বাঙালির জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া স্বাধীনতা। বাংলাদেশ নামে এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক নিবিড়। মুক্তিযুদ্ধে লাখো প্রাণ বিসর্জনের অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ ও লালনের স্বাধীনতা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক ভয়ংকর বর্বরতার মধ্য দিয়ে বিজয়গাথা এক মহাকাব্য। বাংলাদেশের এই মহাকাব্যিক ইতিহাস বিভিন্ন সময়ে ধরা দিয়েছে রুপালি পর্দায়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু চলচ্চিত্র। মুক্তির লড়াই নিয়ে নির্মিত কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়েই আজকের এ আয়োজন—
ওরা ১১ জন
মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’। প্রয়াত নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত চলচ্চিত্রটি ১৯৭২ সালে নির্মাণ করা হয়। এই চলচ্চিত্রের বিশেষত্ব হলো, এই চলচ্চিত্রের প্রধান ১১ জন অভিনেতার ১০ জনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন খসরু, মুরাদ, হেলাল ও নান্টু। এতে আরও অভিনয় করেছেন নায়করাজ রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, সৈয়দ হাসান ইমাম, এটিএম শামসুজ্জামান ও খলিলউল্লাহ খান প্রমুখ। চলচ্চিত্রটি ১৯৭২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। চলচ্চিত্রটির প্রযোজক ছিলেন অভিনেতা মাসুদ পারভেজ, যিনি সবার কাছে সোহেল রানা নামে পরিচিত।
আবার তোরা মানুষ হ
সিনেমাটিতে যুদ্ধ-পরবর্তী একটি দেশের সামাজিক পরিবেশ ও বিশৃঙ্খলার চিত্র উঠে এসেছে। যুদ্ধে অংশ নেওয়া একদল তরুণ কলেজছাত্র যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশ থেকে অন্যায় ও অপকর্ম নির্মূলের লড়াই অব্যাহত রাখে। ১৯৭৩ সালে নির্মিত ছবিটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশের আরেক বিখ্যাত পরিচালক প্রয়াত খান আতাউর রহমান। সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন চিত্রনায়ক ফারুক, অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ, চিত্রনায়িকা ববিতা, অভিনেত্রী রোজী আফসারী ও রওশন জামিলসহ অনেকে।
আগুনের পরশমণি
বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখা উপন্যাস ‘আগুনের পরশমণি’র গল্পের ওপর ভিত্তি করে একই নামে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পটভূমির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারি কর্মকর্তা মতিন সাহেবের অবরুদ্ধে পরিবারে বদি নামের একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নেন। আশ্রয় নেওয়ার পর যুদ্ধকালীন বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে গল্প এগিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে গুণী অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রটি তখন আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিল। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর ও বিপাশা হায়াত।
হাঙর নদী গ্রেনেড
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের প্রকাশিত উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ অবলম্বনে ১৯৯৭ সালে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। যশোরের এক মায়ের আত্মত্যাগের সত্য ঘটনা অবলম্বনে উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল। উপন্যাসটির প্রশংসা এবং এটি নিয়ে সিনেমা বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে সেলিনা হোসেনকে চিঠি লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। একজন মা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তাঁর নিজের সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিসর্জন দেন। মায়ের ভূমিকায় অভিনেত্রী সুচরিতা অনবদ্য অভিনয় করেন এবং চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের মতে, এটাই সুচরিতার জীবনের সেরা ছবি। সিনেমাটিতে অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেন সোহেল রানা, শর্মিলী আহমেদ, দোদুল, অন্তরা ও মিজু আহমেদ। ছবিটি সে বছর তিনটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে চাষী নজরুল ইসলাম, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী সুচরিতা ও শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হিসেবে সেলিনা হোসেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
শ্যামল ছায়া
শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হলেও এই চলচ্চিত্রে সরাসরি যুদ্ধের দৃশ্য না দেখিয়েও যুদ্ধের আবহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সারা দেশে যখন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, তখন অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকে। এমনই একদল জীবন বাঁচানোর জন্য পালাতে থাকা ও নিরাপদ আশ্রয় সন্ধানীর কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি। ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন প্রয়াত সাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। ছবিতে অভিনয় করেছেন হুমায়ুন ফরিদী, মেহের আফরোজ শাওন, শিমুল, দিয়াজ, স্বাধীন খসরু, সৈয়দ আখতার আলী, ফারুক আহমেদ, শায়েস্তা নাজনীনসহ আরও অনেকে। সিনেমাটি ২০০৬ সালে ‘সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের (অস্কার) জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।