‘রাস্ট’ সিনেমার শুটিংয়ে ‘মিশন ইম্পসিবল’ সিনেমা খ্যাত অ্যালেক বল্ডউইনের প্রপ গানের গুলিতে চিত্রগ্রাহক হ্যালাইনা হাচিনসের মৃত্যুর পর এখন কথা উঠছে হলিউডের সেটগুলোয় সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের সুরক্ষা নিয়ে।
অ্যালেক বল্ডউইনের হাতে থাকা কথিত ‘নকল বন্ধুক’ থেকে আসা এক গুলির আঘাতে মারা যান হ্যাচিনস। সিনেমা সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও তাদের ইউনিয়নগুলো এতো এতো নিরাপত্তা প্রটোকলের ব্যবস্থা করার পরও কীভাবে এরকম ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সেটিই বুঝতে পারছে না সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির অনেকে। এই দুর্ঘটনার পর সিনেমার সেটে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা আইনগুলো আরও কড়া করতে যাচ্ছেন আইন-প্রণেতারা।
হলিউডের অবস্থান মার্কিন প্রদেশ ক্যালিফোর্নিয়ায়। এই প্রদেশের সিনেটর ডেভ কর্তেস সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, সিনেমার সেটে বাস্তব গোলাবারুদ এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিষিদ্ধ করে নতুন একটি আইন প্রবর্তন করতে যাচ্ছেন তিনি।
ইন্ডাস্ট্রির অনেকে ফাঁকা গুলি বর্জন করারও ডাক দিয়েছেন। এইচবিও সিরিজ “দ্য মেয়ার অফ ইস্টটাউন”-র নির্মাতা ক্রেইগ জোবেল বলেন, “এখন তো কম্পিউটারই আছে। আমার সিরিজে যেসব গুলির আওয়াজ আছে, তার সবই ডিজিটাল। আপনি হয়তো বুঝতেও পারবেন, কিন্তু কী আসে যায়? ফাঁকা গুলি ব্যবহার করাটা একটি অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি।”
২০১৬ সালে মার্কিন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সেটে ঘটা দুর্ঘটনাগুলোর উপর করা এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানায়, ১৯৯০ সাল থেকে এসব সেটে কমপক্ষে ৪৩ জন নিহত হয়েছেন এবং ১৫০ জনেরও বেশি গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। আর এ সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে চিত্রগ্রহণের সময় দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ৩৭ জন এবং গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন “আরও অনেকে”।
ব্রুস লি’র সন্তান, ব্র্যান্ডন লি ১৯৯৩ সালে ‘দ্য ক্রো’ ছবির শুটিং চলাকালে এক বন্দুক দুর্ঘটনায় মাত্র ২৮ বছর বয়সে প্রাণ হারান। হাচিনসের মৃত্যুও একইরকম দুর্ঘটনার কারণে হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও ঠিক কিসের আঘাতে মারা গিয়েছেন তিনি, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
তবে নিরাপত্তা ঝুঁকি শুধু বন্দুকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। ২০১৪ সালে একটি বাস্তব ট্রেনের লাইনে চিত্রগ্রহণ করতে গিয়ে প্রাণ হারান একটি স্বাধীন চলচ্চিত্রের ক্যামেরা সহযোগী। ১৯৮২ সালে “দ্য টোয়াইলাইট জোন: দ্য মুভি”-র শুটিং চলাকালে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় দুজন শিশুসহ মোট তিনজন অভিনেতা নিহত হন। এই দুর্ঘটনার পরই ডিরেক্টরস গিল্ড অফ আমেরিকা একটি নিরাপত্তা কমিটি গঠন করে।
২০১৭ সালে ‘ডেডপুল ২’-এর চিত্রগ্রহণের সময় মাথার আঘাত পাওয়ার কারণে মারা যান ছবির স্টান্ট ডাবল জো হ্যারিস। পরবর্তীতে কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার তদন্ত করে সিদ্ধান্তে আসে, ডেডপুলের প্রয়োজক সংস্থা হ্যারিস ও সিনেমার অন্যান্য কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য প্রযোজকদের প্রায় তিন লাখ কানাডিয়ান ডলার জরিমানাও করা হয়।
বন্দুক আইন নিয়ে ক্রমবর্ধমান বিতর্কের মধ্যে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে এসব আইন প্রণয়ন করে মূলত প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ। তবে সিনেমার সেটে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বর্তমান আইনগুলো নির্ধারণ করেছে ইন্ডাস্ট্রি নিজেই। ক্যালিফোর্নিয়ার আগ্নেয়াস্ত্র আইন এমনিতে কড়া হলেও সিনেমার জন্য “বিনোদন খাতে আগ্নেয়াস্ত্রের অনুমতি” নামে আলাদা একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিছু কিছু প্রদেশে অন্যান্য বিপজ্জনক সামগ্রীর জন্যও আইন রয়েছে, যেমন পাইরোটেকনিক, হেলিকপ্টার, ড্রোন; এমনকি বন্দুকের গুলির আওয়াজ নিয়ন্ত্রণেও আইন রয়েছে কিছু প্রদেশে।
ইন্ডাস্ট্রির সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত লেবার-ম্যানেজমেন্ট সেফটি কমিটি হেলিকপ্টার, গাড়ি, স্টান্ট এবং এমনকি কৃত্রিম কুয়াশার ব্যবহারের ব্যাপারেও নিরাপত্তা বুলেটিন জারি করে।
সিনেমায় প্রায়ই বন্দুকের গুলিকে অনুকরণ করতে কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত গ্রাফিক্স ব্যবহার করা হয়। কিছু প্রযোজনায় বন্দুকে রাবার বুলেট বা অন্যান্য নরম উপাদান ব্যবহার করা হয়, যেগুলো শব্দ ও আঘাত করতে পারে, কিন্তু গুরুতর চোটের কারণ হয় না। কিন্তু প্রকৃত গুলাগুলিকে চিত্রিত করতে অনেকে ফাঁকা গুলি ব্যবহার করে। ফাঁকা গুলির ক্ষেত্রে বন্দুকে প্রকৃত বুলেটের বদলে বারুদ ভরা হয়।
ফাঁকা গুলির ব্যাপারে ইন্ডাস্ট্রির নির্দেশনা স্পষ্ট, ফাঁকা হলেও তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র।
লেবার-ম্যানেজমেন্ট সেফটি কমিটির নিরাপত্তা বুলেটিনেও কড়া দাগে ফাঁকা গুলি বর্জনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৪ সালে অভিনেতা জন-এরিক হেক্সাম একটি ফাঁকা কার্তুজের আঘাতে নিহত হন। রাশিয়ান রুলেট খেলার ভান করতে গিয়ে খুব কাছে থেকে নিজের মাথায় গুলি চালিয়েছিলেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান স্মল কাউ প্রোডাকশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টোফার জিস্ট এবং সারা মেবেরি এক প্রবন্ধে লিখেন, “ফাঁকা গুলি বলতে বন্দুকে বুলেটের পরিবর্তে খালি কাগজ, প্লাস্টিক, বা তুলা ব্যবহার করাকে বুঝায়।
“এই প্রক্রিয়ার ফলে আপনার বন্দুক থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আগুন বের হবে। কিন্তু এটি গুরুতর আঘাতের কারণও হতে পারে। ফাঁকা গুলি মানে এই নয় যে বন্দুকটি বিপজ্জনক নয়।”
কাছে থেকে ফাঁকা গুলি নিক্ষেপ ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তবে দূরে থেকে এই গুলি তেমন বিপজ্জনক নয়। ‘রাস্ট’ ছবির শ্যুটিংয়ে কী ঘটেছিল, তা এখনো অস্পষ্ট। তবে অনেকে ধারণ করছেন ফাঁকা নয়, সেই প্রাণঘাতী বন্দুকে প্রকৃত বুলেটই ছিল।
সেক্ষেত্রে ইন্ডাস্ট্রির নির্দেশিকা ভেঙেছে ‘রাস্ট’-র প্রযোজনা পরিষদ। নির্দেশিকা অনুযায়ী বাস্তব গোলাবারুদ কখনোই সেটে “ব্যবহার করা বা আনা যাবে না”।
জানা গেছে, এই সিনেমার শুটিং শুরু হলে কর্মঘণ্টা ও বেতন-ভাতা সংক্রান্ত জটিলতায় অনেক কর্মচারী পদত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয় স্থানীয় কিছু লোকজনকে, যাদের শুটিং সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দুটিই স্বল্প।
নতুন কর্মচারীদের কেউ ভুলে নকল বন্দুকের বদলে বল্ডউইনের হাতে একটি আসল বন্দুকই তুলে দিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০১৬ সালের এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্মক্ষেত্রে গুরুতর দুর্ঘটনার পরে সংশ্লিষ্ট ফিল্ম স্টুডিওর উপর জরিমানা আরোপ করা হলেও পরবর্তীতে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে এসব জরিমানাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে ফেলে স্টুডিওগুলো।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অধিকাংশ কর্মীকে মামলা করতেই বাধা দেওয়া হয়। যারা মামলা করেন তাদের পক্ষে কেউ সাক্ষী দিতে চায় না, কারণ সবাই ভয় পায় ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে গেলে পরবর্তীতে তারা আর চাকরি পাবেন না।
সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।