উইঘুর শব্দের অর্থ হলো ‘নতুন সীমান্ত’। উইঘুররা মূলত মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত তুর্কি বংশোদ্ভুত জাতিগোষ্ঠী, যারা চীনের শিনচিয়াং/জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাস করে। চীনের জিনজিয়াং ও হুনান ছাড়াও কাজাখাস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক, জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন এসব দেশেও উইঘুরদের বসবাস রয়েছে। চীনের উইঘুররা সুন্নি ইসলামে বিশ্বাসী। তারা নিজেদের পূর্ব তুর্কিস্তানও দাবী করে থাকে। যারা মূলত তুর্কি এবং রাষ্ট্রীয় মান্দারিন ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। জিনজিয়াং প্রদেশে মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ (২০১৯)। এর মধ্যে উইঘুরদের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ যা জিনজিয়াং এর মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক এবং পুরো চীনের মোট জনসংখ্যার ১-২ ভাগ।
অতীতে উইঘুররা ছিল স্বাধীন, তাদের দেশের নাম ছিল উইঘুরিস্তান। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক চীনারা এই মুসলিমদের কাছ থেকে তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি, বঞ্চিত করছে তাদের ধর্ম পালনের অধিকার থেকে। উইঘুর মুসলিমদের নামাজ আদায় ও রোজা পালনে রয়েছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা। এমনকি এখানকার মুসলিম পুরুষদের দাঁড়ি রাখা ও নারীদের হিজাব পড়ার অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে চীনা সরকার।
ইতিহাস পর্যালাচনায় উইঘুর কারা ?
উইঘুর জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর আগের। মূলত, এরা স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার একটি দেশ, যার চতুর্পাশ্বে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশেই উইঘুর সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে।
সিআইএর ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক অনুযায়ী চীনের মোট জনসংখ্যার ১ থেকে ২ শতাংশ মুসলিম। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদনে দেখা যায়, মুসলিমরা চীনা জনসংখ্যার ১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০০৯ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, এসব দেশের মধ্যে চীনের জিনজিয়াংয়ে ১ কোটি ২০ হাজারের মতো উইঘুর লোক বসবাস করে। কাজাখস্তানে ২ লাখ ২৩ হাজার, উজবেকিস্তানে ৫৫ হাজার, কিরগিজস্তানে ৪৯ হাজার, তুরস্কে ১৯ হাজার, রাশিয়ায় ৪ হাজার, ইউক্রেনে ১ হাজারের মতো উইঘুর লোক বাস করে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও প্রাচীন এ সম্প্রদায়ের লোকদের উইঘুর না বলে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। মূলত, ১৯২১ সালে উজবেকিস্তানে এক সম্মেলনের পর উইঘুররা তাদের পুরোনো পরিচয় ফিরে পায়। ভাষাবিদ ও ইতিহাসবেত্তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন যে ‘উইঘুর’ শব্দটি ‘উয়্যুঘুর’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ সংঘবদ্ধ।
১৯১১ সালে মাঙ্কু সাম্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ব তুর্কিস্তানে চীনা শাসন চালু হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনচেতা বীর উইঘুররা এই বৈদেশিক শাসনের সামনে মাথা নোয়ায়নি। এ কারণে ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে তারা দুবার চীনাদের সঙ্গে সাহসিকতার চরম রূপ দেখিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ভাগ্য তাদের অনুকূলে ছিল না। এ কারণে ১৯৪৯ সালে আবারও তারা চীনা কমিউনিস্টদের হাতে পরাজিত হয় আর জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গড়ে ওঠে। তখন সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির গভর্নর ছিলেন সাইফুদ্দিন আজিজি।
জিনজিয়াং চীনের অন্যতম সর্ববৃহৎ একটি অঞ্চল। এর আয়তন ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার (বাংলাদেশের আয়তনের ১২ গুণ)। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এ এলাকা আয়তনে চীনের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। এর পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে আছে মুসলিম দেশ তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান ও কাজাখস্তান; আর দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে আফগানিস্তান ও জম্মু-কাশ্মীর। জিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখের মতো। এর মধ্যে মুসলমান প্রায় ১ কোটি ২৬ লাখ। প্রায় ৫৮ শতাংশ মুসলিম।
উইঘুরদের মুসলমান হওয়ার ইতিহাস
,উইঘুররা মুসলিম হয়েছিল উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ওয়ালিদের শাসনামালে। যখন তাঁর বিখ্যাত চার সেনাপতি পৃথিবীর চারদিকে অভিযান পরিচালনা করেছেন।ইতিহাসে আর কোন নৃপতিরা একসাথে এত জন বিজয়ী সেনাপতি ছিল কিনা আমার জানা নেই, এটাও জানা নেই যে এতো বিখ্যাত কোন সেনাপতির এমন করুন অবস্থা হয়েছিল কি না সেটাও। বিখ্যাত এই চার সেনাপতির মধ্যে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ৭১১ খৃষ্টাব্দে বিজয় অভিযান পরিচালনা করেছেন মোহাম্মদ বিন কাসেম,মধ্যে এশিয়ায় ৭১২ খৃষ্টাব্দে কুতায়বা ইবনে মুসলিম,তাঁর মাধ্যমে ই এই মাজলুম উইঘুররা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
স্পেনে৭১১ খৃষ্টাব্দে তারেক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইর। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এই চারজন দিগ্বিজয়ী সেনাপতিকেই চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছিল।তাদের মতনই যেন তাদের হাতে বিজিত অঞ্চলের মুসলিমরাও আজ চরম নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার। স্পেনে প্রায় ৮০০ বছর মুসলিম শাসন থাকলেও তাদেরকে সেখান থেকে এমনভাবে নিচিহ্ন করা হয়েছে যে কোনকালে এই দেশটি মুসলিমরা আবাদ করেছে সেটা বুঝার আর কোন উপায়ই আজ বাকি নেই।মধ্য এশিয়ার উইঘুররা ছাড়া অন্যান্য দেশসমূহ দীর্ঘদিন সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট শাসনাধীন থেকে তাদের করুন অবস্থার কথা ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালেই বুঝতে পারা যায় আর সেখানকার চেচনিয়া বসনিয়ার কথা আর নাইবা বললাম। বাকি থাকলো আামাদের ভারতীয় উপমহাদেশের কথা,ভারতবর্ষে সুলতানী আমল ও মুঘল আমল মিলিয়ে মুসলমানরা ৮০০ বছর শাসন করেছে,সুলতান আর মুঘলরা এই ভারতবর্ষকে আপন করে সাজিয়েছে কিন্তু বর্তমান সময়ে শ্রীলঙ্কা,মায়ানমার,ভারতের মুসলিমদের কী অবস্থা, কাস্মীরের কেমন পরিস্থিতি সেটা বোধকরি নতুন করে বলার কিছু নেই। মাঝে মাঝে আমার দেশটির কথা ভাবি,আল্লাহ আমাদেরকে স্বাধীনতার যে নিয়ামত প্রদান করেছেন তা কি আমরা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবো? ভিনদেশী হায়েনা আর তাদের এদেশীয় দালালদের কার্যক্রম দেখলে বড্ড ভয় লাগে আবার যুবকদের দেশপ্রেম আর স্বদেশপ্রীতি দেখলে মনে আশা জাগে।
উইঘুরদের মুসলিম হওয়ার পরের ধারাবাহিক ইতিহাস
৭৫৫ সালে আন লু সান নামের একজন জেনারেল চীনের কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজের অধীনে থাকা অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করলেন। চীনের কেন্দ্রীয় শাসক চীনা সম্রাট এই বিদ্রোহ দমনের জন্য উইঘুর খানাতেরর কাছে সাহায্য চাইলেন।(খানাত বা খাগানাত তুর্কি শব্দ যা খান শাসিত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নির্দেশ করে) সম্রাট উইঘুর খানাতের সহায়তায় আন লু সাং এর বিদ্রোহ দমন করার পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে খোদ খানাতকেই দখল করে নিতে উদ্যত হল।
স্বাধীনচেতা উইঘুর খানাত স্বল্প শক্তি আর স্বল্প জনবল হওয়া সত্ত্বেও বিপুল জনবল আর শক্তিশালী চিনা সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। কিন্তু একটা সময় বিপুল সংখ্যক উইঘুর নিহত হবার পরে স্বল্পসংখ্যক বেঁচে থাকা উইঘুর পিছু হটে এবং কোচো রাজত্বে আশ্রয়গ্রহণ করে।সেই থেকে শুরু হয় তাদের টিকে থাকার লড়াই। ১০০৬ সালে উইঘুরদের ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হলেন তুর্কি বীর ইউসুফ কাদির খান। তাঁর নেতৃত্বেই পুনরায় মুসলিম সালতানাত ‘কারা খানিদ খানাত’ প্রতিষ্ঠিত হয়।১৮ শতকের শেষের দিকে কিং রাজারা জুনগড় এবং তারিম উপত্যকার পূর্বাঞ্চল দখলের মাধ্যমে স্বাধীন উইঘুর রাজ্যকে নিজেদের অধীনে নিয়ে নেয়।
এবার উইঘুরদের ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন তাসখন্দ নিবাসী ইয়াকুব বেগ।এই ইয়াকুব বেগ এর নেতৃত্বে উইঘুররা সংঘটিত হয় এবং কিং রাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাশগরের আশপাশের অঞ্চল নিয়ে গড়ে তোলে শরিয়াভিত্তিক স্বাধীন কাশগরিয়া রাষ্ট্র।এই কাশগরিয়া রাষ্ট্রকেই আধুনিক পূর্ব-তুর্কিস্তান এর ভিত্তি ধরা হয়।তুরস্কের উসমানি খেলাফতের খলিফা তাঁকে সমর্থন দিয়ে ‘আমিরুল কাশগরিয়া’ উপাধি প্রদান করেন। ১৮৮৭ সালের ২২ মে ইয়াকুব বেগ মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর মৃত্যুর পর পরই চীনের কিং রাজা ও রাশিয়ার জার শাসকরা স্বাধীন ইসলামী উইঘুর এই রাষ্ট্রটিকে দখল করে নিতে উঠেপড়ে লাগে।
প্রায় সাত বছর লড়াই করার পরে ১৮৮৪ সালের ১৮ নভেম্বর চীনের মাঞ্চু বা কিং রাজা কাশগর কেন্দ্রীক পূর্ব তুর্কিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে দখল করে নেয় এবং সেই সাথে ইয়াকুব বেগের চার সন্তান,নাতি নাতনি ও চার স্ত্রীদের সবাইকে বন্দী করা হয়।বিভিন্ন মেয়াদে তাদেরকে শাস্তি দিয়ে মাত্র ১১ বছরের মধ্যে সবাইকেই শহীদ করা হয়। ( সূত্র -উইঘুরের কান্না-মুহসিন আবদুল্লাহ,পৃষ্ঠা ১১-১৭)
১৯১১ সালে স্বাধীন তুর্কিস্তানে চীনের মাঞ্চু সাম্রাজ্যের পতনের পর সেখানে প্রত্যক্ষ চীনা শাসন চালু করে এ অঞ্চলকে চীনের জিনজিয়াংয়ের সাথে একীভূত করা হয়। (সূত্র-দৈনিক যায়যায়দিন, ২৫ মে,২০১৯)
১৯৩৩ সালে পুনরায় উইঘুর মুসলিমরা কাশগর ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তান রাষ্ট্র। চাইনিজ জেনারেল শেং শি চাই এর নেতৃত্বে চাইনিজ হানরা এই স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে বেশিদিন স্বাধীন থাকতে দেয়নি।দখলদার চাইনিজ (হানদের) ব্যাপক হামলা আর আক্রমণের মুখে অল্প দিনেই এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। ১৯৪৪ সালে তুর্কিস্তান ইসলামী পার্টি নেতৃত্বে তিয়েশান পর্বতমালার ওপারে ঘুলজা এবং এর আশপাশের অঞ্চলে বিপ্লবের মাধ্যমে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় উইঘুর মুসলিমদের পূর্ব-তুর্কিস্তান।
১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর ১৩ ই অক্টোবর চীন সরকার পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করে নেয়। চীন সরকারের এই দখলদারির বিরুদ্ধে উইঘুররা সশস্ত্র প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। তাদের এই লড়াই ৬ বছর অব্যহত থাকার পরে ১৯৫৫ সালের ১লা অক্টোবর কমিউনিষ্ট বাহিনী পুরো উইঘুর এলাকার দখল নেয়।
১৮৮৪ সালে কিং রাজত্বের সময় জিনজিয়াং চীনের একটি প্রদেশ হয়। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চীনা কমিউনিস্ট সেনারা জিনজিয়াংয়ে অভিযান চালায়। এর সূত্র ধরে চীনের হান সামরিক গোষ্ঠী জিনজিয়াংয়ে অভিবাসী হয়েছে। ১৯৫৫ সালে জিনজিয়াং চীনের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। হান সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের বিরুদ্ধে এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে বহু মানুষ নির্যাতিত হয়। বিপুল সংখ্যায় কাজাখ জনগোষ্ঠী পার্শ্ববর্তী কাজাখস্তানে পালিয়ে যান। এরপর থেকে উইঘুর মুসলমানদের সঙ্গে চীনা কর্তৃপক্ষের বিরোধ সৃষ্টি হয়। একসময় তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। গত শতাব্দীর শেষে উইঘুর মুসলমানরা স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে।
উইঘুরের উপর নির্যাতন হচ্ছে কি?
একবার চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা আপনার বাড়িতে ঢুকে প্রিয়জনদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের রাখা হচ্ছে ক্যাম্পে। সন্তানদের ধরে নিয়ে রাখা হচ্ছে ক্যাম্পে। এ অবস্থা চীনের উইঘুর সম্প্রদায়ের।রুকিয়ে তুরদুশ একজন উইঘুর কর্মী। উইঘুর কানাডা সোসাইটির সাবেক সভাপতি তুরদুশ গয়নার ব্যবসা করেন। চার বছর ধরে তিনি নিয়মিত তুরস্ক ও চীনে যাতায়াত করেন। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর পরিবারের সদস্যরা কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই গ্রেপ্তার হন। চীনে তাঁর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। তুরদুশের হারানোর কিছুই নেই। কারণ, তাঁর স্ত্রীকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই গ্রেপ্তার করেছে চীনের সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী। তুরদুশ জানেনও না তাঁর দুই সন্তান কোথায়?
রুকিয়ে তুরদুশের এ গল্প শুধু একজন ব্যক্তির নয়, পুরো উইঘুরের প্রায় সবার জীবনের গল্পটাই এক সুতায় গাঁথা। গল্পের উপাদান, স্থান, কাল, পাত্র হয়তো আলাদা, কিন্তু পরিণতি সবার একই। অথচ পুরো বিশ্বের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা যেন নেই, যেমন আছে সাংবাদিক জামাল খাসোগি ও সিরিয়ার হামলা নিয়ে।রুকিয়ে তুরদুশরা শান্তি, নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা চান। তুরদুশের মতো যাঁরা চীনের বাইরে থাকেন এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না, তাঁরা চীনে শান্তির জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করছেন।
এ বছরের আগস্টে জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে চীনের ‘সন্ত্রাসবাদ’ কেন্দ্রগুলোয় আটক রাখা হয়েছে। ২০ লাখ মানুষকে ‘রাজনৈতিক ও রাজনৈতিক পুনর্বিবেচনার শিবিরে’ অবস্থান করতে বাধ্য করা হয়েছে। চীন সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। কমিটির প্রতিবেদনগুলো প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদও জানায় সি চিন পিংয়ের দেশ।
ধর্মীয় স্বাধীনতায় নগ্ন হস্তক্ষেপ
ধর্মীয় ক্ষেত্রে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীন সরকারের নীতির কঠোর সমালোচনা করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ২০০৯ সালের দাঙ্গার পর চীনা সরকারের সমালোচনা করে শান্তিপূর্ণভাবে মতামত প্রকাশের দায়ে চীন সরকার গোপনে বেশ কয়েকজন উইঘুর মুসলিম বুদ্ধিজীবীর বিচার করেছে। তারা আরও বলেছে, ধর্ম নিয়ন্ত্রণ এবং সংখ্যালঘুদের ভাষাশিক্ষা নিষিদ্ধ করার চীনা নীতি জিনজিয়াংয়ে অস্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ।
চরমপন্থী মতাদর্শের শিক্ষা চালু
জিনজিয়াংয়ে স্থানীয় আইন পরিবর্তন করে শিক্ষা শিবিরের ‘চরমপন্থী মতাদর্শিক শিক্ষা’ বাস্তবায়নের অনুমতি দিয়েছে চীন। বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এসব শিবিরে বন্দীদের মান্দারিন ভাষা শিখতে বাধ্য করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসার কথা বলা এবং তাদের সঠিক আচরণ পরিচালনার নিয়মগুলো কঠোরভাবে মনে রাখতে বাধ্য করা হয়। এ অভ্যাসগুলোর অংশ হিসেবে চীন সরকার সাংঘর্ষিকভাবে জিনজিয়াংয়ের উইঘুর সংস্কৃতি ও জাতিগত সত্তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এই শিক্ষাশিবিরের পাশাপাশি উইঘুর শিশুদের ক্যাম্প ও স্কুল রয়েছে, যেখানে তাদের পরিবার, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে ফেলা হয়।
মেকিং ফ্যামিলি
মেকিং ফ্যামিলি নামে আসলে উইঘুরে মুসলিমদের উপর নেমে আসে ধর্মীয় নিপিড়ন। যদিও সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামী ধর্মান্ধতা এখন বিষ ফোঁড়া।যদিও এটা মানুষের মুক্তচিন্তার সত্বা থেকে দূরে ঠেলে নেয়।সাময়িকভাবে এটা অমানবিক মনে হওয়া স্বাভাবিক। অন্য কোন উপায়ে হয়তোবা ভাল সমাধান নিয়ে আসতে পারতো।২০১৬ সালে ‘মেকিং ফ্যামিলি’ নামের একটি উদ্যোগ চালু করে চীন। এর মাধ্যমে উইঘুর পরিবারকে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে পাঁচ দিনের জন্য তাদের ঘরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের হোস্ট করতে বাধ্য করে। চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে উইঘুরদের ধর্মীয় পরিচয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে।
চীন সরকার উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমনের জন্য তিনটি অভিযোগ ব্যবহার করেছে—চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ। প্রথম অভিযোগ, যেকেউ গৌরব প্রকাশ করে তাদের উইঘুর পরিচয় প্রকাশ করে। আবার শিক্ষাশিবিরে পাঠানো লাখো বিশিষ্ট উইঘুর ব্যক্তিত্ব গত কয়েক বছরে আটক বা অদৃশ্য হয়ে গেছেন। এঁদের মধ্য আছেন ইসলামি শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ সালিহ হাজিম, অর্থনীতিবিদ ইলহাম তোকতি, নৃতাত্ত্বিক রাহাইল দাউদ, পপশিল্পী আবদুর রহিম হায়াত, ফুটবল খেলোয়াড় এরফান হিজিম প্রমুখ।
এতো নির্যাতন তবুও মুসলিম অধ্যুষিত দেশে নিরব কেন?
চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়কে টার্গেট করে বেইজিংয়ের কঠোর দমন-পীড়ন তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে সমালোচিত হয়ে এলেও যেন এই নিপীড়নের পক্ষেই সাফাই গাইলেন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স বা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদি আরবের রাজ সিংহাসনের এই প্রথম উত্তরাধিকারী কথিত ‘সন্ত্রাস দমন’ ও ‘উগ্রবাদ ঠেকাতে’ চীনের কঠোর দমননীতির সাফাই গেয়ে বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে ‘উগ্রবাদ প্রতিহত করতে’ ও ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ পদক্ষেপ বাস্তবায়নের অধিকার বেইজিংয়ের রয়েছে। চীন সফররত বিন সালমান স্বাগতিক দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে গত শুক্রবার এক বৈঠকে তাদের দমননীতির প্রতি সমর্থন জানিয়ে এমন কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চীনের অধিকারকে সৌদি আরব সবসময় সম্মান জানিয়েছে এবং সমর্থন করেছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বিন সালমানের এমন ‘অবস্থান’ জানার পর সমালোচনার ঝড় উঠেছে।সৌদি আরবের রাজতন্ত্রের সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে হত্যার পর পশ্চিমা বিশ্বে কোণঠাসা হয়ে পড়া বিন সালমান সম্প্রতি মনোযোগ দেন পূর্বে। এরই অংশ হিসেবে তিনি প্রথমে পাকিস্তান ও পরে ভারত সফর করেন। এরপর গেছেন চীনে। সফরে গিয়ে নিপীড়িত গোষ্ঠী উইঘুরদের অধিকারের পক্ষে কোনো কথা না বলে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ‘ভ্যানগার্ড’ দাবিদার সৌদি আরবের প্রভাবশালী এ যুবরাজ ‘চীনা দমননীতি’র তোষণ করায় বেজায় ক্ষুব্ধ অধিকার সংগঠনগুলো। বিশেষ করে মুসলিম অধিকারের বিভিন্ন সংগঠন বিন সালমানের এই মন্তব্য ‘জঘন্য ও ন্যাক্কারজনক’ বলেও উল্লেখ করেছে।
মরুভূমি ও পাহাড়-পর্বত নিয়ে গঠিত ১৬ লাখ ৬৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের জিনজিয়াং চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। এখানে যে দুই কোটি ১৮ লাখ মানুষের বসবাস, তার মধ্যে দেড় কোটিরও বেশি উইঘুর সম্প্রদায়ের। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ৪৬ শতাংশ। ৪০ শতাংশ আছে চীনের সবচেয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠী হান সম্প্রদায়ের মানুষ।
চীনে শাসকগোষ্ঠীর বদল হলেও দশকের পর দশক ধরে উইঘুরদের ওপর চলে আসছে দমন-পীড়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন সরকার সাঁড়াশি অভিযান চালালে অর্ধলক্ষাধিক উইঘুর মুসলিম মাতৃভূমি ছেড়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়। সেখানে স্বায়ত্তশাসন চললেও এই জনগোষ্ঠীর ওপর বেইজিং ‘নজরদারির সরকার’ চালাচ্ছে বলে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম মনে করে। এমনকি ‘সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী’ কঠোর আইনের দোহাই দিয়ে চীন সরকার বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে ‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন’ করে রেখেছে বলে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল তাদের প্রতিবেদনে জানায়।
জিনজিয়াংয়ে মুসলিমদের ওপর চীনের এই দমন-নীতির ব্যাপারে রিয়াদ সবসময়ই মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছে। এমনকি সৌদি আরবের শাসক আল সৌদ রাজপরিবার দুটি পবিত্র মসজিদের রক্ষক ও বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক পরিচয় দিয়ে এলেও তারা ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (আইসিসি) কোনো পরিসরেও বিষয়টি নিয়ে টুঁ শব্দ করেনি।
মুখে কুলুপ এঁটে থাকার অবস্থান থেকে মুখ খুলে উল্টো এবার চীনের পক্ষ নিয়ে দমন-পীড়নে সমর্থন দেওয়ায় সৌদি যুবরাজের কঠোর সমালোচনা করেছেন ব্রিটেনের মুসলিম কাউন্সিলের মুখপাত্র মিকদাদ ভার্সি। বিষয়টিকে ‘উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলার পক্ষে সাফাই’ এবং ‘অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক’ বলেও মন্তব্য করেছেন মিকদাদ।জার্মানিভিত্তিক অধিকার সংগঠন ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উইঘুরদের বন্দিশালায় নিক্ষেপের বিষয়ে বিন সালমান সোচ্চার না হতে পারার ব্যর্থতা কার্যত ‘চীনের লজ্জাকর অধিকার লঙ্ঘন’কেই নীরব সমর্থন।
চীন হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম ধর্মীয় নিপীড়ক দেশ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এসব নিপীড়নের গোঙানির শব্দ বিশ্ববাসী খুব একটা জানতে পারে না। কালেভদ্রে কিছু জানা যায়।উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্বরোচিত নীতির ব্যাপারে চীন বলে যে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থার মোকাবিলা করার জন্যই তারা নানান পলিসি নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু দাড়ি রাখা, রমজান মাসে রোজা রাখা কীভাবে ধর্মীয় চরমপন্থা, তা বিশ্ববাসীকে বোঝাতে পারে না। আসলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান তাদের মতে চরমপন্থা। আর এই চরমপন্থা দমনের নামে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, জেল-জরিমানা চলছে।
চীনের অর্থনীতির রমরমা অবস্থা এবং তাদের কাছ থেকে নানান সুবিধা পেয়ে অধিকাংশ মুসলিম দেশ এসবের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। আসল কথাটি হলো বলতে চায় না। বুদ্ধিজীবীরাও কথা বলেন না। কারণ, এঁদের অনেকেই মার্ক্সীয় তত্ত্ব, মাও তত্ত্ব ভর করে আছেন। আর মুসলিমদের ব্যাপারে বরাবরই মুসলিম সুশীল সমাজ বা আমরা একরকম অন্ধ। এসব মানুষের কান্না তাদের কানে যায় না। উইঘুর মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারা (সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী) কথা বলতে পারে না, কারণ তারা ‘বোবা’।তারা জানে ধর্মের অস্তিত্ব হলো বিশ্বাসের উপর আর এই বিশ্বাসের ভংয়ন্করতা অনেক প্রকোট। যা মানুষকে মানুষ বানাত না। হিংস্র জানোয়ার বানায়। বেশী মাতামাতি করলে হয়তোবা মিথ্যার গোমর স্পষ্ট হয়ে যাবে ।
চীনে ক্ষেত্রে সুবিধাভোগি দেশের তালিকা একটু লম্বা। তাই উইঘুরের নির্যাতনের ক্ষেত্রে সকল রাষ্ট্র নীরব থাকবে । বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা বাজারে এখন সবাই নিজ নিজ অর্থনীতির উন্নায়ণে ব্যস্ত ।এখনে ধর্মীয় চেতনা অত্যন্ত রুগ্ন।যে সব দেশের পররাষ্ট্র নীতিতে যখনই ধর্মীয় চেতনার লেস মাত্র পাওয়া যায় তখনই তা বর্জন করা হয় । এসব প্রত্যক্ষ করেছি আমরা ইরাক , সিরিয়া কিংবা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে , এদের নির্যাতনে সারা মুসলিম বিশ্ব ছিল নীরব । বিধর্মী রাষ্ট্র আমেরিকার এগিয়ে আসতে হয়েছিল , সন্ত্রাসীদের দমন করার জন্য। উইঘুরে চীনা সরকার নিয়ন্ত্রন না করলে মুসলিম ধর্মান্ধরা ভবিষৎ চীনকে যে। সিরিয়া বানোবে না তার গেরান্টি কেউ দিতে পারবে না । হয়তো বা চীনের এ নিয়ন্ত্রনের বিরুদ্ধচরন আমিও করবো , কেননা এসব আমানবিক এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ । আমরা ধর্মীয় বিশ্বাসের ভাইরাস কত যে ভয়ংকর হতে পারে তা সমগ্র পৃথিবীর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পর্যালাচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। চীনের এই নীপিড়নের সুফল হয়তো চীন উপলব্ধি করবে আগামী শত বছর পর । আমরা এখনো শংকিত ও আতংকিত বিশ্বাসের ভাইরাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ।
চীনের কয়লার ৪০ ভাগ, তরল জ্বালানির ২২ ভাগ এবং গ্যাসের ২৮ ভাগ রয়েছে জিনজিয়াং প্রদেশে। যার ৪৫.৮৫ ভাগ ধারণ করে রয়েছে উইঘুর সম্প্রদায়। জিনজিয়াং এর অর্থনীতি কৃষি এবং বানিজ্য ভিত্তীক যার কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই অঞ্চলের শহরগুলোর ভেতর দিয়ে যাওয়া ‘সিল্করোড’। আর চীন সরকারের মাথা ব্যাথা এখানেই। সংখ্যালঘু হয়ে বিপুলসংখ্যক এই সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কাটা হয়ে দাড়িয়েছে তারা, যার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার উইঘুর জাতির নিষ্পত্তি ঘটিয়েই এই সম্পদ রাষ্ট্রের কাজে লাগাতে বদ্ধ পরিকর। বিপরীতে চীনারা ৪ হাজার বছরের পুরোনো জাতির নিশানা মিটিয়ে আবির্ভাব ঘটাতে চায় নতুন বানিজ্য ব্যবস্থার। যা এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের, বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারে নতুন দ্বার উন্মোচনের পুজি হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
জিনজিয়াং এর মানচিত্র পরিণত হয়েছে বিভৎস বধ্যভূমিতে। রাতের আধারের কোলাহলমুক্ত পরিবেশে ভেসে আসে নিরীহ, পশ্চাৎপদ জাতির আর্তনাদ। সমস্ত নৃশংসতার জোগান দিয়ে উইঘুরদের বাসস্থলকে বানিয়েছে এক ধ্বংসযঙ্গের কারখানা। যাদের দিকে তাকালে, প্রত্যেক মুসলিম রাষ্ট্র আয়নায় আত্ম-অবয়ব খুঁজে পাবে। ইতিহাসের করুণায় দুর্বলরা মাত্রই বেচে আছে সম্মুখে গুণে ধরা তলোয়ার নিয়ে, পশ্চাতে চলছে মরণ প্যাচের স্তুপিকরণ। ডাল টেনে শেকড় তুলে আনার স্বপ্নে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা সমাজতান্ত্রিকদের পাতানো জালের বাইরে বেরোনোই মূল লক্ষ্য।
চীনকে চাপ জাতিসংঘের
অ্যামেরিকা এবং ক্যানাডার পরে এবার উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে চীনের উপর চাপ তৈরি করল জাতিসংঘ। মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বরেল বলেছেন, চীনের উচিত উইঘুর অধ্যুষিত শিনজিয়াং প্রদেশে জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্তকারী দলকে ঢুকতে দেয়া। সেখানে কী চলছে, তা ওই দল খতিয়ে দেখতে চায়। চীন অবশ্য এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
জাতিসংঘে মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাশেলেট। বহুদিন ধরেই তিনি একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে চীনে যেতে চাইছেন। সেখানে শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের সঙ্গে চীন ঠিক কী ব্যবহার করছে, তা দেখে একটি রিপোর্ট তৈরি করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু চীন এখনো পর্যন্ত তাতে সম্মত হয়নি। মঙ্গলবার বরেল বলেন, তাঁরা চান, মিশেলের নেতৃত্বে একটি দল শিনজিয়াং প্রদেশে যাক। এ বিষয়ে চীনের উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন তিনি। সোমবারই ক্যানাডার পার্লামেন্টে চীন এবং উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। সর্বসম্মতিক্রমে সেখানে বলা হয়েছে, চীন ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে। তবে ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং তাঁর মন্ত্রিসভা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। ডনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতার শেষ পর্যায়ে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও একই কথা বলেছিলেন। তিনিই প্রথম চীনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, উইঘুর মুসলিমদের গণহত্যা করছে চীন। যার জেরে পম্পেও এবং বেশ কয়েকজন মার্কিন প্রশাসনিক কর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল চীন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলির বক্তব্য, চীন শিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় দশ লাখ উইঘুর মুসলিমকে বন্দি করে রেখেছে। তাদের ধর্মের অধিকার, সন্তান উৎপাদনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। উইঘুর মুসলিমদের সঙ্গে কার্যত দাসের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এই অভিযোগগুলি চীন কখনোই মানতে চায়নি।
ফ্রিডম ওয়াচের মতে, চীন হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম ধর্মীয় নিপীড়ক দেশ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এসব নিপীড়নের গোঙানির শব্দ বিশ্ববাসী খুব একটা জানতে পারে না। কালেভদ্রে কিছু জানা যায়। উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্বরোচিত নীতির ব্যাপারে চীন বলে যে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থার মোকাবিলা করার জন্যই তারা নানান পলিসি নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু দাড়ি রাখা, রমজান মাসে রোজা রাখা কীভাবে ধর্মীয় চরমপন্থা, তা বিশ্ববাসীকে বোঝাতে পারে না। আসলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান তাদের মতে চরমপন্থা। আর এই চরমপন্থা দমনের নামে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, জেল-জরিমানা চলছে।
চীনের অর্থনীতির রমরমা অবস্থা এবং তাদের কাছ থেকে নানান সুবিধা পেয়ে অধিকাংশ মুসলিম দেশ এসবের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। আসল কথাটি হলো বলতে চায় না। বুদ্ধিজীবীরাও কথা বলেন না। কারণ, এঁদের অনেকেই মার্ক্সীয় তত্ত্ব, মাও তত্ত্ব ভর করে আছেন। আর মুসলিমদের ব্যাপারে বরাবরই মুসলিম সুশীল সমাজ বা আমরা একরকম অন্ধ। এসব মানুষের কান্না তাদের কানে যায় না। উইঘুর মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারা (সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী) কথা বলতে পারে না, কারণ তারা ‘বোবা’।
সূত্র : উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো