গরুর ক্ষতস্থান থেকে মানুষের মুক্তি। ল্যাটিন ভাষায় ভ্যাক মানে গরু। গরুর এক প্রকার বসন্ত হতো যাকে বলা হতো কাউপক্স। এই কাউপক্স থেকে কিভাবে তৈরি হয় পৃথিবীর প্রথম ভ্যাকসিন, আজ আমরা সেই গল্পই শুনবো।

এডওয়ার্ড জেনার সাহেব কে বলা হয় গুটী বসন্ত টিকার জনক। হয়ত এটা সঠিক কারণ জেনার সাহেব তাঁর সারা জীবন ব্যয় করেছেন গুটি বসন্ত টিকার পদ্ধতির প্রচলন ঘটাতে। ১৭৯৬ সালে জেনার সাহেব গুটিবসন্তের টিকা তাঁর মালির ৮ বছরের পুত্র জেমস ফিপস এর উপর প্রয়োগ করেন। এর মাধ্যমেই পৃথিবী জানতে পারে গুটিবসন্তের টিকার কার্যকারিতার কথা।

গুটি বসন্ত ছিলো একটা সময়ে আতংকের নাম। এই রোগ হলে প্রতি দশজনের আটজনই মারা যেতেন। ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপে প্রতি বছর চার লাখ মারা যেতেন গুটি বসন্তে। এটি এতোটাই অতংকজনক ছিলো যে এটি হলে অনেকে আত্মহত্যাও করতে। সে সময় এর কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা ছিলো না। যে যার মতো নিরাময়ের চেষ্টা করতেন।
তাই চিকিৎসা পদ্ধতিও ছিলো বিচিত্র। কেউ রোগীকে গরম ঘরে ঢুকিয়ে রাখতেন। কখনও ঠান্ডা ঘরে। কখনও প্রচুর তরমুজ খাওয়ানো হতো, এমনকি দিনে ১২ বোতল বিয়ার খাওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হতো। তবে একটি চিকিৎসা বেশ কার্যকরী ছিলো। আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষত থেকে পুজ নিয়ে তা সুস্থ মানুষের শরীরে লাগানো। এটি প্রথমে এশিয়া ও আফ্রিকায় চেষ্টা করা হয়। পরে তা ইউরোপে আসে। তবে তা শুধুমাত্র হালকা উপসর্গের বেলাতেই কাজ করতো। তাই গুরুতর অসুস্থতার জন্য আরও ভালো কিছুর দরকার ছিলো।
১৭৭৪ সালে পশ্চিম ইউরোপের এক কৃষক এক অভিনব ব্যবিস্থা নেন। সেসময় গরুদেরও বসন্ত হতো। এটিকে কাউপক্স বলা হতো। এমনই এক কাউপক্স আক্রান্ত গরুর ক্ষত থেকে বের হওয়া পুজ নিজের এবং তার স্ত্রী সন্তানের শরীরে প্রবেশ করান এক কৃষক। বিস্ময়করভাবে মহামারী চলাকালীন সময়েও তারা গুটি বসন্তে আক্রান্ত হননি। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে কৃষকের নাম ছিল বেনজামিন জেটসি।
তবে দীর্ঘদিন তার আবিষ্কার কারও নজরে আসেনি। এর বাইশ বছর পর একজন গ্রাম্য ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনারের এই পদ্ধতিটি জানতে পারেন। তিনি কৃষকদের কাছে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে বিষয়টি পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। এইজন্য তিনি বেছে নেন একটি শিশুকে। আট বছর বয়সী জেমস ফিপস এর শরীরে তিনি গরুর পুজ প্রবেশ করান। শুরুতে খানিকটা অসুস্থবোধ করলেও জেমস কয়েকদিন পরেই সেরে ওঠেন। এরপরে তার আর গুটি বসন্ত হয়নি। এমনকি তার সংস্পর্শে আসা কারই হয়নি। এই পরীক্ষা ছিলো অত্যন্ত ভীতিকর কিন্তু তা ছিলো সফল।
জেনার বুঝতে পারলেন তিনি গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন। গরুর গুটি বসন্তের ল্যাটিন নাম ভ্যাকসিনা থেকে এই নাম আসে। জেনার এই আবিষ্কার থেকে অর্থ উপার্জন করতে চাননি। তিনি কেবল চেয়েছিলেন যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে এটি পৌঁছাতে। তিনি তার বাগানকে ভ্যাকসিনের মন্দিরে পরিণত করেন। প্রতি রবিবার চার্চে প্রার্থনা শেষ করার পর তার বাগানে ভ্যাকসিন দেওয়া হতো। জেনারের এই আবিষ্কারের কথা পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা পুরা ইউরোপে ছড়িয়ে যায়। এবং স্পেনের রাজার সাহায্যে তা পুরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।