বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের শততম জন্মবার্ষিকী আজ। এই এক শ বছরেও সত্যজিৎ রায়ের চিত্র ভাবনাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার মতো কেউ আসেননি বাংলা সিনেমায়। কিংবদন্তি এই নির্মাতা বাংলা চলচ্চিত্র তো বটেই পুরো ভারতীয় সিনেমার প্রেক্ষাপটকেই বদলে দিয়েছিলেন। সাদা-কালোর শিল্পিত ফ্রেমে বাংলা সিনেমার নতুন প্রেক্ষাপট রচিত করেছিলেন সত্যজিৎ। চলচ্চিত্র নির্মাতার পাশাপাশি, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সংগীত পরিচালক, লেখক, গ্রাফিকস ডিজাইনার হিসেবেও তিনি সমাদৃত।
১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্ম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের। সাহিত্য জগতে খ্যাতনামা পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা খ্যাতিমান শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়। আর দাদা ছিলেন সে যুগের প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সত্যজিৎ রায়ের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের শুরুটা ১৯৪৩ সালে, বিজ্ঞাপন ও প্রকাশনার জগতে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে। সে সময় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পথের পাঁচালী’র ছোটদের সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে ‘পথের পাঁচালী’কে চিত্রায়িত করার ভাবনা মাথায় আসে তাঁর। এর পরের গল্পটা সবারই জানা। শততম জন্মবার্ষিকীতে চলুন এই প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তিত্বের সেরা পাঁচটি সিনেমা সম্পর্কে জেনে নেই।
পথের পাঁচালী
ভারতের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা ছবি সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৫৫ সালে তৈরি ‘পথের পাঁচালী’ সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। শুধু ভারতেই নয়, গোটা বিশ্বে পরিচিত ও সমাদৃত ছবিটি। মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে ‘পথের পাঁচালী’। চিরায়ত বাংলার আনন্দ-বেদনার আখ্যান সত্যজিৎ সেলুলয়েডে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ছবিতে অপু ও দুর্গার বাবা নিশ্চিন্তপুরের পুরোহিত হরিহর রায় পরিবার রেখে শহরে যান উন্নত জীবনের আশায়। এদিকে গ্রামে অপু-দুর্গার শৈশব কাটে অভাব-অনটনে। অপু-দুর্গার দুরন্ত শৈশব ও সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার রূঢ়-কঠিন চিত্র নিয়ে নির্মিত পথের পাঁচালী। ছবিতে নামী কোনো তারকা না থাকলেও সবার দুর্দান্ত অভিনয় সমালোচক ও দর্শকদের প্রশংসা কুড়ায়।
অপরাজিত
‘অপরাজিত’ অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। ‘পথের পাঁচালী’র তুমুল জনপ্রিয়তার পর অপু চরিত্রটি নিয়ে আরও কাজ করার কথা ভাবেন সত্যজিৎ। তারই পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত হয়েছে ‘অপরাজিত’। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের শেষ অংশ এবং ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের শুরুর এক-তৃতীয়াংশের গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘অপরাজিত’ সিনেমাটি। ১৯৫৬ সালে নির্মিত ছবিতে অপুর শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ এবং কলকাতায় কলেজে পড়ার সময়কার গল্প তুলে ধরা হয়েছে। ভারতে সিনেমাটি ‘পথের পাঁচালীর’ মতো জনপ্রিয়তা না পেলেও, দেশের বাইরে ভূয়সী প্রশংসা পায়।
অপুর সংসার
১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় অপু ট্রিলজির শেষ সিনেমা ‘অপুর সংসার’। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই ছবি দিয়েই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং শর্মিলা ঠাকুর প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন। অপু-অপর্ণার চরিত্রে সৌমিত্র-শর্মিলার পর্দার মিষ্টি রসায়ন মন কেড়ে নেয় দর্শকের। সিগারেটের প্যাকেটে অপর্ণার লেখা ‘খাওয়ার পরে, একটা করে-কথা দিয়েছ’ কিংবা আরেকটু বেশি সময় অপুকে পাশে পাওয়ার জন্য টিউশনি ছেড়ে দিতে বলার দৃশ্যগুলো এখনো ঘোরলাগা মুগ্ধতা তৈরি করে।
নায়ক
সিনেমা নির্মাণে শুরুর দিকে সত্যজিৎ বেছে নিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসকে। তবে ১৯৬৬ সালে মুক্তি পাওয়া তুমুল দর্শকপ্রিয় ‘নায়ক’ সিনেমার রচয়িতা সত্যজিৎ নিজেই। এ সিনেমার কাহিনির পাশাপাশি চিত্রনাট্যও সত্যজিৎ রচনা করেছিলেন। ‘নায়ক’ সিনেমায় একজন সুপারস্টারের গল্প বলা হয়েছে। একটি ক্যানভাসে যেন সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেই নায়কের জীবনের বিভিন্ন চিত্র। দেখানো হয়েছে, খ্যাতি কীভাবে একজন নায়ককে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সত্যজিৎ পুত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা সন্দীপ রায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাবা উত্তম কুমারকে মাথায় রেখেই “নায়ক” লেখেন। অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট। কোনো গল্প থেকে নেওয়া নয়।’ কালজয়ী এই সিনেমাটি ১৯৬৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
হীরক রাজার দেশে
১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমাটি রাজনৈতিক রূপকধর্মী চলচ্চিত্র। এর কাহিনি, সংলাপ, মঞ্চসজ্জা, পরিচালনা—সবই করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। রূপকের আশ্রয় নিয়ে চলচ্চিত্রটিতে সামাজিক বৈষম্য কিছু সত্য চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি গুপী-বাঘা সিরিজের একটি চলচ্চিত্র। ছবিটির ব্যতিক্রমী দিক হচ্ছে মূল শিল্পীদের প্রায় সংলাপ ছড়ার আকারে করা। যেমন, ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান’ কিংবা ‘বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না’। ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমায় যেভাবে শাসক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব চিত্রায়ণ করেছেন সত্যজিৎ, তা সময়ের বিবর্তনে, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনেও একইভাবে প্রাসঙ্গিক এবং সমসাময়িক।