‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলায় নেব সখী তোমার কানের সোনা; সখী গো আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি, তোমার কাছে পয়সা নেব না’।
পর্দায় সুজন ও সখীর ঠোঁট মেলানো এই গান ছিল ‘সুজন সখী’ ছবির। গত শতকের সত্তরের দশকের ব্যবসাসফল এই ছবিতে সুজন চরিত্রে নায়ক ফারুক ও সখী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নায়িকা কবরী। প্রায় দুই বছর আগে কবরী পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। আর গতকাল সোমবার পাড়ি জমালেন সুজন চরিত্র করা ফারুক।
নায়ক ফারুক সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ১০টার দিকে মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। চলচ্চিত্রের ‘মিয়াভাই’ খ্যাত এই চিত্রনায়কের আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ঢাকা-১৭ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। উচ্চরক্তচাপ, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের নানা সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তাঁর মৃত্যুতে রাজনীতি, চলচ্চিত্র অঙ্গনসহ সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
ফারুকের জন্ম মানিকগঞ্জে, ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। তরুণ বয়স থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন এবং এ সময় তাঁর নামে প্রায় ৩৬টি মামলা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
জীবদ্দশায় ফারুক জানিয়েছিলেন, ছয় দফা আন্দোলনের পর পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচতে বন্ধুদের পরামর্শে সিনেমায় কাজ শুরু করেন। ১৯৭১ সালে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’তে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক। ওই ছবির নায়িকা ছিলেন কবরী। এরপর ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ সিনেমায় অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে ফারুক অভিনীত ‘সুজন সখী’ ও ‘লাঠিয়াল’ ব্যাপক আলোচিত ও ব্যবসাসফল হয়।
‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য সেরা পার্শ্ব অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে শহীদুল্লা কায়সার রচিত কালজয়ী উপন্যাস ‘সারেং বৌ’ অবলম্বনে নির্মিত আবদুল্লাহ আল-মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ও আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমায় ফারুকের অভিনয় প্রশংসিত হয়। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি সিনেমা হলো ‘নয়নমনি’, ‘নাগরদোলা’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘কথা দিলাম’, ‘ঝিনুক মালা’, ‘মাটির পুতুল’, ‘সাহেব’, ‘ছোট মা’, ‘এতিম’, ‘ঘরজামাই’ ইত্যাদি। ১৯৮৭ সালে ‘মিয়া ভাই’ সিনেমায় অভিনয় করে মিয়াভাই পরিচিতি লাভ করেন তিনি।
বেশ কিছু সিনেমা প্রযোজনাও করেছেন ফারুক। পেয়েছেন বহু সম্মাননা। ২০১৬ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘আজীবন সম্মাননা’ দেওয়া হয়েছে তাঁকে।
পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে ফারুক ছিলেন সবার ছোট। তাঁর স্ত্রী ফারজানা পাঠান। তাঁদের দুই সন্তান। মেয়ে ফারিহা তাবাসসুম পাঠান ও ছেলে রওশন হোসেন পাঠান শরৎ। চলচ্চিত্রের বাইরে ফারুক ছিলেন ব্যবসায়ী। গাজীপুরে অবস্থিত ‘ফারুক নিটিং ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি।
২০১২ সালের জুলাইয়ে নায়ক ফারুক এক মাস ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসা শেষে ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি দেশে ফেরেন। ২০২১ সালের মার্চে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে আবার মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।
ফারুকের ভাতিজি আসমা পাঠান রুম্পা জানান, আজ মঙ্গলবার সকালে ৭টা ৫০ মিনিটে ফারুকের মরদেহ ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। বিমানবন্দর থেকে মরদেহ নেওয়া হবে ফারুকের উত্তরার বাসায়। বেলা ১১টায় শ্রদ্ধা জানাতে নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে গার্ড অব অনার দেওয়ার কথা। দুপুর সাড়ে ১২টায় মরদেহ নেওয়া হবে বিএফডিসিতে। সেখানে জানাজার পর নিয়ে যাওয়া হবে গুলশানের আজাদ মসজিদে। বাদ আসর সেখানে জানাজা শেষে মরদেহ নেওয়া হবে গাজীপুরের কালীগঞ্জে। ফারুকের ইচ্ছা অনুসারে কালীগঞ্জের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে তাঁকে।
সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ ছাড়া শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, প্রযোজক সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতিসহ (বাচসাস) চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো।