মিয়া তানসেন (১৫০৬ – ১৫৮৯) প্রায় সকল বিশেষজ্ঞের ধারণা মতে উত্তর ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ। বর্তমানে আমরা যে হিন্দুস্তানী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সাথে পরিচিত তার মূল স্রষ্টা হলেন এই তানসেন। তার এই সৃষ্টি যন্ত্র সঙ্গীতের এক অনবদ্য অবদান। বহু প্রাচীনকালে সৃষ্টি হলেও এখন পর্যন্ত এর প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে। তার কর্ম এবং বংশীয় উত্তরাধিকারীদের মাধ্যমেই মূলত এই ধারাটি আজও টিকে রয়েছে। তিনি মুঘল বাদশাহ আকবরের রাজদরবারের নবরত্নের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাকে সঙ্গীত সম্রাট নামে ডাকা হয়।
১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি ভারতের গোয়ালিয়রে বিহাট নামক গ্রামের এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মুকুন্দ পাঁড়ে ছিলেন একজন কবি। অনেকের মতে তাঁর পিতার নাম ছিল মকরন্দ পাঁড়ে। মুকুন্দ পাঁড়ের স্ত্রী প্রতিবার সন্তান জন্ম দেওয়ার পরই সন্তানের মৃত্যু হতো। এর প্রতিকার হিসেবে গোয়ালিয়রের প্রসিদ্ধ সিদ্ধ পুরুষ মুহম্মদ গওস-এর কাছ থেকে মাদুলি আনেন। এরপর ১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দে (মতান্তরে ১৫০৫ খ্রিষ্টাব্দ) তানসেনের জন্ম হয়। পিতামাতা তানসেনের নাম রেখেছিলেন রামতনু ।
ছোটবেলা থেকেই তানসেন সঙ্গীত শিক্ষা করতে শুরু করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাগুরু ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত সঙ্গীত শিক্ষক হরিদাস স্বামী।এই শিক্ষায় তার গুরু ছিলেন বৃন্দাবনের তৎকালীন বিখ্যাত সঙ্গীত শিক্ষক হরিদাস স্বামী। এ বিষয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে হরিদাস স্বামী তীর্থে যাচ্ছিলেন। এই সময় গাছের আড়াল থেকে তানসেন বাঘের গর্জন করে স্বামীজীকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেন। পরে তার মেধা দেখে স্বামীজি কাছে ডেকে কথা-বার্তা শুনে খুশি হন। কোনো কোনো মতে, স্বামীজী তাঁর কাছে কিছু গান শুনে বিস্মিত হন। পরে তাঁর বাবাকে বলে সাথে করে বৃন্দাবন নিয়ে যান। প্রায় ১০ বৎসর তিনি বৃন্দাবনে এই গুরু কাছে সঙ্গীতের পাঠ গ্রহণ করে নিজগ্রাম বিহাটে ফিরে আসেন এবং স্থানীয় শিবমন্দিরে সঙ্গীত সাধনা শুরু করেন। বাবা-মার মৃত্যুর পর তিনি হযরত গোয়ালিয়রে সাধক গাউসের নিকট আসেন। তিনি একই সাথে তানসেনের সাঙ্গীতিক ও আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন। এই সাধকের সাথে তিনি দশ বৎসর কাটান।
সে সময় গোয়ালিয়রের পরলোকগত সঙ্গীতজ্ঞ রাজা মানসিংহ তোমরের বিধবা পত্নী রাণী মৃগনয়নীর গানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর গান শোনার জন্য এবং তাঁকে গান শোনার জন্য রাজদরবারে যান। এই আসরে তানসেন ও মৃগনয়নী দুজনে দুজনার গান শুনে মুগ্ধ হন। এরপর গোয়ালিয়রের রাজদরবারে তাঁর নিয়মিত আসাযাওয়া শুরু হয়। এই আসরে মৃগনয়নীর শিষ্যদের মধ্যে প্রেমকুমারীর সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে। পড়ে উভয়ের বিবাহ হয়। এই বিবাহের আগে বা পড়ে একসময় তানসেন মুহম্মদ গওস-এর প্রভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তাঁর নতুন নাম হয় আতা আলী খাঁ।
এরপর তিনি আবার হরিদাস স্বামীর কাছে ফিরে যান এবং সেখানে সঙ্গীত সাধনা করতে থাকেন। এরপর তাঁর সাধক গাওস অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় তিনি কিছুদিনের জন্য গাওসের সেবা করার জন্য তাঁর কাছে কাটান। সাধ্ক গাওস মৃত্যুকালে তাঁর সমুদয় সম্পত্তি তানসেনকে দান করে যান। এরপর থেকে তিনি সপরিবারে গোয়ালিয়রে বসবাস করতে থাকেন।
এই শিক্ষা শেষে তিনি মেওয়া বান্ধবগড়ের রাজা রামচন্দ্রের রাজদরবারে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। এই সময় তিনি বান্ধবগড়ে বসবাস শুরু করেন। ক্রমে তাঁর সঙ্গীতখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে, মোগল বাদশাহ আকবরের রাজ দরবারে ডাকেন। তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে, তিনি মোগল দরবারের সভাগায়ক হিসেবে স্থান দেন। কালক্রমে তিনি আকবরের নবরত্নের একজন হিসেবে সঙ্গীতের সাধনা শুরু করেন। যতদূর জানা যায়, তিনি ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মোগল দরবারের সভাগায়ক হিসেবে স্থান লাভ করেছিলেন।
এক সঙ্গীত আসরে সম্রাট আকবর তানসেনের গানে মুগ্ধ হয়ে নিজের গলার বহুমূল্যবান কণ্ঠহার তাঁকে পরিয়ে দেন। তার আর্থিক মূল্য সেসময় ছিল ১৮ লাখ টাকা। অনেক সময় সম্রাট সামনাসামনি গান শুনে তৃপ্ত হতেন না। তিনি গভীর রাতে ছদ্মবেশে একাকী চুপিচুপি তানসেনের গান শুনতেন। সম্রাট আকবর নিজেই তাকে তানসেন উপাধি দেন। তানসেন মানে সুরলহরী দিয়ে যিনি চেতনা ফেরাতে সক্ষম। আবার কোনো কোনো মতে তিনি তানসেন উপাধি আগের দুই রাজদরবারের কোনো একটি থেকে পেয়েছিলেন।
গাউসের সমাধি
১৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। গোয়ালিয়রের তাঁর গুরু সাধক শেখ মুহাম্মদ গাউসের সমাধির কাছে তাঁর কবর দেওয়া হয়।গোয়ালিয়রের মহান সুফি সাধক শেখ মুহাম্মদ গাউসের সমাধি কমপ্লেক্সেই মিয়া তানসেনে সমাধি রচিত হয়েছিল। এখনও এটি বিদ্যমান রয়েছে। শেখ মুহাম্মদ গাউস ষোড়শ শতাব্দীর অন্যতম সুফী দরবেশ ও ফকির ছিলেন। সকল ধর্ম বিশ্বাসের লোকের কাছে তিনি স্বনামধন্য ছিলেন। গাউস এবং তানসেনের দুইটি সমাধি পাশাপাশি রয়েছে। এছাড়াও এই সমাধি সৌধে অন্যান্য কবর রয়েছে। প্রথাগত মুঘল স্টাইলে এই কমপ্লেক্সটি তৈরি করা হয়েছে। সমাধি ক্ষেত্রটি একটি বিশাল বর্গাকার মাঠের মত যার কেন্দ্র রয়েছে ষড়ভূজ আকৃতির কিছু স্তম্ভ। সমাধি সৌধের দালানগুলোর দেয়ালের মধ্যে পাথর কেটে নকশা করা হয়েছে। দেয়ালের একেক অংশে নকশা একেক রকম। পুরো দালানের উপর বিস্তৃত অংশ জুড়ে একটি বৃহৎ মিনার রয়েছে যা একসময় নীল রঙা টাইল্স দ্বারা আবৃত ছিল। সাধু গাউসের সমাধির ডান পাশে তানসেনের সমাধি অবস্থিত। সমাধিটি একটি বর্ধিত আয়তাকার কাঠামোর উপর অবস্থিত। কাঠামোটি মার্বেল পাথর দ্বারা নির্মিত। এর চারদিকে ছাঁইচবিশিষ্ট (eaves) প্যাভিলিয়ন রয়েছে যা বিভিন্ন নকশায় সুশোভিত।
তানসেনের দুজন স্ত্রী ও পাঁচজন সন্তানের খবর পাওয়া যায়। সন্তানদের নাম ছিল শরৎসেন, সুরতসেন, তরঙ্গসেন, বিলাস খাঁ ও সরস্বতী।
তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।। এই গ্রন্থ দুটি হলো— রাগমালা ও সঙ্গীতসার। তাঁর আবিষ্কৃত রাগ হিসেব যে রাগগুলোর নাম পাওয়া যায়, তা হলো দরবারী-কানাড়া, মিঞা কি মল্লার, মিঞা কি সারং মিঞাকি টোড়ি (টোড়ি)।