বক্স অফিসে শাহরুখ খানের ‘জওয়ান’ সুনামির তাণ্ডব চলছে। বড় পর্দায় বলিউড বাদশাহ এন্ট্রি নিতেই গোটা সিনেমা হল ফেটে পড়ছে হাততালি আর সিটিতে। এই বয়সে রুপালি পর্দায় শাহরুখ খানকে ‘জওয়ান’ করে তোলার কাজটি যিনি করেছেন, তাঁর প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ এখন সবাই।
কথা হচ্ছে ‘জওয়ান’ সিনেমার পরিচালক অ্যাটলি কুমারকে নিয়ে। একসময় গায়ের কালো রঙের জন্য বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন আজকের এই তারকা। একাধিক সুপারহিট দক্ষিণি সিনেমায় কাজ করলেও অ্যাটলির স্বপ্ন ছিল শাহরুখ খানের সঙ্গে কাজ করা। তাই ‘জওয়ান’ ছিল তাঁর ড্রিম প্রজেক্ট। এই সিনেমার শুটিংয়ের সময়ই বাবা হয়েছেন অ্যাটলি। জীবনের সেই খুশির মুহূর্তে শাহরুখ খান তাঁকে যেতে বললেও ছুটি নেননি সেদিনের সেই বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়া ছেলেটা।
অ্যাটলি কুমারের সঙ্গে নেটিজেনদের প্রথম পরিচয় তাঁর কাজের সূত্রে নয়। তিনি যখন প্রথমবার তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ছবি শেয়ার করেছিলেন, তখন সমাজের নোংরা মানসিকতার প্রমাণ পেয়েছিলেন। তাঁর বান্ধবী তথা স্ত্রীর গায়ের রং ছিল ফরসা। কালো ছেলের পাশে ধবধবে ফরসা মেয়েকে দেখে সেদিন ট্রল করেছিল ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের নেটিজেনরাও।
অ্যাটলি ও তাঁর স্ত্রীর ছবি প্রকাশ্যে আসতেই অনেক কঠিন মন্তব্য ধেয়ে এসেছিল তাদের উদ্দেশ্য করে। কেউ বলেছিলেন, এই মেয়েটি শুধু টাকার লোভেই এমন কালো ছেলেকে বিয়ে করেছে! কেউ বলেছিলেন, ছেলেটি নাকি কালো জাদু করে এমন সুন্দরী মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়েছে! এ ছাড়া আরও কত কী।
দুটো মানুষের গায়ের রং, রূপের বিচারের ঊর্ধ্বে উঠে যে শুধু একে অপরকে ভালোবেসেও এক হতে পারেন—এই ধারণা কারও মাথায়ই আসেনি সেদিন। তবে তাঁরা মুখ বুজে সহ্য করেছিলেন সবকিছু।
অ্যাটলি যখন তাঁর বান্ধবী কৃষ্ণপ্রিয়াকে বিয়ে করেন, তখন দুজনেই ইন্ডাস্ট্রিতে সংগ্রাম করছিলেন। অ্যাটলি তখন গল্প আর চিত্রনাট্য নিয়ে প্রযোজকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। অন্যদিকে কৃষ্ণাপ্রিয়া তামিল ইন্ডাস্ট্রির ধারাবাহিকে অডিশন দিতেন।
শুধু সেবারই শেষ নয়। ২০১৯ সালের এপ্রিলে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ দেখতে চেন্নাইয়ে গিয়েছিলেন বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান। সেদিন কলকাতা নাইট রাইডার্সের এই ম্যাচে গ্যালারিতে শাহরুখের সঙ্গে ছিলেন অ্যাটলি কুমার। শাহরুখের সঙ্গে অ্যাটলির গ্যালারির একটি ছবি নিয়ে অনেক ট্রল হয়েছিল তখন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে স্ত্রী কৃষ্ণা প্রিয়ার সঙ্গে ছবি শেয়ারের পর ট্রল করা হয়েছিল অ্যাটলিকে।
অ্যাটলি কোনো দিন এগুলো নিয়ে উত্তর দেননি। একাধিকবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তিনি তাঁর কাজটি করতে চান, এগুলো নিয়ে ভাবেন না। সেই অ্যাটলি কাজের মাধ্যমে বারবার নিয়েছেন মধুর প্রতিশোধ। সর্বশেষ তাঁর নির্মিত ‘জওয়ান’ সমালোচকদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে।
অ্যাটলি কুমারের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল দক্ষিণের বিখ্যাত পরিচালক শংকরের সহকারী পরিচালক হিসেবে। প্রায় পাঁচ বছর সহযোগী পরিচালক থেকে সহকারী, এবং সর্বশেষ প্রধান সহকারী হিসেবে পরিচালক শংকরের আস্থা অর্জন করেছিলেন অ্যাটলি।
২০১৩ সালে আর্য এবং নয়নতারা অভিনীত রোমান্টিক ড্রামা ফিল্ম ‘রাজা রানী’র মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয় অ্যাটলির। সিনেমাটির মাধ্যমে সেরা নবাগত পরিচালকের পুরস্কার ‘বিজয় অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছিলেন তিনি।
এরপর একে একে তিনি নির্মাণ করেন ‘থেরি’, বিগিল’, ‘মেরসাল’-এর মতো দক্ষিণের ব্যবসাসফল সিনেমা। তাঁর সর্বশেষ নির্মিত শাহরুখ খান অভিনীত ‘জওয়ান’ তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
২০১০ সালে মুম্বাইয়ে শাহরুখের মান্নাতের গেটে ছবি তুলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাটলির জন্য ঠিক ১০ বছর পর মান্নাতের গেট খুলে গিয়েছিল। ‘জওয়ান’-এর চিত্রনাট্য নিয়ে মান্নাতে প্রবেশ অ্যাটলির ক্যারিয়ারে নতুন মাইলফলক যুক্ত করে। বলিউড বাদশাহর কাছে অনেক অফার ছিল, এর পরও তরুণ অ্যাটলির চিত্রনাট্যে বিশ্বাস রেখেছিলেন শাহরুখ।
অ্যাটলির হয়ে ট্রলের জবাব দিয়েছে সময়। অ্যাটলি প্রমাণ করেছেন, গায়ের রং কারও যোগ্যতা হতে পারে না। একজন ব্যক্তিকে যে তার বর্ণ ও ধর্মের ভিত্তিতে বিচার করা উচিত নয়, তারই প্রমাণ অ্যাটলি। ব্যক্তিকে শুধু তার ভালো-মন্দ কাজের ভিত্তিতে বিচার করা উচিত। অ্যাটলি বর্তমানে শুধু ভারতের জনপ্রিয় তরুণ নির্মাতাদের একজন নন, এমন সাফল্যে অনেক তরুণকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন।