‘জীবনানন্দের ধানসিঁড়ির খোঁজে আমরা জলঙ্গীর কাছে গিয়েছিলাম’
বিনোদন

‘জীবনানন্দের ধানসিঁড়ির খোঁজে আমরা জলঙ্গীর কাছে গিয়েছিলাম’

বায়োপিক বানানোর জন্য অনেকেই তো ছিলেন, যাঁরা তুলনামূলকভাবে বেশি জনপ্রিয় এবং যাঁদের জীবনের গল্প আরও ড্রামাটিক। জীবনানন্দ দাশকে বেছে নেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে?

সায়ন্তন: আমরা যাঁরা বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, তাঁদের কাছে জীবনানন্দ তো একজন বাঙালি হিসেবে খুবই এমিনেন্ট ফ্যাক্টর। তাঁকে নিয়ে চিন্তাভাবনাটা ছোটবেলা থেকেই ছিল। কিন্তু ছবি করব, সেটা যখন আমি ম্যাচিউরড হই, তারপর সেই ভাবনাচিন্তাটা গ্রো করে। সিনেমার জগতে যখন ঢুকি, তখন থেকেই এটা আমাকে হন্ট করত। যদি সত্যিই কবির একটা বায়োপিক বানানো যায়! এবং সেটা শুধুমাত্র কবি কখন জন্মেছিলেন, জন্মে এই করেছিলেন, সেই করেছিলেন, লিখেছিলেন, তাঁর এই এই সমস্যা ঘটেছিল… হ্যানাত্যানা না।

জীবনানন্দ চরিত্রের অভিনেতা ব্রাত্য বসুকে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন নির্মাতা সায়ন্তন। ছবি: সংগৃহীত আপনি আরও ব্যাপকভাবে কবিকে ধরতে চেয়েছিলেন চিত্রনাট্যে, সেটা ‘ঝরা পালক’-এর ট্রেলার দেখে বোঝা গেছে। জীবনানন্দকে পর্দায় আনতে গিয়ে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয়েছে?

সায়ন্তন: একজন কবির বায়োপিক বানাতে যাওয়ার সবচেয়ে বড় যেটা অবস্ট্রাকল বা সবচেয়ে বড় যে জটিলতা, সেটা হচ্ছে—কবির বায়োপিক তো তাঁর কবিতাও। মানে তাঁর শিল্পজীবন এবং তাঁর যে রিয়েল টাইমলাইন—এই দুটোই তো ইমপর্ট্যান্ট।

একটা গ্যাংস্টারের জীবনী বানাতে গেলে… তিনি কখন জন্মেছিলেন, কার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল, কাকে কাকে মেরেছিলেন—এসব বললেই হয়ে যায়। কিন্তু একজন কবির জীবনে সেই অর্থে কোনো ড্রামা থাকে না। হ্যাঁ, জীবনানন্দের জীবনে এনাফ ড্রামা ছিল, তাঁর বৈবাহিক জীবন ঘিরে এবং তাঁর প্রেমজীবন ঘিরে। তো যেটা গল্প সেটা হচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যে, কবির জীবনী এবং কবির এন্টায়ার শিল্পকর্ম—এই দুটোকে কী করে মার্জ করা যায়! কবিতাও তো তাঁর জীবন। সৃষ্টি তাঁর জীবনের চেয়েও বড়; বিশেষ করে জীবনানন্দের মতো একজন শিল্পীর কাছে।

তো এই দুটোকে মার্জ করাটা, আমাদের সিনেমার ল্যাঙ্গুয়েজে, চিত্রনাট্যে এবং এক্সিকিউশনে কীভাবে সেই ভাষাটা খুঁজে পাওয়া যাবে, সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

জীবনানন্দ চরিত্রের দুই সময়ের দুই ছবি, অভিনয়ে ব্রাত্য বসু ও রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত জীবনানন্দের ‘মাল্যবান’ আপনার সিনেমার মূল সূত্র। এ ছাড়া আর কোনো রিসোর্সের সাহায্য নিয়েছেন চিত্রনাট্য করতে গিয়ে?

সায়ন্তন: জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে অনেক বই রয়েছে। দুটো ইমপর্ট্যান্ট বই, যেটা তাঁর লিটারারি বায়োপিক। (একটি) ক্লিনটন বি সিলি বলে একজন লেখক লিখেছেন। তিনিও কবি ছিলেন; দীর্ঘদিন বরিশালে ছিলেন। বাংলা ভাষাটা প্রায় বাঙালির মতোই রপ্ত করছিলেন ক্লিনটন। তাঁর একটা বই ‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’। এবং আপনাদের বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটা বই ‘একজন কমলালেবু’, যেটা জয়া আহসান আমাকে এনে দিয়েছিল; ইন্ডিয়াতে পাওয়া যায় না। এই দুটো বই আমাকে অনেক সাহায্য করেছিল চিত্রনাট্য করতে গিয়ে। তা ছাড়া এখানকার এমিনেন্ট জীবনীকার ভূমেন্দ্র গুহর একটা বই আছে জীবনানন্দকে নিয়ে লেখা, ‘আলেখ্য: জীবনানন্দ’ নামে। এবং আরও বেশ কয়েকটি বই আমাকে প্রচণ্ড সাহায্য করেছে ‘ঝরা পালক’ সিনেমার চিত্রনাট্য করতে গিয়ে।

‘ঝরা পালক’ সিনেমার শুটিং স্পটে নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীরা। ছবি: সংগৃহীত ‘ঝরা পালক’-এ জীবনানন্দকে কতখানি ধরেছেন? আমি দেখলাম রাহুল করেছেন তাঁর যুবকবেলার চরিত্রটা। পরিণত বয়সে ব্রাত্য বসু। তার মানে যৌবন থেকে শুরু করে কবির পুরো জীবনটাই থাকছে সিনেমায়?

সায়ন্তন: জীবনানন্দের জীবন এবং তাঁর শিল্পজীবন; এই দুটোই ক্রমাগত মার্জ করতে করতে গেছে পুরো ছবিতে। এবং এই ছবিটা এ কারণে প্লেইন ন্যারেটিভ নয়। একটা রিল টাইম, একটা রিয়েল টাইম এবং তার সঙ্গে রিসেন্ট টাইম; তিনটে সময়ের সংযোগ ঘটেছে চিত্রনাট্যে। ছবিটা দেখলে সেটা বোঝা যাবে। আসলে একজন ফিল্মমেকারের কাছে এ ধরনের একটা ছবি বানিয়ে সেটা নিয়ে বলা খুবই ডিফিকাল্ট।

লাবণ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান। ছবি: সংগৃহীত ‘ঝরা পালক’-এর শুটিং কোথায়, কীভাবে হয়েছে? সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলেন…

সায়ন্তন: শুটিং আমরা অলমোস্ট (পুরোটাই) কলকাতায় করেছি। কিছুটা শুটিং করেছি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে, তেহট্ট থেকে অনেক দূরে গিয়ে। সেখানে জীবনানন্দের রূপসী বাংলার যে চিত্রকল্প, সেগুলো পেয়েছি। বরিশাল যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সেই সময় যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরিশালের যে অভাব, সেটা খানিকটা বর্ডারের কাছাকাছি গিয়ে ধানসিঁড়ি নদীর বদলে জলঙ্গী নদীকে আমরা ব্যবহার করেছি। জলঙ্গী নদীও জীবনানন্দের কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে। সেটা আমরা ধানসিঁড়ি হিসেবে ট্রিট করেছি। সো দ্যাট ওয়াজ ভেরি উইয়ার্ড এক্সপেরিয়েন্স।

. ‘ঝরা পালক’ সিনেমার দৃশ্যে ব্রাত্য বসু ও জয়া আহসান। ছবি: সংগৃহীত জলঙ্গী নদীতে শুট করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই আমার, সিনেমাটোগ্রাফার অভিজিৎ নন্দী ও এডিটর প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের কনফিউশন হচ্ছিল, বোধ হয় আমরা ধানসিঁড়িতে আছি। আমরা তিনজনে মিলে গেছিলাম শুটিংয়ে। আমার মনে হয় কোনো এডিটর (এর আগে) শুটিংয়ে গেছে কিনা! এটা যদি কাইন্ডলি লিখেন খুব ভালো হয়। কারণ, প্রদীপ্ত নিজেও একজন ফিল্মমেকার। সে এতটাই ইনভলভ ছিল পুরো ছবিতে! ধানসিঁড়ির খোঁজে আমরা গেছিলাম, সত্যিই আমরা জলঙ্গী নদীটিকে ধানসিঁড়ি হিসেবে ট্রিট করতে পারি কি না! আমাদের ভেতরে সেই প্যাশনটা আছে কি না! সেটা ছবিটা দেখলে আপনারা বুঝতে পারবেন আমরা তার সঙ্গে জাস্টিস করতে পেরেছি কি না।

কলকাতা ফেস্টে তো দেখানো হলো ছবিটা এ বছর…

সায়ন্তন: কলকাতা ফেস্টে দেখানো হয়েছে। দেখে অনেকেই খুব প্রশংসা করেছেন। কবি জয় গোস্বামী ছবিটাকে বাংলা চলচ্চিত্রে এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটা ‘এমিনেন্ট পিস অব ওয়ার্ক’ বলে বর্ণনা করেছেন। ছবিটা উনি দুবার দেখেছেন। এ ছাড়া আরও অনেক গুণীজন—সুমন মুখোপাধ্যায়, পরিচালক, যিনি জয়া আহসানকে নিয়ে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বলে আরেকটা ছবি করেছেন। তিনি ছবিটা দেখে খুবই উচ্ছ্বসিত। পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে ছবিটা দেখানো হয়েছিল। তিনিও ছবিটা দেখে খুবই প্রশংসা করেছিলেন। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের পরে আমরা ছবিটা নিয়ে আরও বেশি আশাবাদী। ‘ঝরা পালক’ বাংলাদেশেও রিলিজ করার প্ল্যান করছি আমরা।

শুটিং স্পটে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন নির্মাতা সায়ন্তন। ছবি: সংগৃহীত কবির স্ত্রী লাবণ্য চরিত্রে জয়া আহসানকে কাস্ট করার কারণ কী?

সায়ন্তন: প্রথম যখন লাবণ্য চরিত্রের ভিজুয়ালাইজেশন শুরু করি, তখন জয়া ছাড়া ইনফ্যাক্ট আর কারও মুখই আমার সামনে আসেনি। এই রকম পানপাতা একটা অদ্ভুত বাঙালি মুখ, যেটা একই সঙ্গে বনলতা সেন, সুরঞ্জনা এবং লাবণ্য। লাবণ্যর সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের যে কেমিস্ট্রি ছিল। লাবণ্য অসামান্য বিদুষী এবং সুন্দরী নারী ছিলেন। জীবনানন্দ সারা জীবন বলে গেছেন, তাঁর তুলনায় জীবনানন্দ নিজে তাঁর কাছে খুব অযোগ্য। জীবনানন্দকে ক্রিয়েটিভ সাপোর্ট এবং ফ্যামিলিগতভাবে… এসব নিয়ে অনেক ধরনের গুজব আছে যে, উনাকে অত্যাচার করা হয়েছিল। লাবণ্য উনাকে নিজের ঘরে অবধি ঢুকতে দিতেন না। ‘মাল্যবান’ উপন্যাসে এসব এসেছে। যে জন্য লাবণ্য তাঁর জীবদ্দশায় এই বইটি প্রকাশ করতে খুব দ্বিধাবোধ করেছিলেন।

তো সে ক্ষেত্রে লাবণ্য চরিত্রের যে ব্যক্তিত্ব, যে সৌন্দর্য এবং তাঁর যে বিদূষীয়ানা—এই তিনটির সংমিশ্রণ জয়া আহসান ছাড়া আর কারও কথা আমার মাথায় আসেনি পরিচালক হিসেবে। আরও একটা প্রধান কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের মাটি। বাংলাদেশের মাটির যে গন্ধ, সেটা জয়া আহসানের পারফরমেন্সের মধ্য দিয়েই ছবিতে ফুটে উঠেছে। সেটা একটা অমূল্য প্রাপ্তি একজন পরিচালক হিসেবে আমার কাছে। এবং দর্শকের কাছেও সেটা অবশ্যই একটা প্রাপ্তি হবে বলে আশা করছি।

সে কারণে লাবণ্য এবং জয়া আহসান এখানে একাকার হয়ে গেছেন।

জয়া আহসান নিজে এ চরিত্রটা করতে করতে মাঝেমধ্যেই ক্যামেরা এবং ক্যামেরার বাইরে লাবণ্য হয়ে উঠতেন। সেটা আমরা দেখেছি। এবং তাঁর যে ইনভলভমেন্ট, যেটা আমি আগেও বললাম, শুধু অভিনয় দিয়ে নয়, আমাকে বেশ কিছু বই দিয়ে উনি সাহায্য করেছেন। চিত্রনাট্যে উনি অনেক ইনপুট দিয়েছেন একজন নারী হিসেবে নারীর পারস্পেকটিভ।

আমরা প্র্যাকটিক্যালি চেয়েছিলাম, মাল্যবানের একটা অ্যান্টিথিসিস বানাতে। মাল্যবানই তো এই ছবির মূল টেক্সট। কারণ, এটি কবির লেখা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, যেখানে জীবন এবং শিল্প মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সেখানে মাল্যবানের অ্যান্টিথিসিস তৈরি করার জন্য লাবণ্যরূপী জয়া আহসান বা জয়া আহসানরূপী লাবণ্য এই ছবিতে একটা মূল্যবান সম্পদ হয়ে আছে।

দেখুন ‘ঝরা পালক’ সিনেমার ট্রেলার:

 

 

Source link

Related posts

সুবাহ’র বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ইলিয়াসের মামলা

News Desk

আনুশকা শর্মার দেহরক্ষীর বেতন মাসে ১০ লাখ টাকা !

News Desk

এবার পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ হচ্ছে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’

News Desk

Leave a Comment