জেমসের গাওয়া এই গানটি আমরা সবাই শুনেছি। কিন্তু আমরা কি জানি গানটির সুর নেওয়া হয়েছে কলকাতার বিখ্যাত মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের গান থেকে। ( মহীনের ঘোড়াগুলির গানের ভিডিও)। গানটি লিখেছেন এবং সুর করেছেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়।। তাকে বলা হয়, বাংলার প্রথম রক আইকন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন চিরকালের বিদ্রোহী। একজন নকশাল আন্দোলনকারী। একজন বিদ্রোহী থেকে রক আইকন হয়ে ওঠার গল্পটিই শোনা যাক আজকে।
(পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে) গানটিতে বলা হয় মানুষের মধ্যে যোগাযোগের রাস্তা অনেক বেড়ে গেছে। তবুও মানুষের সাথে মানুষের মানসিক দূরত্ব হাজার হাজার মাইল। এভাবে গৌতম সর্বদা মানুষের কথা বলেছেন। তাদের সংগ্রামের কথা বলেছেন। কিন্তু শুরুটা সহজ ছিলো না। সত্তর দশকের মাঝামাঝি মহীনের ঘোড়াগুলির প্রথম আলবাম বের হয়। সেটা চরমভাবে ব্যর্থ হয়। কারন, তখনও বাংগালীর ঘরে হেমন্ত- মান্না দের রাজত্ব।
তারা গৌতমের এমন প্রথাবিরোধী গান একদমই গ্রহন করলেন না। তাদের রেডিওতে গাইতে দেওয়া হয়নি। এসব কোনও গানই না বলে দুরদর্শন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। স্টেজে হাসি ঠাট্টা করা হয়েছে তাদের নিয়ে। আশির দশকের একসময় তার ব্যান্ডটাই ভেংগে যায়। এরপরে নব্বই দশকের শুরুতে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান ” জীবনমুখী গান” হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। এবার সবার গৌতমের কথা মনে পড়ে। ১৯৯৫ এ রিলিজ পেলো মহীনের ঘোড়াগুলি’র “আবার বছর কুড়ি পরে”। এবার বাংলার তরুনেরা লুফে নিলো গৌতমের গান। তিনি পরিনত হলে রক আইকনে। সুমন চট্টোপাধ্যায় বরাবরই তার গানের অনুপ্রেরণা হিসেবে গৌতমের কথা বলেছেন। কিন্তু গৌতমের অনুপ্রেরণা ছিলো কারা?
এটা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ষাটের দশকের শেষ দিকে। তখন পশ্চিম্বঙ্গে নকশাল আন্দোলন তুংগে। গৌতম তখন বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। নকশাল রাজনীতির দীক্ষা নিচ্ছেন আর স্প্যানিশ গিটার বাজানো শিখছেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি পুরোপুরি নকশালদের সাথে যোগ দিলেন। সেসময় পুলিশ ব্যাপক ধড়-পাকড় শুরু করলে তিনি গ্রামের দিকে পালিয়ে যান। তার পলাতক জীবনে তিনি গ্রামের মানুষদের সাথে মিশে যান। একদম মাঠে কাজ করা কৃষকের মতো দিন যাপন করেন।
তার এই অভিজ্ঞতাই হয়তো উঠে এসেছে ” ভালো লাগে” গানটিতে। মাকে দেখতে কলকাতায় ফিরলে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পরে যান। তার সামনেই তার এক নকশাল বন্ধুকে এনকাউন্টার করা হয়। দীর্ঘদিন জেলে থাকেন। সেখানে বসেই ১৫০ এর মতো গান রচনা করেন। বাংলায় আর ফিরবেন না এই শর্তে মুক্তি পান তিনি। চলে যান মধ্যপ্রদেশে। এরপর পুলিশের ধড়-পাকড় কমে এলে তিনি কলকাতায় ফেরেন। আবার হাতে তুলে নেন গীটার। গানে গানে বলতে শুরু করেন মানুষের কথা। মানুষের সংগ্রামের কথা।
গৌতম আর তার গানকে আমাদের চিনতে হয়তো কুড়ি বছর লেগেছে। কিন্তু তার আদর্শ আর সংগ্রাম আমাদের কাছে থাকবে সহস্র বছর।