“কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গানটি আমাদের সবার ভালো লাগে । আজকে আপনাদের সেই কালো হরিণ- চোখের অধিকারী এক জাতির গল্প শোনাবো।
পূর্ব আফ্রিকার দেশ আবিসিনীয়ার যার বর্তমান নাম ইথিওপিয়া । দেশটি লোহিত সাগরের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। লোহিত সাগর পার হলেই পুর্ব পাড়ে ইয়েমেন ও সৌদি আরব। পূর্ব আফ্রিকার এই দেশের অধিবাসীরাই হলো হাবশী । হাবশী নামটির উৎপত্তি হয়েছে আরবী আল-হাবশ থেকে। আরবরা আল-হাবশ বলতে বুঝাতো আবিসিনিয়াকে। হাবশীদের নিগ্রো ও কাফ্রিও বলা হয়ে থাকে। তবে, নিগ্রো নামটি অসম্মান সূচক বলে এখন খুব একটা ব্যবহার করা হয় না। আমেরিকাতে ত কোন কালো মানুষকে নিগ্রো বললে রীতিমতো হাতা হাতি, মামলা-মোকদ্দমা শুরু হয়ে যায়। সে কারণে ইংরেজি ভাষায় ভদ্রজনোচিত একটা নতুন শব্দ সংযোজন করা হয়েছে– আফ্রো-আমেরিকান।
উপমহাদেশে হাবশী সম্প্রদায়
প্রাক—ইসলামিক যুগ থেকে আরব বণিকেরা আফ্রিকার পূর্ব উপকূল থেকে আফ্রিকানদের ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করতে থাকে। দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্রীতদাস আমদানি নতুন মাত্রা লাভ করে, বিশেষ করে ভারতের দক্ষিণ উপকূলে।
পর্তুগীজরা ১৫৩০ থেকে ১৭৪০ সাল নাগাদ হর্ন অফ আফ্রিকা নামে খ্যাত জিবুতি, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়া থেকে ভারত উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ক্রীতদাস আমদানি করতে থাকে। এখন সভ্যতার মুখোশ পরে থাকলেও পর্তুগীজরা কত যে জনপদ ধ্বংস করেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছে তার হিসাব নাই। তাদের এই দাস ব্যবস্যর কারণে ভারত উপমহাদেশেও হাবশীদের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। অবশ্য, বেশ কিছু আবিসিনিয়াবাসী স্বেচ্ছায় ভাগ্যোন্নয়নের উদ্দেশ্যে অথবা কাজকর্মের ধান্দায় উপমহাদেশে হাজির হয়।
উপমহাদেশে আগত হাবশীদের একদল পাকিস্তানের উপকূলে বাস করে। এদের মাকরানি বলে।অনেক পরিচিত ফুটবল প্লেয়ার পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে বা তখনকার ইস্ট পাকিস্তানের বিভিন্ন দলে খেলতে আসতেন। তাদের কেউ কেউ আমাদের দেশে স্থায়ীও হয়ে গেছেন।
ভারতের কর্ণাটক, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রদেশে, সিন্ধু এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, ইরানের পশ্চিমাঞ্চল যেখানে তাদের আরব হিসেবে গন্য করা হয়। তারা স্থানভেদে সিদি, সিদ্দি, সওয়ালি নামেও পরিচিত।
বাংলাদেশে হাবশী রাজত্ব
এদেশে হাবশীরা শুধু দাসত্বই করে গেছে। তা নয়। তারা রাজত্বও করে গেছেন। তাও আমাদের বাংলাদেশে। অবাক কান্ড, তাই না? সেন শক হুন পাঠান মোগলের পাশাপাশি অন্ধকার মহাদেশ নামে কথিত দারিদ্র্যপীড়িত আবিসিনিয়বাসীরাও শস্য শ্যামল সৌন্দর্যমণ্ডিত এ বদ্বীপের জনপদ শাসন করে গেছে।
আশ্চর্যের বিষয়, বিদগ্ধ জাত্যাভিমানী হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অভিজাত শ্রেণীর ঐতিহাসিকবৃন্দ হাবশীদের রাজত্বকালের লজ্জাকর অধ্যায় সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। সাম্প্রতিক কালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় সহ বেশ কিছু ঐতিহাসিকদের গবেষণায় আসল তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
এসব গবেষণা থেকে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তাতে জানা যায় ইলিয়াস শাহ সুলতান বংশের সুলতান বরবক শাহ আবিসিনীয়া এবং হাবশী ক্রীতদাস আমদানি করে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ করেন। খাল কেটে কুমির আনা যাকে বলে।
১৪৮৭ সালে ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহকে হত্যা করে সুদূর আবিসিনিয়া থেকে আমদানি করা হাবশী প্রসাদরক্ষী বা পাইকদার বারবাক শাহ। পাইকদার সুলতান উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে আসীন হন। বাংলায় শুরু হয় দাস বংশ।
ছয় মাস পরে তার প্রধান সেনাপতি আবার তাকে হত্যা করে নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। এ ভাবে ১৪৮৭ থেকে ১৪৯৩ সাল পর্যন্ত চারজন হাবশী রাজত্ব পরিচালনা করেন। হাবশী রাজত্বকাল বাংলাদেশ অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করা হয়।
সম্রাট হেইলে সেলাসি
আফ্রিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম উজ্জ্বল নাম সম্রাট হেইলে সেলাসি ১৯১৬ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ইথিওপিয়ার শাসক ছিলেন এবং ১৯৩০ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সম্রাট। তিনি আফ্রিকান ঐক্য সংস্থার চেয়ার পার্সনের দায়িত্ব পালন করেন।
হেইলে সেলাসি অতি প্রাচীন পয়গম্বর সুলায়মান ও রানী শেবার পুত্র রাজা মেনেলিক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের একজন উত্তরসূরী ছিলেন বলে কথিত আছে।
১৯৩৪-৩৫ সালে ইতালি-ইথিওপিয়ান যুদ্ধের সময় ইথিওপীয় জনগণের বিরুদ্ধে ইতালির রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য সম্রাট লীগ অব নেশনস একটা আবেগময় জোরালো বক্তব্য রাখেন। তাঁর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইথিওপিয়াকে লীগ অব নেলসনের চার্টার সদস্য করা হয়।
এত যে পরাক্রমশালী সম্রাট, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁরও এক সময় পতন ঘটল। ১৯৭৩ সালে ইথিওপিয়াতে দুর্ভিক্ষের ফলে হেইলে সেলসিকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৭শে আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিনি ৮৩ বছর বয়সে কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। অনেকে সন্দেহ করেন তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা হয়েছিল।