Image default
ইতিহাস

দিরিলিস আরতুগ্রুল – ওসমানী সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা আরতুগ্রুল গাজীর ইতিহাস

একুশে টিভিতে প্রচারিত হতে যাচ্ছে ডাবিংকৃত তুর্কী ধারাবাহিক “সীমান্তের সুলতান”(তুর্কী: দিরিলিশ: এরতুগরুল বা পুনুরুত্থান: এরতুগরুল)। ধারাবাহিকটি অঘুজ তুর্কিদের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত, যা উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের পিতা এরতুগরুল গাজীর জীবনকে তুলে ধরেছে।

আমার উদ্দেশ্য এই সিরিয়াল নিয়ে আলোচনা নয়। কে এই ‘সীমান্তের সুলতান’, অঘুজ তুর্কি কারা, প্রথম উসমান কে, উসমানীয় সাম্রাজ্য কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো ইত্যাকার নানা বিষয় নিয়েই আজকের আলোচনা। আশা করি আপনারা আমার সাথেই থাকবেন।

‘সীমান্তের সুলতান’ ওরফে এরতুগরুল গাজীর প্রাথমিক জীবন

এরতুগরুল আনুমানিক ১১৯১-১১৯৮ খ্রীস্টাব্দের কোন এক সময় আনাতোলিয়ার ‘আহলাত’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল সুলায়মান খান (শাহও বলে অনেকে)।সুলায়মান খান অঘুজ তুর্কিদের কায়ি গোত্রের একজন নেতা ছিলেন। পিতা সুলায়মান খানের সেনাবাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন সন্তান এরতুগরুল। এ সময় তিনি বেশ কিছু ধারাবাহিক ঘটনার মাধ্যমে তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্য সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দেন।

অঘুজ তুর্কিদের কথা

তুর্কি ঘোড়া বা তুর্কিনাচন কথাটা অনেকেই শুনে থাকবেন। চলুন সেগুলির নাম যে দেশগুলির নাম থেকে পাওয়া সেগুলির মধ্যে একটি দেশ তুর্কমেনিস্তানের কথা জানি।

তুর্কি ঘোড়া হচ্ছে মধ্য এশিয়ার পশুচারণকারী নানা উপজাতিদের ব্যবহৃত তেজি ঘোড়া। তুর্কোমেন উপজাতির লোকেরা মূলত ছিল মধ্য এশিয়ার স্তেপ তৃণভূমি অঞ্চলের তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। এদের মধ্যে যারা বিস্তীর্ণ তৃণভূমি অঞ্চলের পশ্চিম অঞ্চলে বাস করত তাদের বলা হত অঘুজ উপজাতি। এরা ছিল মোঙ্গলদের একটি শাখা। এদের বলা হত অঘুজ টার্ক বা অঘুজ তুর্কি- ধারাবিবরণী রক্ষকদের লেখায় এদেরই আবার অন্য নাম ছিল তুর্কমেন। এরা এশিয়ার বৃহত্তম লবণাক্ত জলের হ্রদ ক্যাস্পিয়ান সাগরের পূর্বতীরে গড়ে তুলেছিল এদের বাসস্থান তুর্কমেনিস্তান। হ্রদের পশ্চিমদিকে বাস করে এদেরই আরেক গোষ্ঠী তুর্কিরা, যাদের বাসভূমির নাম তুরস্ক।

তুর্কমেনিস্তানের চারদিক ঘিরে আছে কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান। প্রায় বারোশো বছর আগে থেকে কিছু অঘুজ উপজাতির পশুচারক কিছু যাযাবর মানুষ মঙ্গোলিয়ার পশ্চিম অঞ্চল থেকে অর্থাৎ মধ্য এশিয়ার উরাল-আলতাই অঞ্চল ছেড়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে এই অঞ্চলে।

নতুন বাসভূমিতে এসে এরা ‘সেলজুক সাম্রাজ্যের’ অধীনে বাস করেছিল। সেলজুক সাম্রাজ্য ছিল বর্তমান ইরান ও তুর্কমেনিস্তানের পুরোনো বাসিন্দা অঘুজ তুর্কিদেরই সাম্রাজ্য।

অবশ্য আগে এরা তুর্কমেন নামে পরিচিত ছিল না। নশো একাত্তর সালে, অর্থাৎ দশম শতাব্দিতে এদের মধ্যে এক বিরাট সংখ্যার জনগণ -প্রায় দু লক্ষ মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আর ধর্মান্তরিত হবার পর থেকে এই অঘুজ উপজাতির মুসলমান মানুষদের পরিচয় হয় ‘তুর্কমেন’। তুর্ক+ ইমান মিলে হয় ‘তুর্কমেন’। ইমান কথার অর্থ ছিল ইসলামে বিশ্বাসী। আবার ‘মেন’ বলতে বোঝানো হত ‘খাঁটি তুর্কি’। আর এই খাঁটি তুর্কিদের বাসভূমির নাম হল ‘তুর্কমেনিস্তান’।

এরতুগরুল গাজীর উত্থান

হিজরী সপ্তম শতাব্দীর একেবারে প্রারম্ভে, যখন চেঙ্গিষী মোঙ্গলেরা খুরাসান আক্রমণ করে তখন গায তুর্কদের ঐ সমস্ত লোক খুরাসান ছেড়ে তুর্কমেনিস্তানের মার্ভ অঞ্চলে চলে যায় এবং সেখানে বসবাস করতে থাকে। ঐ গোত্রের নাম ছিল ‘কায়ি’। এদের নেতার নাম ছিল সুলায়মান খান। এরা ছিল খাঁটি মুসলমান। সুলায়মান খানের যোগ্যতা লক্ষ্য করে সেখানে অবস্থানকারী লোকজন তার চারপাশে একত্রিত হতে থাকে, যারা এতদিন দিকভ্রান্তের মত এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছিল। এভাবে তাদের দল ভারী হতে থাকে। এটা ছিল ঐ যুগ, যখন চেঙ্গিষ খানের দস্যুতার কারণে বিভিন্ন দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা বিপর্যয়ের সম্মুখীণ হয়ে পড়েছিল এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে জান-মালের নিরাপত্তার জন্য নিজ বাহুবলের উপর নির্ভর করতে হচ্ছিল। তখন অত্যাসন্ন বিপদাপদের মুকাবিলা করার জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকা প্রত্যেক ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠির জন্য ছিল অপরিহার্য। সুলায়মান খান সুষ্ঠুভাবে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং নিজ জনগোষ্ঠি যাতে বিনা প্রয়োজনে কোনরুপ ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের পতন সুলায়মান খানের সামনে সুন্দর সুযোগ এনে দেয়। তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক যোদ্ধা ও প্রচুর পরিমাণ যুদ্ধ-সামগ্রী সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
সময়ের সাথে এইসব গোত্রগুলো নিজেদের ঘিরে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে শুরু করে। এই রাষ্ট্রগুলো ‘বেইলিক’ নামে পরিচিত ছিল এবং গাজী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার ধারণাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। প্রতিটি রাষ্ট্র একেকজন নেতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতো যিনি সেই বেইলিক এর গাজীদের পরিচালনা করতেন এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন। ১৩ শতকের শেষের দিকে গোটা আনাতোলিয়া জুড়ে অসংখ্য বেইলিক এর অস্তিত্ব ছিল।

ইতিহাসের মোড় ঘুরানো বিস্ময়কর একটি অভিযান

চেঙ্গিষ খান তার মৃত্যুর তিন বছর আগে ৬২১ হিজরীতে (১২২৪ খ্রী) একটি বিরাট বাহিনী সেলজুক সাম্রাজ্য আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন, যার রাজধানী ছিল কুনিয়া। সে সময় কুনিয়ার শাসনক্ষমতায় ছিলেন আলাউদ্দীন কায়কুবাদ সেলজুকী। কালের পরিক্রমায় এক সময়ের পরাক্রমশালী সেলজুক সাম্রাজ্য অনেক দূর্বল হয়ে পড়েছিল। যাইহোক, সুলায়মান খানের কাছে এই সংবাদ পৌছাল যে, মোঙ্গলরা আলাউদ্দীন কায়কুবাদের উপর হামলা চালিয়েছে। তিনি শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। কেননা কুনিয়ার সুলতান ছিলেন মুসলমান, আর মোঙ্গলরা ছিল কাফির। মোঙ্গলরা মুসলিম বিশ্বকে ইতিমধ্যে ধ্বংস করে ফেলেছিল। সুলায়মান খান আলাউদ্দিন কায়কুবাদকে সাহায্য প্রদান এবং এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাকে শাহাদাত লাভের শ্রেষ্ঠ সুযোগ মনে করে নিজ গোত্রকে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আদেশ দেন। সুলায়মান খানের এই বাহিনীর সঠিক সংখ্যা জানা যায় নি, তবে সুলায়মান খান এই বাহিনীর যে অংশকে অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে নিজ পুত্র এরতুগরুলের নেতৃত্বে রওয়ানা করেছিলেন তার সংখ্যা ছিল ৪৪৪ জন। দুনিয়ার বড় বড় এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যেমন প্রায় ক্ষেত্রে আকস্মিকভাবে ঘটে থাকে, তেমনি সুলায়মান খানের এই ঘটনাও আকস্মিকভাবে ঘটেছিল। এদিকে এরতুগরুলের মুজাহিদ বাহিনী যখন অগ্রসর হচ্ছিল ঠিক তখন মোঙ্গল বাহিনী আলাউদ্দিন কায়কুবাদের বাহিনীর সম্মুখে গিয়ে পৌছেছিল। সালজুক বাহিনী ও মোঙ্গলদের মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে যায়। মোঙ্গল বাহিনী ছিল দুরন্ত ও দুর্ধর্ষ। তারা অতি শীঘ্রই সেলজুক বাহিনীকে কোনঠাসা করে ফেলে। সেলজুক বাহিনী যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখন এরতুগরুলের বাহিনী সেখানে উপস্থিত হয়। তিনি দু’টি বাহিনী যুদ্ধরত অবস্থায় দেখতে পান। এরতুগরুল জানতেন না, কে কোন পক্ষ। তবে তিনি ততক্ষণাৎ মনস্থির করেন যে, তিনি দূর্বল পক্ষকেই সমর্থন করবেন এবং সাথে সাথে তার ৪৪৪ জন সঙ্গী নিয়ে দূর্বল পক্ষের দিক থেকে সবল পক্ষের উপর সিংহ বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়েন। এত দৃঢ়তা ও দুঃসাহসিকতার সাথে এই আকস্মিক হামলা চালানো হয় যে, মোঙ্গলরা শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে তাদের অসংখ্য লাশ ফেলে রেখে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। আলাউদ্দীন সালজুকী কিছুক্ষণ আগেই যেখানে পরাজয় ও ধ্বংসকে অবধারিত মনে করেছিলেন সেখানে অকস্মাৎ এই অকল্পনীয় সাহায্য এবং বিজয় প্রত্যক্ষ করে তিনি যারপর নাই উল্লসিত হন এবং এরতুগরুলকে রহমতের ফেরেশতারুপে মনে করে তাকে জড়িয়ে ধরেন। এরতুগরুলও উদ্দেশ্য সফল হওয়ায় অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। এরতুগরুল ও আলাউদ্দীন কায়কুবাদ যখন বিজয়ের আনন্দে মত্ত ছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তে সুলায়মান খান তার মূল বাহিনী নিয়ে সেখানে পৌছান। আলাউদ্দিন সালজুকী সুলায়মান খান ও তার পুত্র এরতুগরুলকে মূল্যবান পরিধেয় উপহার দেন। তিনি খুশি হয়ে এরতুগরুলকে আংগোরার(বর্তমান আঙ্কারা) নিকট কারাকা ডাগের জায়গীর প্রদান করেন এবং সুলায়মান খানকে নিজস্ব বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করেন।

এখানে আলাউদ্দীন সালজুকীর তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দূরদর্শিতার কথা স্বীকার করতেই হবে যে, তিনি এরতুগরুলকে সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ এলাকাটি ঠিক করেন। কুনিয়া সাম্রাজ্য প্রথমে বেশ বড় ছিল। কিন্তু রোমান আর মোঙ্গলদের চাপে পড়ে কুনিয়ার একেবারে চিড়া-চ্যাপ্টা হওয়ার উপক্রম হয়েছিল এবং আয়তন ক্রমশ হ্রাস পেতে পেতে তা একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের আকার ধারণ করেছিল যার অস্তিত্ব যে কোন মুহুর্তে বিলীন হয়ে যেতে পারত। যা হোক, কারাকা ডাগের অবস্থান ছিল একেবারে রোমান সীমান্তে। ১২৫১ সালে এরতুগরুল নাইসিয়ান শহর থেবাসিওন জয় করেন। এর নতুন নামকরণ করা হয় সোগুত এবং এটি তার সাময়িক রাজধানী হয়। তার এই কৃতিত্বপূর্ণ কাজের পুরস্কারস্বরুপ সুলতান আলাউদ্দীন সালজুকী এরতুগরুলকে আরো কিছু এলাকা ছেড়ে দেন। এরতুগরুল আরও শক্তিশালী হয়ে উঠায় রোমানদের দিক থেকে আক্রমণের আশংকা লোপ পায়। কিছুদিন পরে পিতা সুলায়মান খান ফুরাত অতিক্রমকালে পানিতে ডুবে মারা যান। এদিকে এরতুগরুল নিজ এলাকা শাসন করে যাচ্ছিলেন এবং নিজের রাজ্যের পরিধি ক্রমাগত বৃদ্ধি করছিলেন। এভাবে এরতুগরুলের একটি উল্লেখযোগ্য রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ওদিকে মোঙ্গলদের ক্রমাগত আক্রমণ সেলজিক সুলতানকে ব্যতিব্যস্ত রাখে এবং শেষ অবধি ৬৪১ হিজরীতে মোঙ্গলরা কুনিয়াকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করে। এতে অবশ্য এরতুগরুল কিছু হলো না। কারণ তিনি ছিলেন মোঙ্গলদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মোঙ্গলরা এশিয়া মাইনরের এই ছোট ছোট রাজ্যগুলোর ব্যাপারে কোনরুপ নাক না গলিয়ে তাদেরকে তাদের মত থাকতে দেয়। ৬৩৪ হিজরী (১২৩৬-৩৭ খ্রীঃ) আলাউদ্দীন কায়কোবাদ মারা গেলে তার পুত্র গিয়াসুদ্দীন কায়খসরু কুনিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন।

উসমানীয় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন

এর মধ্যে এরতুগরুল বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হোন। তার স্ত্রী ও উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের মাতা, সেলজুক সাম্রাজ্যের শাহজাদা নোমানের কন্যা হালিমা খাতুন। ৬৫৭ হিজরীতে এরতুগরুলের ঘরে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয় এবং তার নাম রাখা হয় উসমান খান। তাঁর জন্ম ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে, যে বছর মঙ্গোলরা বাগদাদ ধ্বংস করে। ইনি হছেন সেই উসমান খান, যার নামানুসারে তুর্কি বাদশাহদেরকে সালাতীনে উসমানীয়া বা উসমানীয় সুলতান বলা হয়। ১২৮৭ সালে যখন উসমানের বয়স ত্রিশ বছর তখন এরতুগরুলের মৃত্যু হয়। এ সময় কুনিয়া-সম্রাট এরতুগরুলের সমগ্র এলাকার শাসনক্ষমতা উসমান খানকে প্রদান করেন। উসমান খানের যোগ্যতার পরিচয় পেয়ে কুনিয়ার বাদশা গিয়াসুদ্দীন কায়খসরু ঐ বছরই তাকে নিজ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করে তার সাথে নিজের মেয়ের বিবাহ দেন। এবার উসমান খান কুনিয়া শহরে বসবাস করতে থাকেন এবং অতি শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রী পদে উন্নীত হন।
১২৯৯-১৩০০ খ্রীস্টাব্দে মোঙ্গলদের সাথে এক যুদ্ধে কায়খসরু নিহত হন। তার কোন পুর সন্তান ছিল না। একটি মাত্র কন্যা সন্তান ছিল। তার সাথেই উসমান খান পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কাজেই সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সর্বসম্মতিক্রমে উসমান খানকে কুনিয়ার নতুন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। এভাবে ইসরাঈল ইবনে সালজুকের বংশধররা যে সাম্রাজ্য ৪৭০ হিজরীতে (১০৭৭-৭৮ খ্রীঃ)কায়েম করেছিল তার বিলুপ্তি ঘটে এবং তদস্থলে উসমানীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

উসমানের একটি স্বপ্ন

উসমান গাজি বিখ্যাত শাইখ এদিবালিকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তার মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি প্রায়ই এসকিশেহিরে এদিবালির সাথে সাক্ষাত করতেন।

এক রাতে এদিবালির দরগাতে অবস্থান করার সময় দেখা স্বপ্ন পরের দিন তিনি এদিবালিকে জানান। তিনি বলেন, “আমার শাইখ, স্বপ্নে আমি আপনাকে দেখেছি। একটি চাঁদ আপনার বুকে দেখা দিয়েছে। এটি উঠতে থাকে এবং আমার বুকে এসে অবতীর্ণ হয়। আমার নাভি থেকে একটি গাছ উঠে। এটি বৃদ্ধি পায় এবং শাখাপ্রশাখা এত বেশি হয় যে এর ছায়া পুরো পৃথিবীকে আবৃত করে ফেলে। এই স্বপ্নের অর্থ কী??”

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর এদিবালি ব্যাখ্যা দেন:

“অভিনন্দন উসমান! সর্বশক্তিমান আল্লাহ তোমার এবং তোমার বংশধরদেরকে সার্বভৌমত্ব প্রদান করেছেন। আমার কন্যা তোমার স্ত্রী হবে এবং সমগ্র বিশ্ব তোমার সন্তানদের নিরাপত্তাধীন হবে।”

উসমানের স্বপ্ন উসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্থানে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। উসমানীয় পণ্ডিতদের কাছে এই স্বপ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক উপাদান ছিল।

উপসংহার

উসমানীয় খিলাফত আব্বাসীয় খিলাফতের পর খিলাফতে আসীন হয়। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই খিলাফত টিকে ছিল। ৬২৪ বছরের বর্ণালী ইতিহাসে ওসমানী সাম্রাজ্য নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে যায়। ওসমানীগণ নিজেদের ব্যাপারে এবং পৃথিবীতে তাদের ভূমিকা নিয়ে কি ধারণা পোষণ করতেন তা পরিপূর্ণরূপে অনুধাবন করতে হলে তাঁদের শিকড় ও উত্থানকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। গাজী সমাজকে ঘিরে ছোট্ট তুর্কী বেইলিক থেকে একসময় তাঁরা আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হন। শুরুর দিকেই গাজী জীবনব্যবস্থা ও ইসলাম রক্ষার ব্যাপারে ওসমানীগণ যে গুরত্বারোপ করতেন, তা দেখে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে এই সাম্রাজ্য ১৫ ও ১৬ শতকে তাদের স্বর্ণযুগে পৌঁছেছিল। সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ সীমায় পৌছানোর সময় উসমানীয়রা কনস্টান্টিনোপল থেকে আনাতোলিয়া, অধিকাংশ মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, ককেশাস এবং পূর্ব ইউরোপের অনেক গভীর পর্যন্ত শাসন করতেন।

Related posts

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের অনন্য ভূমিকা

News Desk

বাংলা নববর্ষে ঐতিহ্যের ধারক কটিয়াদীর গাছতলার পূজা

News Desk

মানুষের চিড়িয়াখানা : ইতিহাসের ভয়ংকর অধ্যায়

News Desk

Leave a Comment