সময়টা সম্ভবত ১৯০২ সাল। কলকাতার তুলাপট্টিতে চামড়ার গুদামে কাজ করতো বর্ধমান জেলা থেকে আসা এক তরুণ। গান গাওয়ার সহজাত প্রতিভা ছিলো ছেলেটির। গ্রামেগঞ্জে লেটো, গাজন, কীর্তন, মঙ্গলকাব্যের গান, কমলাকান্তের শ্যামাসঙ্গীত ভক্তিগীতির অসামান্য প্রভাব ছিল তার গানে। এদিকে সামান্য মাইনে তার ওপর চামড়ার দুর্গন্ধে আধপেটা খেয়ে অমানুষিক পরিশ্রম। রাত কাটতো ফুটপাতে শুয়েই।
একটু বেশি মাইনে পাওয়ার আশায় আর গান শেখার স্বপ্ন নিয়ে একদিন সে পাড়ি দিলো কানপুর। সেখানে অন্তত দু’বেলা দু’মুঠো খাবার পাওয়া যাবে এই আশার পাশাপাশি গান গেয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নও ছিল দুচোখে। গান শিখতে হবে, গাইতে হবে, গায়ক হতেই হবে এই স্বপ্ন কখনও তাঁর চোখ থেকে মুছে যায়নি। সারা দিনের কঠিন পরিশ্রমের পরেও তিনি কানপুরের আবদুল হাই হাকিমের কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিখতেন।
সেখানে বছর তিনেক কাটানোর পর এক ফকির তাকে কলকাতা ফিরে আসতে বলে। এখানেই নাকি তার স্বপ্ন সাকার হয়ে উঠবে। কলকাতায় ফিরে কুড়ি টাকা মাইনের একটি কাজ জোগাড় করে ফেললেন পূর্ব পরিচিত সেই তুলাপট্টিতেই।
বন্ধুদের জোরাজুরিতে একদিন রাতে তিনি তুলাপট্টির মোড়ে গান ধরলেন। একটা দু’টো… হঠাৎ ঘোর ভাঙল পুলিশের ডাকে। রাস্তায় তৈরি হয়েছে যানজট। সেই ট্র্যাফিক জ্যামেই আটকে পড়েছিলেন একটি রেকর্ড কোম্পানির মালিক। তিনি গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি তাঁর কাছে এসে আমন্ত্রণ জানালেন গান রেকর্ড করার। পর দিন দুটি ভক্তিগীতি রেকর্ড করার জন্য তখনকার দিনে রয়্যালটি পেলেন নগদ তিনশো টাকা!
গোল বাধলো তার নাম নিয়ে। হিন্দু ধর্মের ভক্তিমূলক গানের রেকর্ড হবে কিনা এক বিধর্মী শিল্পীর নামে! কোম্পানির মাথায় হাত, রেকর্ড বিক্রি হবে তো ? কে এই শিল্পী মানুষটি……… ?
আসল নাম মুন্সী মহম্মদ কাশেম। বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার কুসুমগ্রামে ১৮৮৮ সালে জন্ম। কাশেমের খুড়তুতো ভাই ছিলেন সেখানকার নামকরা জমিদার ইব্রাহিম মুন্সী। গান গাইবার সহজাত প্রতিভার জন্য তিনি কাশেমকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তাঁর বাড়িতেই পরম যত্নে মানুষ হচ্ছিলো কাশেম।
ইব্রাহিম এতটাই ভালোবাসতেন যে লেখাপড়া বা কিছু করার জন্য তাকে বর্ধমান শহরে যেতে দিতেও রাজি হতেন না। কিন্তু হঠাৎই কলেরা রোগে ইব্রাহিম মুন্সীর মৃত্যু হলে কাশেম ও তাঁর পরিবার অভাবের মধ্যে পড়ে যায়। জমিদার বাড়িতে সেসময় গান শেখাতে আসতেন সঙ্গীত শিল্পী সতীশ চক্রবর্তী। গান শিখতে শিখতে তাঁর স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন কাশেম। অল্প বয়সেই সতীশবাবুর সঙ্গে এক দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। পুঁজি বলতে সেদিন তার ভালো গানের গলা আর খুব তাড়াতাড়ি গান শিখে নিজের গলায় গাইবার প্রতিভা। ভেবেছিলেন এখানেই খুঁজে পাবেন তার নিজস্ব জগত। যদিও স্বপ্নপূরণ হতে লেগে গেল বেশ কটি বছর।
ফিরে আসি আগের পর্বে, নাম সমস্যার জট ছাড়াতে সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন গোরাচাঁদ মল্লিক নামে কাশেমের এক শুভাকাঙ্ক্ষী। নিজের পদবী মল্লিক ব্যবহার করতে দিলেন তাঁকে। কাশেম থেকে কে, আর পদবী মল্লিক নিয়ে সেদিন থেকে সঙ্গীত জগতে মুন্সী মহম্মদ কাশেম পরিচিত হলেন #কে_মল্লিক নামে। পরবর্তী কালে সেই নামেই করেছেন অজস্র রেকর্ড।
এক দিকে তিনি যেমন গজ়ল, ইসলামি গান ও শ্যামাসঙ্গীত গেয়েছেন অন্য দিকে তেমনই সুর দিয়েছেন অসংখ্য নজরুলগীতিতে। নলিনী সরকার নিজের খাতায় নজরুলের লেখা গান গ্রামোফোন কোম্পানিতে নিয়ে আসেন। কে মল্লিক তার থেকে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ এবং ‘আমার চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায়’ গান দু’টি তুলে রেকর্ড করতেই বাজিমাত। গ্রামোফোন কোম্পানির অফিসে তখন এক দিকে কমল দাশগুপ্ত, ধীরেন দাস ও জমিরুদ্দিন খাঁর উপরে ভার দেওয়া ছিল বিভিন্ন শিল্পীর সুর ও তাল দিয়ে গান রেকর্ড করানোর, অন্য দিকে রেকর্ডিংয়ের আগে সব দিক বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল কে মল্লিকের উপরে। আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালারাও কে মল্লিকের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। ১৯০৯ থেকে ১৯৪০, আগমনী, শ্যামাসঙ্গীত, ভজন, ইসলামি, নজরুলের গানে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়৷ তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলিম রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।
হিন্দি ভক্তিগীতিকেও সেই সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন মল্লিক সাহেব। বিক্রিও অঢেল। কথিত আছে, নজরুলের গান রেকর্ড করে নজরুলগীতিকে জনপ্রিয় করে তোলার মূল কারিগর তিনিই। ধানবাদের ঝরিয়ার রাজবাড়িতে সভাগায়কের চাকরি করতে গিয়ে সেখানকার অন্ধকার জগৎ থেকে তুলে নিয়ে এলেন কন্যাসমা কমলাকে। নাম দিলেন কমলা ঝরিয়া। নিজের এবং আঙুরবালার কাছে তালিমের ব্যবস্থা করে তাঁকে দিলেন সামাজিক প্রতিষ্ঠা। কমলা ঝরিয়া পরবর্তী কালে বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী হলেন, কিন্তু বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেলেন কে মল্লিক! নিজের উত্তরসূরী হিসেবে ঘোষণা করে গিয়েছিলেন শ্যামাসঙ্গীত শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য কে।
১৯৪৬ সাল নাগাদ খ্যাতি অর্থ যশ সবকিছু ছেড়ে কলকাতা থেকে ফিরে এলেন জন্মস্থান কুসুমগ্রামে। জমি ও পুকুর কিনে একটি ছোট বাড়ি তৈরি করে পাকাপাকি ভাবে রয়ে গেলেন সেখানেই। নিঃসন্তান থাকায় এক বালককে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। গ্রামের সাধারণ-অসাধারণ সবাইকেই বিনা পয়সায় গান শোনাতেন এবং শেখাতেন। লোকশিক্ষার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের মধ্যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গীতকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। ১৯৬১ সালে সঙ্গীতের আজীবন পূজারী মানুষটি চলে যান অমৃতলোকে। কে, মল্লিক বেঁচে থাকুক বাংলা গানের ক্রম ঝর্ণাধারায়।
তথ্য সূত্র: আনন্দ বাজার