সুমনের গান উসকে দিল অনেক স্মৃতি
বিনোদন

সুমনের গান উসকে দিল অনেক স্মৃতি

কবীর সুমনের কণ্ঠ যেন অডিটোরিয়াম ভর্তি দর্শকদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আলতো করে। পরম নির্ভরতার ছোঁয়া পেয়ে উথলে উঠল শত অশান্ত মন। যেন এতদিন এত কোমলভাবে আদর করেনি কেউ, শুনতে চায়নি ভেতরের হাহাকার। সবার ভেতরের জমাট দুঃখ-শোক তাই পেল ছুটি। শত কণ্ঠ যোগ দিল কোরাসে।

সে কণ্ঠ, সে সুর, সে গান প্রতিধ্বনির পাখায় চেপে ছড়িয়ে গেল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের আকাশে-বাতাসে। কীভাবে সুমন উত্তাল করে দেন ভেতরের শান্ত নদী? কোন মন্ত্রে তাতে জাগে এমন ঢেউ? হাজারো প্রশ্ন আর বিস্ময় উসকে দিয়ে মঞ্চে বসে আছেন স্বয়ং সুমন! গাইছেন, কথা বলছেন, হাসছেন, হাসাচ্ছেন।

কবীর সুমনকে একনজর দেখার জন্য, তাঁর গান শোনার জন্য ১৫ অক্টোবর দিনভর ছিল অপেক্ষার উত্তেজনা। বিকেল ৪টায় গেট খোলা হবে জেনেও দুপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জড়ো হচ্ছিলেন সুমনভক্তরা। গুমোট আবহাওয়ার অস্বস্তি পাশ কাটিয়ে, এঁকেবেঁকে চলা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে, তাঁরা ধীর পায়ে প্রবেশ করছিলেন অডিটোরিয়ামে। অনেক অপেক্ষার শেষে সন্ধ্যা ৬টার খানিক আগে মঞ্চে এলেন কবীর সুমন। করজোড়ে প্রণাম করলেন উপস্থিত দর্শকদের। অডিটোরিয়ামের কোণে কোণে পৌঁছে দিলেন উড়ন্ত চুমুর আশীর্বাদ।

মঞ্চে কবীর সুমন। ছবি: সাজ্জাদ হোসেন গোটা মিলনায়তন তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। বিস্ফারিত চোখে দেখছে গানওয়ালাকে। শত করতালির শব্দে মুখর। সবুজাভ ফতুয়া আর ধুতি পরিহিত ৭৩ বছর বয়সী মানুষটা এত দর্শকের উপস্থিতি দেখে কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়লেন। মাইক্রোফোনের সামনে ঈষৎ ঝুঁকে করলেন কৃতজ্ঞতার উচ্চারণ, ‘আমি ভারতের নাগরিক, আমার মাতৃভাষা বাংলা। সে ভাষাটি এ দেশের রাষ্ট্রভাষা। এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে!’

শনিবার সন্ধ্যায় কবীর সুমনের গান যাঁরা শুনতে এসেছিলেন, তাঁরা বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। যাঁদের জন্ম নব্বইয়ের দশকের আশপাশে। সুমনের ‘তোমাকে চাই’ ততদিনে বেরিয়ে গেছে, ধীর পায়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রামে, পাড়া থেকে গলিতে। ততদিনে এসব দর্শকের অনেকের জন্মই হয়নি। তবুও দিনে দিনে সুমনের গানের সঙ্গে তাঁরা বেঁধে নিয়েছেন প্রাণ। তাঁর গানে খুঁজে পেয়েছেন বেঁচে থাকার প্রেরণা, স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন নতুনভাবে। গানওয়ালাকে দেখার তৃষ্ণা তাই সবার চোখেই।

এর আগে সুমন যতবার ঢাকায় গাইতে এসেছেন, প্রতিবারই প্রতি অনুষ্ঠানে ছুটে গেছেন এমন অনেককেও পাওয়া গেল দর্শকের ভিড়ে। চোখেমুখে সবার গভীর বিস্ময়ের রেখা। কবীর সুমনের সঙ্গে আবার দেখা হবে, এই প্রচণ্ড প্রতিবাদী একইসঙ্গে বিনয়ে মোড়া মানুষটির কণ্ঠে শোনা যাবে ‘খিধের কিন্তু সীমান্ত নেই, নেই চিতা, নেই কবরটাও, যুদ্ধটাকেই চিতায় তোলো, যুদ্ধটাকেই কবর দাও’ কিংবা ‘আগুন দেখেছি আমি কত জানালায়’ কিংবা ‘সারা রাত জ্বলেছে নিবিড়’ অথবা ‘ঘাটের কাছে গল্প বলে নদীর জল’; ভাবতেই পারেননি কেউ। তাই সুমনের এবারের ঢাকা সফর যেন না চাইতেই অনেক কিছু!

মঞ্চে যন্ত্রীদের সঙ্গে কবীর সুমন। ছবি: সংগৃহীত গান শুরুর আগে কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ করলেন কবীর সুমন। বললেন, ‘আমাকে প্রথম বাংলাদেশে গান গাইতে নিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালকেরা। তখন আমার ৪৬-৪৭ বছর বয়স। আমার প্রথম স্বরচিত, স্বসুরারোপিত গানের অ্যালবাম “তোমাকে চাই” বেরিয়েছিল, যখন আমার ৪৩ বছর বয়স। আমার প্রথম রবীন্দ্রনাথের গানের গ্রামোফোন রেকর্ড যখন বেরিয়েছিল, তখন আমার ২৩ বছর বয়স। আর আমার যখন ১৭ বছর বয়স, তখন আমি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে রবীন্দ্রসংগীত ও আধুনিক গানের একটু উঁচুর দিকের শ্রেণির একজন গায়ক হিসেবে যোগ দিই। আর নজরুল গীতিটা আমি অডিশনে ভালো গাইনি। প্রিয় হলেও ভালো গাইতে পারিনি। তাই বি গ্রেড পেয়েছিলাম। এই হচ্ছে মোটামুটি আমার গানের ক্যারিয়ার।’

এরপর সুমন ডেকে নিলেন তাঁর সফরসঙ্গীদের। একে একে মঞ্চে আসন নিলেন ধ্রুব বসু রায়, ইন্দ্রজিৎ প্রধান, রাকা ভট্টাচার্য। তাঁরা সুমনের সঙ্গে বাজাবেন। এর আগে যত জায়গায় যতবারই গাইতে গিয়েছেন সুমন, গিয়েছেন একাই। একাই গলায় ঝুলিয়ে গিটার ময়দানে ঝড় তুলেছেন। তবে এখন শরীরে পড়েছে বয়সের ছাপ। কারো সাহায্য ছাড়া নড়েচড়ে বসতেও পারেন না। চেপে বসেছে স্নায়ুর অসুখ। গিটারের বদলে তাই সঙ্গী হয়েছে কি-বোর্ড। তবুও এই তিয়াত্তরের সুমন, মস্তিষ্কে নিয়ে হাজারো গানের স্বরলিপি আর শত বছরের বাংলা গানের ইতিহাস, সেই পুরোনো মেজাজেই ধরা দিলেন। সেই বজ্রকণ্ঠ, সেই দ্বিধাহীন উচ্চারণ!

মঞ্চে কবীর সুমন। ছবি: সাজ্জাদ হোসেন প্রথম গানটি ধরলেন সুমন ‘এক একটা দিন মসৃণ, ভোর থেকে শুরু করে রাতের শয্যায়।’ মিলনায়তন জুড়ে নেমে এল গভীর রাতের নিস্তব্ধতা। এই বিস্ময়, এই নীরবতা হাজির ছিল সুমনের শেষ পরিবেশনা ‘তোমাকে চাই’ পর্যন্ত। দুই ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানে ‘সবুজ দ্বীপের মতো মাঝখানে সুফিয়া কামাল’, ‘প্রতিদিন সূর্য ওঠে, ‘মন খারাপ করা বিকেল’, ‘বয়স আমার মুখের রেখায়’, ‘ও গানওয়ালা’, ‘বিদায় পরিচিতা’, ‘কাঙালপনা’, ‘বিসমিল্লাহর পাগল সানাই’, ‘ঘাটের কাছে গল্প বলে নদীর জল’, ‘সারা রাত জ্বলেছে নিবিড়’সহ ২১টি গান গেয়ে প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষ করলেন কবীর সুমন। ১৮ ও ২১ অক্টোবর আবারো ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মঞ্চে উঠবেন তিনি। সৃষ্টি করবেন আরও কতশত মুহূর্ত, যার সাক্ষী হতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসবেন গানওয়ালার অনুরাগীরা।

Source link

Related posts

জাইরা ওয়াসিম ও সানা খানের পর ভোজপুরি অভিনেত্রী সাহার আফশাও ইসলামের জন্য শোবিজ ছেড়েছেন।

News Desk

শাশুড়ির কাছে শাহরুখ খানের বিশেষ আবদার

News Desk

শিল্পা শেঠি ছাড়া পুরো পরিবার করোনায় আক্রান্ত

News Desk

Leave a Comment