের জীবনের সুখ-দুঃখ নির্ভর করে মৃত্যুর আগের জীবনের ওপর। পৃথিবীতে আমরা যে যা রেখে যাব, তা-ই পাব। সেটা আশির্বাদ হোক কিংবা অভিশাপ। ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়’ গল্পটা পড়ে এমনটাই মনে হল।
আমি হবো সকাল বেলার পাখি
নজরুলের ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি’ কবিতার শিরোনাম পড়ে শৈশবে হারিয়ে গেলাম। দাদার হাত ধরে মসজিদে যাওয়া, কায়দা-আমপারা হাতে সকাল সকাল মক্তবে হাজিরা দেওয়া, ঈদের সকালে দলবেঁধে ঈদগাহে যাওয়া—সব যেন চোখের সামনে অবলীলায় ভেসে উঠল। কবিতার পরের লাইন—‘সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি’—বুঝতে পারলেও ‘সূয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জাগি’ কথাটা তখনও বুঝতে পারিনি। সূয্যি মামা জেগে ওঠার আগের সময়টাই তো ‘সুবহে সাদিক’। নজরুল এখানে ফজরের নামাজে জাগার কথা বলেছেন। বাহ! শ্রদ্ধা প্রিয় কবি, সেই সাথে শ্রদ্ধা লেখককেও।
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ অধ্যায়ের শিরোনাম পড়ে ছোটবেলায় পড়া রবীন্দ্রনাথের কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল সতেন্দ্রনাথ দত্তের সেই বিখ্যাত পঙক্তিটাও—‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে, হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে।‘ পুরো গল্পটা পড়ে অবচেতনে করুনাময়ের কাছে প্রার্থনা করে উঠি—‘হৃদয়ের আকাশ হতে গুনাহের মেঘ দাও সরিয়ে, পুণ্যের তারায় তারায় আমার আকাশটা দাও ভরিয়ে।‘