চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঠিক কবে থেকে শুরু তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি। ১৮৯৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর তারিখে প্যারিস শহরে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় তাদের তৈরী দশটি ছোট ছোট চলচ্চিত্র প্রথমবারের জন্য বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শন করেন। চলমান ছবিকে প্রজেকশন বা অভিক্ষেপনের মাধ্যমে প্রথম সফলভাবে প্রদর্শনের নিদর্শন হিসাবে এই তারিখটিকেই গণ্য করা হয়। চলমান ছবিকে ক্যামেরার সাহায্যে গ্রহণ এবং প্রদর্শনের পূর্ববর্তী কিছু নজির থাকলেও হয় তার গুণমান ছিল নিম্ন নয়ত সেগুলোর কোনোটাই ‘লুমিয়ের সিনেমাটোগ্রাফ’-এর মত বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এই ঘটনার পরে পরেই সারা বিশ্ব জুড়ে প্রচুর ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি তৈরী হয়ে যায় আর মাত্র এক দশকের মধ্যেই চলচ্চিত্র তার অভিনবত্ত্ব কাটিয়ে উঠে এক বিশাল সর্বজনীন বিনোদনশিল্পে পরিণত হয়।
গোড়ার দিকের চলচ্চিত্র ছিল সাদা-কালোয় তোলা, দৈর্ঘ্য ছিল এক মিনিটেরও কম, আর ছিল নির্বাক। ১৮৯০ সাল থেকেই একাধিক শট সংবলিত, বেশ কয়েক মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরী হতে থাকে। ১৮৯৮ সালে তৈরী হয় প্রথম ঘূর্ণায়মান ক্যামেরা যা দিয়ে প্যানিং শট নেওয়া সম্ভব ছিল। ১৮৯৭ সালেই প্রথম ফিল্ম ষ্টুডিও তৈরী হয়ে যায়। স্পেশাল এফেক্ট, এক ঘটনাক্রম থেকে অন্য ঘটনাক্রমে ছবির কন্টিন্যুইটি বা অবিচ্ছেদ্যতা বজায় রাখা, ইত্যাদি নানারকম প্রয়োগকৌশলের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়।
১৯০০ সাল থেকেই কন্টিন্যুইটির মাধ্যমে ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং ক্লোজ-আপ শটের ব্যবহার শুরু হয়ে যায় (অনেকে বলেন এর উদ্ভাবক ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ)। এই সময়ের বেশির ভাগ ছবিকেই ‘চেজ ফিল্ম’ বলা যেতে পারে। প্রথম একাধিক রিল সংবলিত কাহিনীচিত্র ১৯০৬ সালে অস্ট্রেলিয়া-তে তৈরী হয়। ১৯০৫ সালে পিটসবার্গে স্থাপিত ‘দ্য নিকেলোডিয়ান’ কে বলা হয় প্রথম স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ যেখানে সফলভাবে শুধুই চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয়েছিল। ১৯১০ এর মধ্যেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম পর্দায় লেখা শুরু হয়, আর চলচ্চিত্র-তারকা হিসাবে তাদের জনপ্রিয়তার রাস্তা খুলে যায়। ১৯১০ থেকে নিয়মিত সংবাদচিত্র প্রদর্শিত হতে থাকে এবং অচিরেই তা’ নতুন সংবাদমাধ্যম হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে যায়। ঐ সময়েই মার্কিন চলচ্চিত্রগুলি অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশের (ফ্রান্স ছাড়া) শেয়ার মার্কেটের বৃহত্তম ভাগীদার হয়ে দাঁড়ায়।
ঐ একই সময়ে কৃত্রিম আলোকে চিত্রগ্রহণ জাতীয় আরও অনেক নতুন প্রয়োগকৌশল জন্ম হয়। তখনই কৃত্রিম আলোয় আগুন জ্বলার বিভ্রম সৃষ্টি করা বা বিশেষ বিপদসূচক দৃশ্যে আলো কমিয়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরী (লো-কী লাইটিং) করা সম্ভব হয়েছিল। গল্প বলার নতুন মাধ্যম হিসাবে চলচ্চিত্র যাতে দর্শকের কাছে সহজবোধ্য হয়ে ওঠে তারজন্য বিশেষজ্ঞ লেখক নিযুক্ত হওয়া শুরু হল, যারা বই হিসাবে প্রকাশিত জটিল নাটক-নভেলকে সরল করে ছোট আকারে নিয়ে আসতেন, যাতে একটিমাত্র রিলের মধ্যে তার চিত্ররূপ আঁটানো যায়। চলচ্চিত্রেও জঁর বা বিশেষ পদ্ধতি অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস চালু হল, যদিও কমেডি আর ড্রামারই প্রাধান্য ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চলচ্চিত্র শিল্পে একটা জটিল রূপান্তর ঘটে যায়। এক রিলের ছোট ছবির জায়গা নেয় পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র। প্রেক্ষাগৃহ আকারে বড় হতে থাকে আর পাল্লা দিয়ে বাড়ে টিকিটের দাম। এক শট থেকে অন্য শটে কন্টিন্যুইটি বা অবিচ্ছেদ্যতা বজায় রাখার প্রয়োগকৌশলের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ১৯১৪ সালের মধ্যে এই ধরনের ধারাবাহিকতা যুক্ত ছবিই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের প্রধান ঘরানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।
ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ ছিলেন সেইসময় মার্কিন চলচ্চিত্র শিল্পের স্তম্ভস্বরূপ। দর্শকদের মধ্যে নাটকীয় উত্তেজনা সঞ্চারে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস এঞ্জেলেস শহরের প্রান্তে হলিউড অঞ্চলে তিনিই প্রথম শুটিং করেন আর অচিরেই হলিউড হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র তথা সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণকেন্দ্র। ১৯২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে চলচ্চিত্র উৎপাদনে শীর্ষস্থান দখল করে নেয়, প্রতি বছর গড়ে কমকরে ৮০০ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হত। সারা বিশ্বে নির্মিত চলচ্চিত্রের ৮২% ই এখানে তৈরী হত। বিশ্বখ্যাত বিনোদন কোম্পানি ওয়ার্নার ব্রাদার্স তৈরী করেন দ্য জ্যাজ সিঙ্গার, এই ছবিতে প্রথম সিঙ্ক্রোনাইজড বা সমলয় সংলাপ এবং সমলয় সংগীত ব্যবহার করা হয়। ১৯২৭ সালে এই ছবি মুক্তি পাবার সঙ্গেই নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অবসান ঘটে।১৯২৯ সালের শেষে গিয়ে দেখা যায় হলিউডের প্রায় সমস্ত ছবিই সবাক। তখন অবশ্য শব্দগ্রহণ যন্ত্রের প্রমিতকরণ ঘটেনি, কিন্তু অতিদ্রুত সেটাও হয়ে যায়। শব্দের ব্যবহার শুরু হওয়ার জন্যেই হলিউডের চলচ্চিত্রশিল্প সেই সময়ের মারণ অর্থনৈতিক গ্রেট ডিপ্রেশনের হাত থেকে রক্ষা পায়।
যুদ্ধের সময়ে প্রচারমূলক ছবির হাত ধরে যুক্তরাজ্যে চলচ্চিত্র শিল্পে নবজাগরন আসে, প্রচুর বাস্তবানুগ যুদ্ধ-সম্পর্কিত চলচ্চিত্র তৈরী হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে অনেক দেশভক্তিপূর্ণ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারমূলক ছবিও তৈরী হতে থাকে। ১৯৫০ এর আশেপাশে হাউস আন-আমেরিকান এক্টিভিটিস কমিটি হলিউডে তদন্ত চালিয়ে প্রচুর কলাকুশলীকে কালো-তালিকাভুক্ত করে। বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই দূরদর্শনের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সামনে চলচ্চিত্রশিল্প কিছুটা বিপন্ন হয়ে পড়ে, বেশ কিছু কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়, অনেক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যায়। আবার অন্যদিকে ১৯৫০ এর দশক থেকে বিশ্ব জুড়ে ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে স্বর্ণযুগ শুরু হয়ে যায়।
১৮৮৮ সালে ফরাসী উদ্ভাবক লুই লা প্রিন্স একটি ছোট ছবি তোলেন যার নাম ছিল রাউন্ডহে গার্ডেন সিন। এখনো পর্যন্ত টিঁকে থাকা ছবিগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হিসাবে এই ছবিটি গিনেস বিশ্ব রেকর্ড এর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। যদিও ফরাসী নির্মাতা লুই লুমিয়ের-এর ১৮৯৫ সালে তৈরী সর্তি দে লুসিনে লুমিয়ের দে লিও (লিও-র লুমিয়ের ফ্যাক্টরি থেকে প্রস্থানরত শ্রমিকরা) ছবিটিকে প্রথম সত্যিকারের চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়।
চলচ্চিত্রের পূর্বসূরী
শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র বিভিন্ন পূর্বসূরী ঐতিহ্যবাহী শিল্পের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল, যেমন কথকতা, সাহিত্য, নাটক এবং অন্যান্য দৃষ্টিগোচর শিল্প। এছাড়াও চলমান ছবি এবং/অথবা প্রক্ষিপ্ত ছবি সংবলিত বেশ কিছু অনুরূপ শিল্পমাধ্যম আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, যেমন :
শ্যাডোগ্রাফি (হস্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে ছায়া তৈরী করে গল্প বলা, সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই এর চর্চা করা হত)
ক্যামেরা অবস্কিউরা (পিনহোল ক্যামেরার প্রাকৃতিক নীতির ভিত্তিতে তৈরী শিল্পমাধ্যম, উৎপত্তি সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক কালেই)
শ্যাডো পাপেট্রি (দ্বিমাত্রিক পুতুলের ছায়ার সাহায্যে গল্প বলা, উৎপত্তি সম্ভবত ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্যে এশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া বা চিনে)
ম্যাজিক লণ্ঠন (সপ্তদশ শতকে উদ্ভাবিত এই শিল্পমাধ্যম প্রধানত আধুনিক প্রজেক্টর বা অভিক্ষেপন যন্ত্রের পূর্বসূরী)
পারসিস্টেন্স অফ ভিশন বা দৃষ্টির জড়তাকে কাজে লাগিয়ে তৈরী অ্যানিমেশন যন্ত্র (১৮৩২ সালে ফেনাকিষ্টিস্কোপ, ১৮৬৬ তে জোট্রোপ, ১৮৬৮ তে ফ্লিপ বুক)
কিছু অতীতকালীন প্রেতাত্মা বা ভগবান দর্শনের কাহিনীর ক্ষেত্রে মনে করা হয় যে খুব সম্ভবত অবতল দর্পন, ক্যামেরা অবস্কিউরা বা অন্য কোনো অজানা প্রক্ষেপন যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে নেক্রোম্যান্টিক বা মৃত ব্যক্তিকে আহ্বান সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে এরকম ভেলকি বেশ প্রচলিত ছিল। এই ঐতিহ্য অনুসরণ করেই ম্যাজিক লণ্ঠনের সর্বপ্রথম প্রদর্শনে মৃত্যু ও অন্যান্য ভয়ঙ্কর আকৃতির মূর্তির ছবিই প্রদর্শিত হয়। ১৭৯০ সাল নাগাদ এইধরনের প্রদর্শনী আরো উন্নত রূপ পায় ফ্যান্টাসম্যাগোরিয়া নামধারী মাল্টিমিডিয়া গোস্ট-শো তে, যেখানে যান্ত্রিক স্লাইড, পশ্চাৎ প্রক্ষেপণ, চলন্ত প্রক্ষেপণ, আরোপন, ডিজল্ভ, সত্যিকারের নট-নটী দিয়ে অভিনয়, ধোঁয়া, গন্ধ, শব্দ, এমনকি বৈদ্যুতিক শক পর্যন্ত ব্যবহার করা হত। এইসব ভুতুড়ে বিষয়সমূহই পরবর্তীকালে, চলচ্চিত্রের আবির্ভাবের পরে, রূপান্তরিত হয় হরর ফিল্ম জঁর-এ।
চলমান ছবির উদ্ভাবনের সময় থেকেই ম্যাজিক লণ্ঠনের সাহায্যে তা’ অভিক্ষেপণ করা হত। ১৬৫৯ সালে ওলন্দাজ উদ্ভাবক ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস এইধরনের স্লাইড শোর জন্য ছবি আঁকেন, তাতে দেখা যায় একটি কঙ্কাল ঘাড়ের ওপর থেকে নিজের খুলিটা একবার তুলে নিয়ে আবার সেখানেই বসিয়ে দিচ্ছে। কাঁচের চিত্রিত স্লাইডে গতিশীলতা সঞ্চার করার প্রয়োগকৌশল ১৭০০ সাল নাগাদই চলে আসে। সাধারণত শরীরের কোনো অঙ্গকে (হাত বা পা) আলাদা করে এক বা একাধিক অতিরিক্ত কাঁচের ওপর আঁকা হত, তারপর তাকে সম্পূর্ণ শরীরের স্থির স্লাইডের সাপেক্ষে হাত দিয়ে বা অন্য কোনো যান্ত্রিক কৌশলের সাহায্যে নাড়ান হত। যদিও ম্যাজিক লণ্ঠনের প্রদর্শন প্রাথমিকভাবে দর্শকের মনে ভীতি সঞ্চার দিয়েই শুরু হয়েছিল, খুব তাড়াতাড়ি আরো নানা ধরনের বিষয় নিয়ে প্রদর্শনী চালু হয়ে যায়, গল্প বলার আর শিক্ষামূলক কাজেও ব্যবহার হতে থাকে। ঊনবিংশ শতকে প্রচুর নতুন আর জনপ্রিয় ম্যাজিক লণ্ঠন প্রয়োগকৌশলের উদ্ভাবন হয়, তারমধ্যে ছিল ডিজলভিং ভিউ আর বিভিন্ন রকমের যান্ত্রিক স্লাইড, যাদের সাহায্যে ঝকঝকে বিমূর্ত সব এফেক্ট (ক্রোমাট্রোপ ইত্যাদি) তৈরী করা হত, তুষারপাত বা গ্রহ উপগ্রহের চলনের বিভ্রম পর্যন্ত তৈরী করা হয়েছিল।
প্রাথমিক যুগ
৮৯০ এর সময়ে প্রধানত ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শকরাই ছবি দেখাতেন অস্থায়ী ছাউনিতে, বিচিত্রানুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে। ছবির দৈর্ঘ্য এক মিনিটের বেশি হত না, সাধারণত একটাই দৃশ্য থাকত, তাতে দেখান হত সর্বজনীন দৃশ্য, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, কোনো খেলাধুলার অংশ অথবা স্ল্যাপস্টিক কৌতুকাভিনয়। ছবি হত সাদা-কালোয় তোলা এবং নির্বাক, চলচ্চিত্রের কোনওরকম বৈশিষ্ট্য তাতে থাকত না।
ঊনবিংশ শতক শেষ হবার আগেই চলচ্চিত্রশিল্প সম্পর্কিত ব্যবসা যে সারা বিশ্ব জুড়েই ফুলে-ফেঁপে ওঠে তার মূলে ছিল বাস্তনানুগ চলমান ছবির অভিনবত্ত্ব। চলচ্চিত্র একবার তোলা হয়ে গেলে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় দেখান সম্ভব ছিল, এতে করে দর্শক সুদূর দেশের চলমান ভ্রমণবৃত্তান্ত নিজের শহরে বসেই দেখতে পেতেন। সহজ সরল ও সুলভ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র খুব তাড়াতাড়ি সাধারণ্যে গৃহীত হয়ে যায় আর ভিক্টরিয়ান যুগের শেষের দিকেই সর্বাধিক জনপ্রিয় দৃষ্টিগ্রাহ্য শিল্পমাধ্যম হয়ে ওঠে।
স্ক্লাডানোস্কি ভ্রাতৃদ্বয় ১৮৯৫ সালে বার্লিন উইন্টারগার্টেন থিয়েটার প্রেক্ষাগৃহে প্রকাশ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। ১৮৯৬ সালে মেলবোর্ন এথেনিয়াম প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয়। বিংশ শতকের প্রাক্কালেই জনপ্রিয় বিনোদনস্থল হিসেবে নাট্যশালা বা ক্যাবারে প্রদর্শনশালার পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ নিজের জায়গা করে নেয়।
১৯২৭ পর্যন্ত চলমান ছবির সঙ্গে কোনো শব্দ যুক্ত থাকতনা, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই সময়কে নির্বাক যুগ বলা হয়। দর্শকদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করার জন্য নির্বাক ছবির সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রীরা বাজনা বাজাতেন, কখনো সাউন্ড এফেক্ট এমনকি ধারাবিবরণীর ব্যবস্থা থাকত, সাধারণত অভিক্ষেপণ যন্ত্র যিনি চালাতেন তিনিই এই ধারাবিবরণীর দায়িত্ত্বে থাকতেন। বেশিরভাগ দেশে চলমান ছবির ফাঁকে ফাঁকে ইন্টারটাইটেল বা ছাপানো লেখা সংবলিত কার্ড গুঁজে দিয়ে কথোপকথন বা কাহিনীর খুঁটিনাটি বর্ণনা করে দেওয়া হত, কিন্তু জাপানের চলচ্চিত্রে সম্পূর্ণ নির্বাক যুগ ধরেই মানুষের দ্বারা কাহিনীবর্ণনই চলমান ছবির সঙ্গে সঙ্গত করে এসেছে। এই প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান ঘটে ১৯২৩ এ এসে।
এই ধারার চেয়ে কিছুটা আলাদা ছিল ইলাস্ট্রেটেড সং বা সচিত্র সঙ্গীত প্রদর্শনী। ১৮৯৪ তে যুক্তরাষ্ট্রের ভডেভিল হাউসগুলিতে (এক বিশেষ ধরনের বিচিত্রানুষ্ঠানগৃহ) এইধরনের প্রদর্শনীর উদ্ভব হয় আর প্রায় ১৯৩০ দশকের শেষ অব্দি চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহগুলোতে টিঁকে থাকে। স্টিরিওপ্টিকন জাতীয় ম্যাজিক লণ্ঠন যন্ত্রের সাহায্যে হাতে রাঙানো স্থিরচিত্রের স্লাইড প্রক্ষেপণ করা হত, সঙ্গে থাকত পিয়ানোবাদন সহযোগে গান (কখনো পূর্বগৃহীত সঙ্গীত)। গানের কাহিনীকেই স্লাইডের সাহায্যে চিত্ররূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হত, কাহিনী এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে স্লাইড পাল্টে দেওয়া হত। সচিত্র সঙ্গীত প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য ছিল শীট মিউজিকের (বিশেষ ধরনের হাতে লেখা বা ছাপানো সঙ্গীতের স্বরলিপি) বিক্রি বাড়ানো, সেইসময় এইরকম একেকটা স্বরলিপি দশ লক্ষ কপিও বিক্রি হয়েছে। পরবর্তীকালে, চলচ্চিত্রের উত্থানের পরে, এইধরনের সচিত্র সঙ্গীত দেখান হত চলচ্চিত্র শুরুর আগে বা রিল পরিবর্তনের সময়।
১৯১৪ সালে দি ফটো-ড্রামা অফ ক্রিয়েশন বা ‘সৃষ্টির চিত্রনাট্য’ নামের এক অবাণিজ্যিক উদ্যোগে চলমান ছবি ও শব্দকে সমলয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। জেহোভার সাক্ষী ধর্মগোষ্ঠীর অনুগত সংগঠন ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল এন্ড ট্রাক্ট সোসাইটি অফ পেনসিলভেনিয়া আট ঘণ্টার এই প্রদর্শনীটি প্রযোজনা করে, আশিটি শহরে এটা প্রতিদিন দেখান হত, যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডার প্রায় আশি লক্ষ মানুষ এই প্রদর্শনী দেখেছিলেন।
চলচ্চিত্রের জন্ম
যাত্রা শুরুর এগারো বছরের মধ্যেই চলচ্চিত্র তার অভিনবত্ত্ব কাটিয়ে উঠে এক বিশালায়তন বিনোদনশিল্পে পরিণত হয়। প্রথমে যা ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরী একটিমাত্র চলমান দৃশ্য, পরবর্তীতে তাইই পরিণত হয় বৃহদাকার কোম্পানির দ্বারা প্রস্তুত বহুদৃশ্যসংবলিত দীর্ঘায়তন শিল্পজাত পণ্যে। ১৯০০ এর সময় থেকেই নির্মাতারা প্রাথমিক স্তরের সম্পাদনাসহ আখ্যানধর্মী ছবি বানাতে শুরু করেন।
ক্যামেরার উদ্ভাবন এবং অগ্রগতি
গোড়ার দিকে চলমান চিত্রগ্রাহী ক্যামেরাকে ট্রাইপডের মাথায় বেঁধে রাখতে হত আর ক্যামেরাকে অনুভূমিক রাখার প্রয়োগকৌশলও ছিল সীমিত। শট নেওয়ার সময় ক্যামেরা থাকত অনড়। ক্যামেরাকে গতিশীল করতে গেলে চলন্ত গাড়িতে ক্যামেরা বসিয়ে রেখে ছবি তুলতে হত। লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় ১৮৯৬ সালে চলন্ত ট্রেনের মধ্যে ক্যামেরা রেখে এইভাবে ছবি তোলেন।
১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদ রবার্ট ডবলিউ. পল প্রথম ঘূর্ণায়মান ক্যামেরা যন্ত্র তৈরী করেন, ঐ পন্থায় প্যানিং শট নেওয়া সম্ভব ছিল। তার তৈরী যন্ত্রে একটা উল্লম্ব অক্ষের উপর ক্যামেরা বসান থাকত, সঙ্গে লাগান একটা বাঁকা হাতল ঘোরালে ওয়র্ম গিয়ার চলত, আর ঐ গিয়ারের ঘূর্ণনের সঙ্গে ক্যামেরাও ঘুরত। ঐ ক্যামেরা ব্যবহার করে তিনি রাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্ত্বের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষ্যে আয়োজিত শোভাযাত্রার ছবি একটিমাত্র দৃশ্যে ধরতে সমর্থ হন। তার পরের বছর থেকে তিনি এই যন্ত্র বিক্রি করতে শুরু করেন। সেই যুগের ফিল্ম ক্যাটালগে ঐরকম প্যানিং যুক্ত শটকে কখনো কখনো ‘প্যানোরামা’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
ফরাসী পরিচালক জর্জ মেলিয়েজ ১৮৯৭ সালের মে মাসে প্যারিসের উপকণ্ঠে একটি ফিল্ম ষ্টুডিও গড়ে তোলেন। একেবারে প্রাথমিক যুগে তৈরী স্টুডিওগুলোর মধ্যে এটি ছিল অগ্রগণ্য। স্থিরচিত্রের জন্য বানানো বৃহদাকার স্টুডিওগুলোর আদলে তৈরী এই স্টুডিওর তিনদিক ছিল কাচ দিয়ে ঘেরা, ছাদেও ছিল কাঁচের আচ্ছাদন, আর রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে আলো ডিফিউজ করার জন্য পাতলা সুতির কাপড়ে ছাদ ঢেকে নেওয়ারও ব্যবস্থা ছিল। ১৮৯৬ থেকে শুরু করে মেলিয়েজ পাঁচশোরও বেশি ছোট ছবি প্রযোজনা, পরিচালনা, আর পরিবেশনা করেন। এর বেশিরভাগই ছিল এক দৃশ্যের ছবি, একটিমাত্র টানা শটে তোলা। মেলিয়েজের কাজ থেকে বোঝা যায় যে তিনি মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে সাদৃশ্য টানার চেষ্টা করতেন। তবে তিনি বুঝতেন যে চলচ্চিত্র এমন এক বিশেষ দৃশ্যানুভূতি দিতে পারে মঞ্চে যা কখনোই সম্ভব নয়।
১৮৯৫ তে এডিসন কোম্পানির তৈরী দি এক্সিকিউশন অফ মেরি স্টুয়ার্ট ছবিতে স্কটল্যান্ডের রাণী মেরির শিরোচ্ছেদ দেখানো হয়। শেষ দৃশ্যের জন্য ব্যবহার করা হয় অভিনেত্রীর পুতুল। এই ছবিটি কিনেটোস্কোপ যন্ত্রের সাহায্যে দেখতে হত। জর্জ মেলিয়েজও তার দ্য ভ্যানিশিং লেডি ছবিতে একই ধরনের প্রয়োগকৌশল ব্যবহার করেন। স্টপ মোশন প্রযুক্তির সাহায্যে মহিলাটিকে ক্যামেরার সামনে দৃশ্যমান থেকে অদৃশ্য করে দেওয়া হয়।
চিত্রগ্রহণের এমনই আর একটি চতুর কৌশল ছিল ডবল এক্সপোজার। ব্রিটিশ উদ্ভাবক জর্জ এলবার্ট স্মিথ ১৮৯৭ সালের জুলাই মাসে এই ব্যাপারে সাফল্য পান। পুরো পারিপার্শ্বিক তিনি কালো কাপড়ে মুড়ে দেন, তারপর প্রধান শট নেওয়া হয়ে গেলে ঐ ফিল্মকে আবার ঘুরিয়ে নিয়ে এসে দ্বিতীয়বার এক্সপোজ করে আরেকটি শট নেন। তার দি কর্সিকান ব্রাদার্স ছবিটিকে ১৯০০ সালের ওয়ারউইক ট্রেডিং কোম্পানি র ক্যাটালগে অত্যন্ত যত্নসাধ্য চিত্রগ্রহণের ফল হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তরোয়ালের খোঁচায় মৃত্যুর পর চরিত্রটি অন্তর্হিত হয়, পরবর্তীতে তার পুরোপুরি স্বচ্ছ প্রেতাত্মাটিকে তুষারের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়।
রিভার্স মোশন বা বিপরীত চলন প্রয়োগকৌশলেরও প্রবর্তন করেন স্মিথ। প্রথমে তিনি একটি দৃশ্য তুলে নিতেন, তারপর ক্যামেরা উল্টো করে বসিয়ে আবার একই দৃশ্য শুট করতেন, তারপর দ্বিতীয় দৃশ্যের শেষ অংশটা প্রথম দৃশ্যের শেষে জুড়ে দিতেন। তার টিপসি, টোপসি, টার্ভি এবং দ্য অকোয়ার্ড সাইন পেন্টার ছবিতে এই কৌশলের ব্যবহার ছিল, তবে এই ছবিগুলি এখন আর পাওয়া যায়না। এখন এই কৌশলের সবচেয়ে পুরোনো নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় তার দ্য হাউস দ্যাট জ্যাক বিল্ট ছবিতে, এটি তিনি বানিয়েছিলেন ১৯০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
ব্রিটিশ নির্মাতা সিসিল হেপওয়ার্থ এই প্রয়োগকৌশলকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি গতিশীল ছবির নেগেটিভকে ফ্রেম অনুযায়ী পেছন থেকে সামনে প্রিন্ট করেন, তাতে করে সম্পূর্ণ বিপরীত গতিসম্পন্ন প্রিন্ট পাওয়া যায়। তিনি একটি বিশেষ ধরনের প্রিন্টার তৈরী করেন যাতে নেগেটিভকে অভিক্ষেপণ যন্ত্রের সাহায্যে আরেকটি ক্যামেরার মুখে প্রজেক্ট করা হত, আর সেই ক্যামেরায় বিশেষ ধরনের লেন্স লাগিয়ে একেবারে সমাকৃতি ছবি পাওয়া যেত। এই ব্যবস্থাপনার নাম দাঁড়ায় ‘প্রজেকশন প্রিন্টার’, এবং পরবর্তীকালে এই নীতির ভিত্তিতেই অপটিক্যাল প্রিন্টার তৈরী হয়।
১৯০০ সাল নাগাদই পল এবং হেপওয়ার্থের ছবিতে ক্যামেরার স্পিড নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চোখে পড়ে। ১৮৯৯ সালে অন এ রানওয়ে মোটর কার থ্রু পিকাডেলি সার্কাস ছবিতে পল খুব ধীরে ধীরে ক্যামেরা ঘোরান। পরে যখন ছবিটি ১৬ ফ্রেম প্রতি সেকেণ্ডে অভিক্ষেপ করা হয়, মনে হয় যেন দৃশ্যাবলী ভীষণ দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে। এর ঠিক বিপরীত কৌশল প্রয়োগ করেন হেপওয়ার্থ দ্য ইন্ডিয়ান চিফ এবং সিডলিৎজ পাউডার (১৯০১) ছবিতে। চিফ-এর চলাফেরার শট নেওয়া হয় ১৬ ফ্রেম প্রতি সেকেণ্ডের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে, তারপর স্বাভাবিক গতিতে সেই ছবি প্রক্ষেপণ করলে যে এফেক্ট পাওয়া যায় তাকেই আমরা এখন স্লো মোশন বলি।
চলচ্চিত্র সম্পাদনা এবং অবিচ্ছিন্ন কাহিনীবর্ণন
ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকেই একাধিক শট সংবলিত ছবি তৈরী হওয়া শুরু হয়। তবে এই ছবিগুলিকে অবিচ্ছিন্ন চলচ্চিত্র বলা যায়না, আলাদা আলাদা দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে গোঁজা থাকত স্লাইড, বক্তৃতা বা গানবাজনা, যাতে করে প্রদর্শনীর সময় বাড়ত, কখনো কখনো গিয়ে দাঁড়াত নব্বই মিনিট। বিশ্বের একেবারে প্রথম কাহিনীচিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হল দি ফেয়ারি অফ দ্য ক্যাবেজেস (১৮৯৬), ছবিটি তৈরী করেন ফরাসী মহিলা পরিচালক এলিস গি। ১৮৯৭ তে জর্জ মেলিয়েজ গ্রেকো-টার্কিশ যুদ্ধ নিয়ে একটি ছবির প্রদর্শন করেন। তবে ছবিতে এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে কোনো অবিচ্ছেদ্যতা ছিলনা। ১৮৯৮ তে মেলিয়েজের সিন্ডারেলা ছবিতেও কোনো দৃশ্যপরম্পরা ছিলনা। আগে থেকেই গল্পটা দর্শকের না জানা থাকলে দর্শককে উপস্থাপকের উপরই নির্ভর করতে হত।
চলচ্চিত্রে সত্যিকারের কন্টিন্যুইটি বা অবিচ্ছেদ্যতা রক্ষার পথিকৃৎ হলেন অগ্রণী ব্রিটিশ নির্মাতা রবার্ট ডবলিউ. পল। পলের তৈরী কাম এলং, ডু! ছবিকেই প্রথম সম্পাদিত ছবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৮৯৮ সালে তৈরী এই ছবিতেই প্রথম দুটো শট কে জোড়া লাগিয়ে ঘটনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছিল।প্রথম দৃশ্যে এক প্রবীণ যুগলকে দেখা গেল মধ্যাহ্নভোজন সেরে একটি শিল্পকলা প্রদর্শনীকক্ষের বাইরে থেকে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে, আর পরের দৃশ্যেই দেখা গেল তারা প্রদর্শনীকক্ষের ভেতরে কী কী করছেন। পল এর ‘সিনেমাটোগ্রাফ ক্যামেরা নং ১’ ছিল প্রথম ক্যামেরা যাতে ফিল্মের কোনো অংশ একবার এক্সপোজ করে আবার ঘুরিয়ে নিয়ে এসে দ্বিতীয়বারও এক্সপোজ করা যেত। এই প্রয়োগকৌশলের ব্যবহার দেখা যায় তার ১৯০১ সালে নির্মিত স্ক্রুজ, অর, মার্লে’স গোস্ট ছবিতে।
এই সময়ে ইংল্যান্ডের ব্রাইটন এবং হোভ অঞ্চলে কিছু চলচ্চিত্র নির্মাতা একাধিক শট বহুল ছবি তৈরির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জর্জ এলবার্ট স্মিথ আর জেমস উইলিয়ামসন। পরবর্তীকালে এদের গোষ্ঠীকে একত্রে ব্রাইটন স্কুল নামে অভিহিত করা হয়।১৮৯৯ তে স্মিথ তৈরী করেন দ্য কিস ইন দ্য টানেল। ছবিটি শুরু হয় একটি ট্রেনের ফ্যান্টম রাইড দিয়ে, ট্রেনটি একটি টানেলে ঢুকে পড়লে ট্রেনের অন্তর্দৃশ্য হিসেবে ট্রেনের কামরার প্রতিরূপ একটি সেট দেখান হয় যেখানে একটি পুরুষ একটি মহিলাকে চুম্বন করেন, তারপরেই আবার ফ্যান্টম রাইডের দৃশ্যটি ফিরে আসে এবং ট্রেনটি টানেল থেকে বেরিয়ে আসে। একমাস বাদে ইয়র্কশায়ারের বেমফোর্ট কোম্পানি একই নাম দিয়ে ছবিটি আবার তোলেন, তাদের সংস্করণে ফ্যান্টম রাইডের বদলে ট্রেনের টানেলে ঢোকা আর বেরোনোর দৃশ্যগুলি ট্রেনলাইনের ধার থেকে শুট করা হয়।
এই ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে ১৯০০ সালে স্মিথ তৈরী করেন অ্যাস সিন থ্রু এ টেলিস্কোপ, এই ছবির মুখ্য দৃশ্য ছিল রাস্তায় এক যুবক খুব যত্নের সঙ্গে তার বান্ধবীর জুতোর ফিতে বেঁধে দিচ্ছেন, আর একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক দূর থেকে টেলিস্কোপের সাহায্যে সেই দৃশ্য দেখছেন। তারপর কাট করে যুবতীর পায়ের ক্লোজ-আপ দেখান হয়, এবং তারপরেই কাট ব্যাক করে মূল দৃশ্যে ফিরে যাওয়া হয়। ঐ একই সময়ে তৈরী জেমস উইলিয়ামসন এর অ্যাটাক অন এ চায়না মিশন স্টেশন ছবিটি আরও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ছবির প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় চৈনিক বক্সার বিদ্রোহীরা একটি ব্রিটিশ মিশন আক্রমণ করছে, পরের দৃশ্যে দেখা যায় মিশনের ভিতরের বাগানে টানা যুদ্ধ চলছে। মিশনারির স্ত্রী বারান্দা থেকে সংকেত দিলে একদল সশস্ত্র ব্রিটিশ নৌসেনা এসে পৌঁছায় এবং বিদ্রোহীদের পরাজিত করে মিশনারিদের উদ্ধার করে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক দৃশ্য থেকে কাট করে সম্পূর্ণ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে উল্টো দিক থেকে একই দৃশ্য দেখানো, পরিভাষায় যাকে বলে ‘রিভার্স কাট’,এই ছবিতেই প্রথম দেখা যায়।
১৯০০ সালে অ্যাস সিন থ্রু এ টেলিস্কোপ ছাড়াও গ্র্যান্ডমা’স রিডিং গ্লাস ছবিতে ক্লোজ-আপ শট নিয়ে স্মিথ অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ১৯০১ সালে দ্য লিটল ডক্টর ছবি থেকে শুরু করে পরের কয়েক বছরে তিনি একই শটকে ভেঙে ভেঙে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে ক্যামেরা বসিয়ে শুটিং করার ধারণাকে অনেক সম্প্রসারিত করেন। সাবজেক্টিভ এবং অবজেক্টিভ পয়েন্ট অফ ভিউ শট এর ধারণা তিনিই ছবিতে নিয়ে আসেন। ১৯০৩ সালে মেরি জেন’স মিসহ্যাপ ছবিতে তিনি তার উদ্ভাবিত যাবতীয় কলাকৌশল প্রদর্শন করেন। এরপর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ ছেড়ে রঙিন আলোকচিত্রগ্রহনযন্ত্র তৈরী করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার ছবিগুলি দিয়েই চলচ্চিত্রের ব্যাকরণ এর সূচনা হয়।
এক শট থেকে অন্য শটে বহে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহকে সার্থকভাবে চলচ্চিত্রে উপস্থাপনা করার চেষ্টায় জেমস উইলিয়ামসন একাধিক ছবি বানান, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯০১ সালে বানানো স্টপ থিফ, ফায়ার!, ইত্যাদি। ছবিতে ক্লোজ-আপের ব্যবহার নিয়েও তিনি অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। দ্য বিগ সোয়ালো ছবিতে একটি চরিত্র তো ক্যামেরাকেই গিলে খেতে আসে। ব্রাইটন স্কুলের এই দুই চলচ্চিত্র নির্মাতা ফিল্মের উপর রঙ করে আর নানারকম ফটোগ্রাফিক কৌশল ব্যবহার করে চলচ্চিত্রের কাহিনী অংশের উৎকর্ষ বাড়ানোর চেষ্টা করেন। তারা প্রায় পাঁচ মিনিট লম্বা ছবিও তৈরী করেছিলেন।
উইলিয়ামসনের স্টপ থিফ ছবির প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় এক ভবঘুরেকে কসাইখানা থেকে মাংস চুরি করতে, পরবর্তী দৃশ্যে কসাইয়ের ছেলে কুকুর নিয়ে তাকে তাড়া করে, এবং শেষ দৃশ্যে কুকুররা তাকে ধরে ফেলে। এই ছবির অনুকরণে পরবর্তীকালে অনেক ‘চেজ ফিল্ম’ বা অনুসরণমূলক ছবি তৈরী হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ফরাসী গোমন্ট কোম্পানির ব্রিটিশ শাখার প্রযোজনায় আলফ কলিন্স এর তৈরী অ্যান ইলোপমেন্ট আ লা মোদে আর দ্য পিকপকেট: এ চেজ থ্রু লন্ডন, শেফিল্ড ফটোগ্রাফিক কোম্পানির প্রযোজনায় ফ্র্যাঙ্ক মটারশ র তৈরী ডেয়ারিং ডেলাইট বার্গলারি, উইলিয়াম হ্যাগার এর তৈরী ডেসপারেট পোচিং অ্যাফ্রে, ইত্যাদি। শেষোক্ত ছবিটিতে চোরাশিকারীদের তাড়া করার দৃশ্যে হ্যাগার প্যানিং শট এর সাহায্যে ছবিতে দ্রুততার অনুভূতি নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। তার উপস্থাপনার গভীরতা এবং স্পেস ব্যবহারের চাতুর্য্য ফিল্ম-তাত্ত্বিকদের প্রশংসা পেয়ে এসেছে।তার চলচ্চিত্রে হিংস্রতাকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে বিনোদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার প্রবণতাও দেখা যায়।
অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মাতারা ব্রাইটন স্কুলের এই ধ্যানধারণাগুলি গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আমেরিকার চলচ্চিত্র নির্মাতা এডউইন এস. পোর্টার। তিনি ১৯০১ সালে এডিসন কোম্পানির হয়ে ছবি তৈরী করতে শুরু করেন। পোর্টার প্রথমে ছিলেন প্রোজেকশনিস্ট অর্থাৎ অভিক্ষেপণ যন্ত্রচালক। এডিসন কোম্পানিতে তাকে নেওয়া হয় তাদের নতুন মডেলের ভিটাস্কোপ যন্ত্রের উন্নতিসাধনের জন্য। এক-দৃশ্যের ছোট ছবির বদলে পোর্টার চাইতেন ছবির মাধ্যমে গল্প বলতে। একটু বড় ছবি বানানোর জন্য তিনি জর্জ মেলিয়েজের মতো শটের মাঝখানে ডিজল্ভ সম্পাদনা রীতি ব্যবহার করে একই ঘটনা ঘনঘন ডিজল্ভ দিয়ে জুড়ে দিতেন। ১৯০৩ সালেই তিনি বানান প্রায় বারো মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবি দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি, যাতে মোট কুড়িটি আলাদা আলাদা শট ছিল। ছবির অন্তর্দৃশ্য ও বহির্দৃশ্য গ্রহণ করা হয়েছিল দশটি বিভিন্ন স্থানে, আর দুটি আলাদা জায়গায় দুটি আলাদা ঘটনাপ্রবাহ একই সময়ে চলছে বোঝাতে ক্রস-কাটিং সম্পাদনা রীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। ছবিতে সময়ের অবিচ্ছেদ্যতা কিছু কিছু জায়গায় বিভ্রান্তিকর হলেও আমেরিকার ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’ অঞ্চলের হিংস্রতাকে তুলে ধরে এই ছবিটি বিপুল পরিমাণ সাফল্য পায় এবং পরবর্তীকালে সাধারণ্যে চলচ্চিত্রমাধ্যমের প্রবল জনপ্রিয়তার অগ্রদূত হয়ে ওঠে।
১৯০২ সাল থেকে ফ্রান্সের প্যাথে কোম্পানিও স্মিথ ও উইলিয়ামসনের ছবির অনুকরণে এবং তাদের প্রয়োগকৌশলের কিছু রদবদল ঘটিয়ে অনেক ছবি তৈরী করেন যা প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এই সময়ের একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী ছবি হল জর্জ মেলিয়েজের চৌদ্দ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবি লে ভয়েজ দানস লা লুনে (চন্দ্রাভিযান)। মেলিয়েজের তৈরী শতাধিক ছবির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এই ছবিটি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। প্রথম যুগের সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম বা কল্পবিজ্ঞান ছবির অন্যতম এই চলচ্চিত্রে অ্যানিমেশন এবং স্পেশাল এফেক্টের ব্যবহার ছিল। সবচেয়ে চমকপ্রদ ছিল চাঁদের চোখের ওপর চন্দ্রযানের অবতরণের দৃশ্য। প্যাথে কোম্পানির প্রযোজনার বহর তাদের নির্মাতাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের খুঁটিনাটি আরো স্পষ্ট ও নির্ভুল করে তুলতে সাহায্য করেছিল।
অ্যানিমেশন
চলচ্চিত্রে অ্যানিমেশনের প্রথম প্রয়োগ হয় ১৮৯৯ সালে। ব্রিটিশ নির্মাতা আর্থার মেলবোর্ন-কুপার ম্যাচেস: অ্যান অ্যাপিল নামে একটি তিরিশ সেকেণ্ড দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরী করেন স্টপ-মোশন প্রযুক্তির সাহায্যে। এই ছবিতে দর্শকদের সাউথ-আফ্রিকায় যুদ্ধরত ব্রিটিশ সৈনিকদের ব্যবহারের জন্য দিয়াশলাই পাঠানোর আবেদন জানান হয়, বলা হয় একটি বিশেষ দিয়াশলাই কোম্পানি, ব্রান্ট অ্যাণ্ড মে কে টাকা পাঠালে তারাই ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে দিয়াশলাই পৌঁছে দেবে। ছবিতে দিয়াশলাইয়ের তৈরী ছোট পুতুল কালো দেওয়ালের ওপর এই আবেদন লিখে দেয়। প্রতিটি ফ্রেমে আলাদা আলাদা করে তৈরী করে ঐ পুতুলের নড়াচড়ার বিভ্রম তৈরী করা হয়েছিল। ১৮৯৯ এর ডিসেম্বর মাসে লন্ডনের এম্পায়ার থিয়েটারে এই ছবি প্রদর্শিত হয়।
চলচ্চিত্রে অ্যানিমেশন প্রয়োগকৌশলের উন্নতি সহসা হয়নি। প্রাথমিকভাবে এই কৌশল দু-তিনটে ফ্রেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। যেমন এডউইন এস. পোর্টার এর ফান ইন এ বেকারি শপ (১৯০২) ছবিতে তিনটে ফ্রেমের ক্রমান্বয়ে ময়দার তালকে হাসতে দেখা গিয়েছিল। ব্রিটিশ শর্ট ফিল্মের সমান মাণ অর্জন করতে অ্যানিমেশনকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯০৫ পর্যন্ত। ঐ বছরে পোর্টার তৈরী করেন হাউ জোন্স লস্ট হিস রোল এবং দ্য হোল ড্যাম ফ্যামিলি অ্যাণ্ড দ্য ড্যাম ডগ, দুটি ছবির ইন্টারটাইটেলেই ইংরেজি বর্ণমালার হরফ এলোমেলোভাবে ঘুরেফিরে এসে শব্দ তৈরী করেছিল। এখানে প্রতিটি ফ্রেমকেই আলাদা করে এক্সপোজ করা হয়েছিল, আর প্রতিটি ফ্রেমেই হরফগুলোকে একটু করে নড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর জন্য প্রয়োজন হয়েছিল বিশেষ ধরনের ক্যামেরা যাতে হ্যাণ্ডেল ঘোরালে একটিমাত্র ফ্রেম এক্সপোজ হয় (সাধারণ ক্যামেরায় এক্সপোজ হত আটটি ফ্রেম)। এই কৌশলই পরবর্তীকালে উন্নত হয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ‘সিঙ্গল ফ্রেম অ্যানিমেশন’ বা ‘অবজেক্ট অ্যানিমেশন’-এ।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিটাগ্রাফ স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা অ্যালবার্ট এডোয়ার্ড স্মিথ এবং জেমস স্টুয়ার্ট ব্ল্যাকটন অ্যানিমেশন প্রয়োগকৌশলকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। তাদের তৈরী হিউমরাস ফেজেস অফ ফানি ফেসেস (১৯০৬) ছবিতে মানুষের কার্টুন চিত্রকে এক ভঙ্গিমা থেকে অন্য ভঙ্গিমায় পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। মানুষের কাট-আউটটি তৈরী করা হয়েছিল আলাদা আলাদা অংশ জোড়া লাগিয়ে। প্রতিটি ফ্রেম এক্সপোজ করার আগে ঐ অংশগুলোর অল্প অল্প স্থান পরিবর্তন করে দেওয়া হত,ঠিক যেভাবে পোর্টার তার ছবিতে হরফের চলন দেখিয়েছিলেন। তবে ছবির একটা ছোট অংশে পুরো চিত্রটিকেই প্রতি ফ্রেমে পাল্টে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক যেভাবে বর্তমানে অ্যানিমেশন ছবি তৈরী করা হয়।
‘সিঙ্গল ফ্রেম অ্যানিমেশন’ প্রয়োগকৌশলকে ১৯০৭ সালে আরও উন্নত করেন পোর্টার তার দি টেডি বিয়ারস ছবিতে এবং ব্ল্যাকটন তার ওয়ার্ক মেড ইজি ছবিতে। পোর্টারের ছবিতে একটি খেলনা ভল্লুককে নিজে নিজে চলতে দেখা যায়, আর ব্ল্যাকটন দেখান যন্ত্রপাতি আপনা থেকেই কাজকর্ম করে যাচ্ছে। ইউরোপেও এই কৌশলে কাজ হতে থাকে, প্যাথে কোম্পানিতে সেগান্দ দ্য শমন তৈরী করেন স্কাল্পচার মডার্নে (১৯০৮), এই ছবিতে ক্লে অ্যানিমেশন ব্যবহার করে ভাস্কর্য্যের রূপান্তর দেখানো হয়। এই সময়ে প্যাথে কোম্পানিতে সিল্যুট ছবির অ্যানিমেশনও তৈরী হয়েছিল। ফ্রান্সেই এমিল কোল ১৯০৮ সালে ফ্যান্টাসম্যাগোরি দিয়ে শুরু করে পরপর অনেকগুলি ছবি বানান, তাতে মানুষ এবং অন্যান্য বস্তুর আঁকা ছবির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং রূপান্তর দেখা গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে উইনসর ম্যাককে ভিটাগ্রাফ কোম্পানির জন্য অপেক্ষাকৃত বাস্তবানুগ আকার আকৃতি ও মসৃন চলন সংবলিত ছবি লিটল নিমো বানান ১৯১১ সালে। এর পরবর্তী কয়েক বছরে বিশ্বের অনেক স্থানেই অ্যানিমেশন ছবির প্রভূত উন্নতি হয়। ‘
বিশ্বের প্রথম অ্যানিমেশনের সাহায্যে তৈরী কাহিনীচিত্র হল এল অ্যাপোস্টল (১৯১৭)। কাট-আউট অ্যানিমেশনের সাহায্যে এই ছবিটি বানিয়েছিলেন ইতালীয়-আর্জেন্টাইন কার্টুনশিল্পী কিরিনো ক্রিস্টিয়ানি। প্রথম শব্দযুক্ত অ্যানিমেশন ছবি পেলুডোপোলিস (১৯৩১) এর স্রষ্টাও ক্রিস্টিয়ানি, ভিটাফোন সাউণ্ড অন ডিস্ক যন্ত্রে এই ছবিতে শব্দ ও ছবিকে সমলয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, ছবির প্রযোজক ফেদেরিকো ভ্যালের স্টুডিওতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এই ছবির শেষ কপিটিও নষ্ট হয়ে যায়।
১৯৩২ সালে তৈরী ওয়াল্ট ডিজনির ফ্লাওয়ার্স অ্যাণ্ড ট্রিস ছিল প্রথম টেকনিকালার অ্যানিমেশন ছবি। টেকনিকালার হল এক বিশেষ ধরনের পদ্ধতি যাতে তিন বর্ণের (সবুজ, লাল আর নীল) আলাদা আলাদা আলোকচিত্রের সাহায্যে রঙ ফুটিয়ে তোলা হত। এর জন্য প্রয়োজনীয় ক্যামেরার আকারও ছিল বিশাল। এই ছবির পরিচালক ছিলেন বার্ট গিলেট।
কাহিনীচিত্র
১৯০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় তৈরী দি স্টোরি অফ দ্য কেলি গ্যাং ছবিটিকে একাধিক রিল সংবলিত প্রথম কাহিনীচিত্র বলা হয়। কিংবদন্তীসম কুখ্যাত অপরাধী নেড কেলি (১৮৫৫-১৮৮০)র জীবনী অবলম্বনে তৈরী এই ছবির রিল ছিল ৪০০০ ফুট (প্রায় ১২০০ মিটার) লম্বা, প্রদর্শনের সময়সীমা ছিল এক ঘণ্টারও বেশি।১৯০৬ সালের ২৬শে ডিসেম্বর মেলবোর্নের কলিনস স্ট্রিটে অবস্থিত এথেনিয়াম প্রেক্ষাগৃহে এই ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়, পরে যুক্তরাজ্যে প্রদর্শিত হয় ১৯০৮ এর জানুয়ারিতে।
পূর্ণতাপ্রাপ্তি
শুধুমাত্র ফিল্ম প্রদর্শনের জন্য প্রথম স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ তৈরী হয় পিটসবার্গে, ১৯০৫ সালে, নাম ছিল দি নিকেলোডিয়ন। এখানে একাধিক ছোটবড় ছবি নিয়ে মোটামুটি আধ ঘণ্টার একটা শো হত, সপ্তাহান্তে ছবি বদলে দেওয়া হত। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশকরা দ্রুত এই মডেল অনুসরণ করেন, আর বছর দুয়েকের মধ্যেই সহস্রাধিক এইধরনের নিকেলোডিয়ন স্থাপনা করা হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে সাফল্যের অভিজ্ঞতায় সারা বিশ্ব জুড়েই ছবি প্রযোজনা ও প্রদর্শনের ধুম লেগে যায়।
১৯০৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স জুড়ে প্রচুর প্রেক্ষাগৃহ তৈরী হয়, বড় শহরগুলোতে তো বেশ বড় জায়গা জুড়েই! এখানে ছবির সঙ্গে পিয়ানো আর অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সরাসরি পরিবেশনের ব্যবস্থা থাকত। এইসময় একেকটা প্রমাণ সাইজের ছবির দৈর্ঘ্য হত ১০০০ ফিটের মত (প্রায় ৩০০ মিটার), প্রেক্ষাগৃহে এরকম কয়েকটা ছবি নিয়ে মোটামুটি ৩০ মিনিটের শো চলত। সপ্তাহে এক বা একাধিকবার (কখনও পাঁচ বারও) ছবি বদল হত। ফ্রান্সের প্যাথে কোম্পানি প্রাথমিকভাবে ছবির বাজারের সিংহভাগ দখল করলেও মার্কিন কোম্পানিগুলি খুব দ্রুত বাজার ছেয়ে ফেলে। ১৯০৭ থেকে প্যাথে কোম্পানি বিদেশে ছবির স্বত্ত্ব বিক্রি করার বদলে ভাড়া বা বিনিময় প্রথা শুরু করে। ১৯১০ সালের মধ্যেই ছবির টাইটেলে অভিনেতা-অভিনেত্রীরদের নাম লেখা শুরু হয়, আর চলচ্চিত্র-তারকা হিসেবে তাদের জনপ্রিয়তার পথ সুগম হয়। ছবিও দৈর্ঘ্যে বাড়তে থাকে, নিত্যনতুন গল্প ও তার চলচ্চিত্রায়নের পদ্ধতির উদ্ভাবন হতে থাকে।
মার্কিন কোম্পানিগুলির মধ্যে পেটেন্ট সংক্রান্ত বিবাদের সুবাদে একটা ট্রাস্ট তৈরী হয়, এবং কোম্পানিগুলিকে তাদের সাপ্তাহিক নির্মাণ কোটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ট্রাস্ট নিয়ম বানায় যে বড় কোম্পানিগুলো সপ্তাহে দুটো আর ছোট কোম্পানিগুলো সপ্তাহে একটার বেশি রিল তৈরি করতে পারবেনা! কিন্তু যদিওবা প্রায় ৬০০০ প্রদর্শক কোম্পানি ট্রাস্টের নিয়ম মানতে শুরু করে, আরও ২০০০ কোম্পানি এই নিয়মের পরোয়া না করে নতুন নতুন প্রোডাকশন কোম্পানিকে টাকা জোগাতে থাকে। ১৯১২ সালের মধ্যে এই স্বাধীন কোম্পানিগুলো বাজারের প্রায় অর্ধেক দখল করে নেয়। পরে সরকারের হস্তক্ষেপে এইরকম ট্রাস্ট বিরোধী নতুন প্রতিযোগিতামূলক আইনের সূচনা হয়।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, হলিউড জমানা শুরুর পূর্বে, আমেরিকায় চলচ্চিত্র ব্যবসার মূল কেন্দ্রস্থল ছিল নিউ জার্সির ফোর্ট লী অঞ্চল। কিন্তু শীতকালের কথা চিন্তা করে নির্মাতারা এমন একটা জায়গা খুঁজছিলেন যেটা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ, রেল-যোগাযোগ উন্নত আর সস্তার শ্রমিক সুলভ। এইকারণে ফ্লোরিডার জ্যাকসনভিল অঞ্চল সেইসময় বিশ্ব চলচ্চিত্রের শীতকালীন রাজধানী ওঠে। ১৯০৮ এ নিউ ইয়র্কের কেলম কোম্পানি জ্যাকসনভিলে স্থায়ী স্টুডিও খোলে। এক দশকের মধ্যেই প্রায় তিরিশটি ফিল্ম কোম্পানির স্টুডিও সেখানে চালু হয়ে যায়, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মেট্রো পিকচারস (পরবর্তীকালের এমজিএম), এডিসন স্টুডিও, ম্যাজেস্টিক ফিল্মস, কিং বী ফিল্ম কোম্পানি, ভিম কমেডি কোম্পানি, নর্ম্যান ষ্টুডিও, গোমন্ট কোম্পানি আর লুবিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি। ১৯১৪ সালে এই লুবিন কোম্পানিতে জর্জিয়ার কৌতুকাভিনেতা অলিভার হার্ডি তার ফিল্ম কেরিয়ার শুরু করেন। প্রথম বছরেই তিনি ৩৬টিরও বেশি নির্বাক ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯১৫ র শুরুতে লুবিন বন্ধ হয়ে গেলে তিনি নিউ জার্সিতে চলে আসেন, তবে ভিম কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে আবার জ্যাকসনভিলে ফিরে আসেন ১৯১৭ তে, শেষপর্যন্ত ১৯১৭ তেই লস এঞ্জেলেসে চলে যান। প্রথম টেকনিকালার ছবি, এমনকি আমেরিকার প্রথম রঙিন পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র দি গাল্ফ বিটুইন তৈরী হয় এই জ্যাকসনভিলেই, ১৯১৭ সালে।
আফ্রিকান-আমেরিকান চলচ্চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে জ্যাকসনভিলের গুরুত্ত্ব ছিল অপরিসীম। জ্যাকসনভিলের লিঙ্কন মোশন পিকচার কোম্পানি ছিল আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ পরিচালিত ফিল্ম কোম্পানি আর অস্কার মিশিও ছিলেন প্রথম বিশিষ্ট কৃষ্ণাঙ্গ প্রযোজক পরিচালক। এইসময়ের একজন অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ত্ব ছিলেন রিচার্ড নর্ম্যান, যিনি নিজে শ্বেতাঙ্গ হয়েও নিজের জ্যাকসনভিলের স্টুডিওতে শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ কলাকুশলীদের নিয়ে ছবি বানাতেন। প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে গিয়ে নর্ম্যান ও তার সমমনস্ক নির্মাতারা কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ইতিবাচক চরিত্রে ব্যবহার করতেন।
জ্যাকসনভিলের রক্ষণশীল বাসিন্দারা চলচ্চিত্রশিল্পকে খুব একটা সুনজরে দেখতেন না, বিশেষ করে প্রকাশ্যে ব্যাঙ্ক লুঠ, পিছু ধাওয়া করা, অগ্নি-সংকেত, বা দাঙ্গা-হাঙ্গামার অনুকরণ তাদের একেবারেই না-পসন্দ ছিল। এই চলচ্চিত্রবিরোধী হাওয়ার ওপর ভর করে ১৯১৭ সালে রক্ষণশীল ডেমোক্র্যাট পার্টির জন ডব্লিউ মার্টিন স্থানীয় মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু ততদিনে অগ্রণী নির্মাতা উইলিয়াম সেলিগ আর ডি ডব্লিউ গ্রিফিথের সৌজন্যে চলচ্চিত্র নির্মাণের নতুন কেন্দ্র হিসেবে উঠে এসেছে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া। এরপর চলচ্চিত্রকেন্দ্র হিসেবে জ্যাকসনভিলের দ্রুত পতন ঘটে।
আরও একটি কারণ চলচ্চিত্রশিল্পের আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে স্থান-পরিবর্তনের ঘটনা ত্বরান্বিত করেছিল। এডিসন কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা আর পেটেন্ট সংক্রান্ত দাবিদাওয়া নিয়ে নির্মাতারা বিরক্ত ছিলেন। সেলিগ ১৯০৯ সালে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া চলে আসেন। পশ্চিমের তীব্র সূর্যালোক আর সংশ্লিষ্ট দৃশ্যাবলীর সাহায্যে ওয়েস্টার্ন ঘরানার ছবি তৈরী হয় এবং যা পরবর্তীকালে আমেরিকার প্রধান জনপ্রিয় ফিল্ম জঁর হয়ে ওঠে, ব্রঙ্কো বিলি এন্ডারসন আর টম মিক্স হয়ে ওঠেন প্রথম যুগের কাউবয়-তারকা। সেলিগ স্থানীয় চিড়িয়াখানার সাহায্য নিয়ে বন্য জন্তু সহযোগে দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারমূলক ছবি তোলেন, এই কাজে তিনিই পথিকৃৎ বলা চলে। কেলম কোম্পানি আসল পটভূমিকায় ছবি বানাতে পছন্দ করতেন এবং তারজন্য আমেরিকার বাইরেও শুটিং করতে পিছপা হতেন না। কেলম কোম্পানিই প্রথম তাদের ওয়েস্টার্ন ছবিতে একজন মহিলাকে (রুথ রোল্যান্ড, ১৯১২ সালে) অ্যাকশন ষ্টার হিসেবে নিয়োগ করেন।
ফ্রান্সে প্যাথে কোম্পানিই ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী, কাছাকাছি ছিল গোমন্ট, যদিও নতুন কোম্পানিরা দ্রুত উঠে আসছিল। ১৯০৮ সালের শুরুতে স্থাপিত ফিল্ম দ্য আর্ট কোম্পানির কাজকর্ম ছিল একটু অন্য ধরনের। তারা শ্রেষ্ঠতম নাট্যকার, শিল্পী আর কলাকুশলীদের নিয়ে একটু গুরুগম্ভীর বিষয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। তৃতীয় হেনরির দরবারের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় তারা লে এসিস্ট্যান্ট দু ডুক দ্য গিস (ডিউক অফ গিসের হত্যা) নামে একটি ছবি বানান। কমেডি ফ্রাঁসে থিয়েটারের মুখ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে তৈরী এই ছবিতে নেপথ্য সংগীতের দায়িত্ত্বে ছিলেন বিখ্যাত ফরাসী সংগীতজ্ঞ ক্যামিল শাঁ-সেনস। অন্যান্য ফরাসী কোম্পানিগুলোও এগিয়ে আসে এবং বিশেষ ধরনের শিক্ষিত দর্শকদের দিকে লক্ষ্য রেখে একধরনের শিল্পসম্মত ছবি বা আর্ট ফিল্ম তৈরী হতে থাকে। ১৯১০ সালের মধ্যে ফরাসী কোম্পানিগুলো দুই কি তিন রিল সংবলিত ছবি তৈরী শুরু করে, যদিও বেশিরভাগ ছবি তখনও এক রিলেরই হত। এই প্রবণতা ইতালি, ডেনমার্ক আর সুইডেনেও ছড়িয়ে পড়ে।
যুক্তরাজ্যে ফিল্ম ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯০৯ সালে সিনেমাটোগ্রাফ আইন ১৯০৯ পাশ হয়। ফিল্ম তৈরী হত অতিশয় দাহ্য পদার্থ সেলুলোজ নাইট্রেট দিয়ে, প্রদর্শন কখনও হত অস্থায়ী ছাউনিতে, আর প্রদর্শনে ব্যবহার হত লাইমলাইট, সবমিলিয়ে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা থেকেই যেত। নতুন আইনে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের নিয়মকানুন কঠোর করা হয়, অভিক্ষেপণ যন্ত্রকে অগ্নি-নিরোধক পরিবেশে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়।
১৯১০ সাল থেকে ছবির সঙ্গে নিয়মিত সংবাদচিত্র দেখান শুরু হয় আর নতুন সংবাদমাধ্যম হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যায়। উল্লেখযোগ্য সমসাময়িক ঘটনা, যেমন ব্রিটিশ দক্ষিণ মেরু অভিযান টেরা নোভার ছবি বা মহিলাদের ভোটাধিকারের দাবিতে সাফ্রাগেট জনবিক্ষোভের ছবি সংবাদচিত্র হিসেবে দেখান হত। প্রকৃতি নিয়ে তথ্যচিত্র বা ওয়াইল্ডলাইফ ফিল্মের পথিকৃৎ এফ পার্সি স্মিথ ১৯১০ সালেই তার গ্রোথ অফ ফ্লাওয়ার তথ্যচিত্রে সময় বহে যাওয়ার অনুষঙ্গ নিয়ে আসা টাইম-ল্যাপস টেকনিক ব্যবহার করেন।
চলচ্চিত্র প্রযোজনায় অন্যান্য দেশ
বিশ্ব জুড়ে চলচ্চিত্রের দ্রুত জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দেশও ব্রিটেন, ফ্রান্স আর যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। ইতালিতে তুরিন শহর দিয়ে শুরু করে অনেক শহরেই চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। ১৯০৫ সালে স্থাপিত প্রথম ও সেইসময়ের ইতালির বৃহত্তম ফিল্ম কোম্পানি আম্ব্রোসিও-র মূল প্রতিযোগী ছিল ১৯০৬ সালে রোমে স্থাপিত কোম্পানি সিনেস। ইতালির ছবিগুলির বিশেষত্ব ছিল বিশাল কলাকুশলী এবং দৃশ্যাবলীর সমন্বয়ে ঐতিহাসিক মহাকাব্যের চিত্ররূপ। ১৯১১ তে জিওভানি পাস্ত্রনে র তৈরী দুই রিলের ছবি লা কাদুতা ডি ট্রইয়া (ট্রয়ের পতন) ছবিটি সারা বিশ্বেই সমাদৃত হয়েছিল। এই সময়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবি হল ১৯১২ তে পরিচালক এনরিকো গুয়াজ্জোনির বানানো ৯০ মিনিটের ছবি কুও ভাদিস? আর ১৯১৪ তে পাস্ত্রনের বানানো আড়াই ঘণ্টার কাবিরিয়া। অন্যদিকে আবার আঁদ্রে ডিড বিখ্যাত হয়েছিলেন তার স্ল্যাপস্টিক কমেডির জন্য।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সমগ্র উত্তর ইউরোপে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণকারী দেশ ছিল ডেনমার্ক। ১৯০৬ সালে নরডিস্ক কোম্পানির পত্তন করেন ওলে ওলসন, আর পরের বছরেই তিনি ৬৭টি ছবি প্রযোজনা করেন। এরমধ্যে ছিল বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ছবি যেমন দেন হাইড স্লাহিন্দে (শ্বেত ক্রীতদাস), ইসবয়েরনেনজাগ (মেরু ভালুক শিকার) আর লভ্যাগতেন (সিংহ শিকার), বেশিরভাগই পরিচালনা করেছিলেন ভিগো লারসেন। ১৯১০ এর মধ্যে বেশ কিছু ছোট কোম্পানিও ব্যবসায় আসে এবং তারা বিষয়বৈচিত্র্যের দিকে নজর দেয়। কসমোরামা কোম্পানির জন্য পিটার আরবান গ্যাড পরিচালনা করেন আফগ্রান্ডেন (পাতাল), এতে অভিনয় করেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী অ্যাস্ট্রা নিয়েলসন। এই ছবিতে যৌনতা, প্রতিহিংসা, নরহত্যার ব্যবহার ও পরবর্তীকালে ছবির সাফল্য ডেনমার্কের চলচ্চিত্রের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
ডেনমার্কের তুলনায় সুইডেনের চলচ্চিত্র শিল্প আকার আয়তনে ছিল অনেক ছোট আর উত্থানের গতিও ছিল মন্থর। এখানে গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ত্ব ছিলেন চার্লস ম্যাগনাসসন। প্রাথমিক জীবনে তিনি ছিলেন সংবাদচিত্রগ্রাহক, তারপর ১৯০৯ সালে চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করেন, কয়েকটি পরিচালনাও করেন। ১৯১২ তে ভিক্টর সস্ত্রম আর মরিৎজ স্টিলার কে পরিচালক হিসেবে পেয়ে ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ডেনমার্কের ছবির অনুকরণে শুরু করলেও ১৯১৩ সালের মধ্যে তারা নিজস্বতা খুঁজে পান এবং সাফল্যও অধরা থাকেনা।
ফ্রান্সের প্যাথে কোম্পানির শুটিং এর হাত ধরে রাশিয়াতে চলচ্চিত্র শিল্পের পত্তন ঘটে ১৯০৮ সালে। পরে আলেক্সান্ডার দ্রানকোভ আর আলেক্সান্ডার খানহনকভ খাঁটি রুশ ফিল্ম কোম্পানি শুরু করেন। ১৯১৮ পর্যন্ত এই কোম্পানিই ছিল রাশিয়ার সর্ববৃহৎ ফিল্ম কোম্পানি।
জার্মানিতে অস্কার মেসটার ১৮৯৬ থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু ১৯১০ পর্যন্ত সেরকম উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা করে উঠতে পারেননি। বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্র নির্মাণের ঝড় উঠলে অস্কার এবং আরো অন্যান্য কিছু নির্মাতা তাদের ছবির প্রিন্ট বিক্রি করতে শুরু করেন, কিন্তু তাদের লোকসান হতে থাকে। ১৯১১ তে পল ডেভিডসন তৈরী করেন প্রজেকশন-এজি ইউনিয়ন কোম্পানি (সংক্ষেপে পিএজিইউ), ডেনমার্ক থেকে অ্যাস্ট্রা নিয়েলসন আর আরবান গ্যাডকে জার্মানিতে নিয়ে আসেন, তারপর ব্যবসার চাকা ঘুরতে শুরু করে। প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে অস্কার পরপর কয়েকটি বেশ লম্বা দৈর্ঘ্যের ছবি বানান, সেগুলো জার্মান-ভাষাভাষী অঞ্চলে সাফল্য পেলেও বাকি আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় কল্কে পায় না। ফরাসী এক্লেয়ার কোম্পানির জার্মান শাখা ডয়েশ এক্লেয়ার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বাজারে থাকলেও যুদ্ধের সময় সরকার দ্বারা বাজেয়াপ্ত হয়। মোটের উপর ১৯১৪ র আগে জার্মান বাজারে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রভাব অকিঞ্চিৎকর ছিল।
সামগ্রিকভাবে বিংশ শতকের প্রথম দশক থেকেই ফ্রান্স বাদে বাকি ইউরোপীয় দেশগুলোর বাজারের সিংহভাগ ছিল মার্কিন চলচ্চিত্রের দখলে। এমনকি ফ্রান্সেও মার্কিন দাপটে স্থানীয় নির্মাতারা কোনঠাসা হতে শুরু করেছিলেন। তাই যদি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নাও ঘটত, মার্কিন চলচ্চিত্র পুরো পৃথিবীতেই প্রভাব বিস্তার করে ফেলত। কিন্তু যুদ্ধের ফলে ইউরোপের দশা হয় করুণ, আর টেকনিকালার ইত্যাদি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের জন্য মার্কিন ছবিগুলি উত্তরোত্তর আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠে গোটা বিশ্বের বাজার দখল করে ফেলে।
চলচ্চিত্রের প্রয়োগকৌশল
এইসময়ে চলচ্চিত্রের যে প্রয়োগকৌশলগুলোর উদ্ভব হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কৃত্রিম আলোয় চিত্রগ্রহণের ব্যবস্থা, কৃত্রিম আলোয় আগুন জ্বলার বিভ্রম সৃষ্টি করা বা বিশেষ বিপদসূচক দৃশ্যে আলো কমিয়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরী (লো-কী লাইটিং) ইত্যাদি।
একাধিক শটের মধ্যে কন্টিন্যুইটি বা অবিচ্ছেদ্যতার প্রয়োগকৌশলেরও অনেক পরিমার্জনা হয়, যেমন প্যাথে কোম্পানির লে শেভাল এমবেলে (পলাতক ঘোড়া, ১৯০৭) ছবিতে একই সময়ে সমান্তরালে ঘটতে থাকা দুটি ঘটনা ক্রস-কাটিং সম্পাদনা পদ্ধতির মাধ্যমে দেখান হয়। জুলাই ১৯০৮ এ তৈরি দি ফ্যাটাল আওয়ার ছবিতে ডি ডব্লিউ গ্রিফিথও ক্রস-কাটিং ব্যবহার করেন। আরেকটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল পয়েন্ট অফ ভিউ শট, ১৯১০ সালে ভিটাগ্রাফ স্টুডিওর ব্যাক টু নেচার ছবিতে প্রথম ব্যবহার হয়। ইনসার্ট শটের শিল্পসম্মত ব্যবহার দেখা যায় ইতালীয় প্রযোজনা লা মেলা প্লানটা (অশুভ উদ্ভিদ) ছবিতে, পরিচালক ছিলেন মারিও ক্যাস্রিনি।
ফিল্মের দৈর্ঘ্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ লেখক নিযুক্ত হওয়া শুরু হল যারা জটিল নাটক-নভেলকে সরল করে ছোট আকারে নিয়ে আসতেন, যাতে একটিমাত্র রিলের মধ্যে তার চিত্ররূপ আঁটানো যায়। চলচ্চিত্রেও জঁর বা বিশেষ পদ্ধতি অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস চালু হল, মূল বিভাগ ছিল কমেডি আর ড্রামা, তবে এই বিভাগও ক্রমে আরও উপবিভাগে বিভক্ত হয়।
‘ইন্টারটাইটেল’ বা ছাপান লেখা সংবলিত কার্ডের মাধ্যমে কথোপকথন বর্ণনা ১৯০৮ সাল থেকেই শুরু হয়, ১৯১২ নাগাদ এই রীতি মোটামুটি সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে। এর ব্যবহারের ফলে ফিল্মের গল্প বলার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসে। কোনো চরিত্র কথা বলতে শুরু করলেই কাট করে ইন্টারটাইটেল দেখান হত, আবার কাট করে চরিত্রটিতে ফিরে যাওয়া হত ঠিক যখন তার বক্তব্য শেষ হচ্ছে। এইভাবে সবাক ছবির সমতুল্য একটা ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চলচ্চিত্র
চলচ্চিত্র শিল্প
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চলচ্চিত্র শিল্প একটা জটিল রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যায়। এক রিলের বিনোদনচিত্র বদলে যায় অনেক বেশি দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্রে, প্রেক্ষাগৃহ হয়ে যায় বৃহদাকার আর টিকিটের দামও যায় বেড়ে। এইসব পরিবর্তনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ফিল্ম কোম্পানির অস্তিত্ত্বের সঙ্কট দেখা দেয়, যদিও ভিটাগ্রাফ কোম্পানি ছিল ব্যতিক্রমী। চলচ্চিত্রের কেন্দ্র লস এঞ্জেলেসে স্থানান্তরিত হলে ১৯১২ সালে তৈরি ইউনিভার্সাল ফিল্ম ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি সেখানে ছবি তৈরিতে মনোনিবেশ করে এবং অচিরেই বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ফিল্ম কোম্পানি ইউনিভার্সাল স্টুডিওস এ পরিণত হয়। ১৯১৩ তে তৈরি হয় জেসি ল্যাসকি ফিচার প্লে কোম্পানি আর ফেমাস প্লেয়ার্স কোম্পানি, পরবর্তীকালে মিশে গিয়ে নাম নেয় ফেমাস প্লেয়ার্স-ল্যাসকি। এইসময়ের বিশেষভাবে সফল ছবিগুলোর মধ্যে প্রথমে থাকবে ডেভিড ওয়ার্ক গ্রিফিথের তৈরী দ্য বার্থ অফ এ নেশন (১৯১৫) আর ইনটলারেন্স (১৯১৬)। উন্নত মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী ছবিগুলোর চাহিদা ছিল বিশ্বব্যাপী।
ফ্রান্সে সৈন্য সমাবেশের কারণে চলচ্চিত্র নির্মাণ কিছুদিনের জন্য একেবারে বন্ধ থাকে। ১৯১৫ তে আবার নির্মাণকার্য শুরু হলেও সেটা হয় অনেক সংক্ষিপ্ত আকারে আর বড় কোম্পানিগুলোও ধীরে ধীরে বাজার থেকে সরে যায়। ইতালির অবস্থা একটু ভালো হলেও বেশ কিছু ছবি বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হয়। ডেনমার্কে নরডিস্ক কোম্পানি আবার এত বেশি ছবি বানিয়ে ফেলে যে ১৯১৫ আর ১৯১৬ তে সমস্ত ছবি বিক্রিও হয়না, সেই থেকে ডেনমার্কে ছবি নির্মাণের জগতে ভাঁটা আসে আর বিশ্ব চলচ্চিত্রে ডেনমার্কের গুরুত্ত্ব হ্রাস পেতে থাকে।
যুদ্ধের জন্য জার্মানির চলচ্চিত্র শিল্পের বিশাল ক্ষতি হয়। এই সময়ের নতুন প্রযোজকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জো মে, যিনি রোমাঞ্চকর আর দুঃসাহসিক ধরনের ছবি বানিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন, অন্যদিকে আর্নস্ট লুবিচ সফল কমেডি আর ড্রামার জন্য পরিচিত হয়েছিলেন।
রাশিয়ার স্থানীয় বাজার বড় হওয়ার সুবাদে যুদ্ধের শুরুর দিকে চলচ্চিত্র শিল্পের গায়ে তেমন আঁচ লাগেনি, বরং বিচ্ছিন্নভাবে থাকার জন্য রাশিয়ার নির্মাতারা নিজস্ব স্টাইলের জন্ম দিতে পেরেছিলেন। বরং ১৯১৯ সালের বলশেভিক বিপ্লবের পরে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত অনেক প্রতিভাধর ব্যক্তি রাশিয়া ত্যাগ করেন, আর রাশিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্প বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
নতুন প্রয়োগকৌশল
এতদিন পর্যন্ত চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহকরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনজনিত সমস্যা কিভাবে সমাধান করবেন, সেই নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। এই সময় থেকে কৃত্রিম আলো, যেমন ফ্লাডলাইট বা স্পটলাইটের ব্যবহার শুরু হলে তাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। এইসময়ের ছবিতে দৃশ্যের শুরুতে ও শেষে আইরিস ইন ও আউট শটের বহুল প্রয়োগ চোখে পড়ে। শুরুর সময় দৃশ্যটি একটি কালো বৃত্তের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসত, আবার কালো বৃত্তটি বন্ধ হয়ে শটের শেষের সূচনা দিত। বৃত্তাকার ছাড়াও কখনো কখনো উল্লম্ব বা তির্যকভাবেও দৃশ্যের পরিবর্তন করা হত।
স্থিরচিত্রের বহুল ব্যবহৃত সফট ফোকাস কৌশলের ব্যবহার চলচ্চিত্রেও শুরু হয়। ১৯১৫ সালে মেরি পিকফোর্ড অভিনীত ফেঞ্চো দ্য ক্রিকেট ছবিতে কিছু দৃশ্যকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফোকাসের বাইরে রেখে আবেগপূর্ণ প্রভাব আনার চেষ্টা করা হয়।
এই সময় থেকেই চরিত্রের মানসিক অনুভূতি প্রকাশের জন্য ক্যামেরাকে ব্যবহার করা শুরু হয়। এই কাজে বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় পয়েন্ট অফ ভিউ শট (পিওভি) যা চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে দর্শকের সামনে তুলে ধরতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৯১৫ সালে সিডনি ড্রিউ এর তৈরি দ্য স্টোরি অফ এ গ্লাভ, যে ছবিতে একটি মদ্যপ চরিত্রের দৃষ্টিকোণ বোঝাতে হাতে ধরা ক্যামেরায় তোলা একটি দরজা ও তার মধ্যে চাবির ছিদ্রের কাঁপাকাঁপা পিওভি শট নেওয়া হয়েছিল। ঐ বছরেই ফরাসী নির্মাতা আবেল গ্যান্স পরিচালিত লা ফলি দু দকতেউর তুবে (ডক্টর টিউবের পাগলামি) ছবিতে বক্র দর্পণ ব্যবহার করে পারিপার্শ্বিককে বিকৃত করে শট নেওয়া হয়েছিল, মাদক প্রভাবিত মানুষের দৃষ্টিকোণ বোঝাতে।
সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রচলিত প্রতীকী ভাবনাগুলি চলচ্চিত্রেও ধীরে ধীরে জায়গা করে নিতে থাকে। গ্রিফিথের দা আভেঞ্জিং কনসায়েন্স (১৯১৪) ছবিতে ইন্টারটাইটেলে ‘দা বার্থ অফ ইভিল থটস’(অশুভ চিন্তার জন্ম) লেখাটি আসার পরেই পরপর কয়েকটি দৃশ্যে ছবির প্রধান চরিত্রকে প্রথমে একটি মাকড়সা, এবং পরে একটি পিঁপড়েকে পোকা খেতে পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়। ইতালি এবং রাশিয়াতে এর আগেও এরকম প্রতীকী দৃশ্য সংবলিত মুষ্টিমেয় কিছু ছবি তৈরি হয়েছিল। এইধরনের শিল্পকলার প্রধান বিষয় ছিল নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আসক্তি, তদজনিত চিত্তবিভ্রম এবং প্রলম্বিত মৃত্যু।
সিসিল ডিমিলে পরিচালিত ওল্ড ওয়াইভস ফর নিউ (১৯১৮) ছবিতে ইনসার্ট শট
ব্রাইটন স্কুলের জমানাতেই ছবির মধ্যে ইনসার্ট শট ব্যবহার শুরু হয়েছিল, কিন্তু গ্রিফিথের দা আভেঞ্জিং কনসায়েন্স ছবিতে সেটা আলাদা মাত্রা পায়। ইনসার্ট শট হল মুখমন্ডল ব্যতিরেকে অন্যান্য বস্তুর ক্লোজ-আপ শট। পূর্ববর্ণিত প্রতীকী শটগুলো ছাড়াও ছবিতে চরিত্রের মানসিক উদ্বেগের পরিচায়ক হিসেবে মুষ্টিবদ্ধ হাত ও পা নাচানোর ক্লোজ-আপ দেখান হয়েছিল।
১৯১০ এর শেষের দিকে ইউরোপে পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলের ইনসার্ট শট ব্যবহার শুরু হয়। এই ধরনের শট হল দৃশ্যে মনুষ্যচরিত্রের উপস্থিতি ছাড়াই বস্তুর ক্লোজ-আপ শট, চরিত্র উপস্থিত নেই মানে তার দৃষ্টিকোণেরও কোনো অস্তিত্ত্ব নেই! যেমন ১৯১৭ সালে মরিস টার্নার পরিচালিত দি প্রাইড অফ ক্ল্যান ছবিতে মৎস্যজীবীদের কঠোর জীবন বোঝাতে প্রস্তরাকীর্ণ সমুদ্রসৈকতে বারবার ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখান হয়েছিল। মরিস এলভি পরিচালিত নেলসন; দি স্টোরি অফ ইংল্যান্ড’স ইমমর্টাল নেভাল হিরো (১৯১৯) ছবিতেও জার্মান সম্রাট কাইসার দ্বিতীয় উইলহেল্ম এর ছবি ডিজল্ভ হয়ে প্রথমে একটি ময়ূর এবং তারপরে একটি যুদ্ধজাহাজ দেখা যায়।
১৯১৪ সালের মধ্যেই কন্টিন্যুইটি বা অবিচ্ছেদ্যতা রীতি অনুসরণ করে তৈরী ছবিই চলচ্চিত্রের মূল ধারা হিসেবে স্বীকৃত হয়ে যায়। শট থেকে শটে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া আরো মসৃণ ও উন্নত হয়। একই দৃশ্যকে ভাগে ভাগে বিভিন্ন কোণ থেকে নেওয়ার রীতিও মার্কিন ছবিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ক্যামেরার দিক নব্বই ডিগ্রির চেয়ে বেশি ঘুরে গেলে তাকে বলা হত রিভার্স অ্যাঙ্গেল কাট। মার্কিন নির্মাতা র্যালফ ইন্স তার দা রাইট গার্ল, হিস ফ্যান্টম সুইটহার্ট প্রভৃতি ছবিতে এই রিভার্স অ্যাঙ্গেল কাট রীতি আরও মজবুত করেন।
গল্প বর্ণনায় ফ্ল্যাশব্যাক অর্থাৎ অতীত ঘটনার বর্ণনকৌশলেরও অগ্রগতি ঘটে এই সময়ে। যেমন উইলিয়াম জে হামফ্রে নির্দেশিত ভিটাগ্রাফ কোম্পানির দা ম্যান দ্যাট মাইট হ্যাভ বিন (১৯১৪) ছবিতে প্রধান চরিত্রের জটিল জীবনকাহিনী বর্ণনায় ফ্ল্যাশব্যাকের ব্যবহার করা হয়েছিল।
ক্রস-কাটিং প্রয়োগকৌশলের সাহায্যে একই সময়ে চলতে থাকা আলাদা আলাদা ঘটনা দেখান সম্ভব ছিল। ১৯১৪ র পরে অবশ্য ইউরোপের তুলনায় আমেরিকান ছবিতেই এই কৌশল বেশি দেখা যেত। চূড়ান্ত বৈপরীত্য দেখানোর জন্যও এই কৌশল ব্যবহার করা হত। যেমন সিসিল ডিমিলে পরিচালিত দি হুইসপারিং কোরাস (১৯১৮) ছবির একটি দৃশ্যে এক ব্যক্তিকে আফিমের আড্ডায় এক চীনা গণিকার সঙ্গে দেখান হয়, সঙ্গে ক্রস-কাটিং এর মাধ্যমে দেখান হয় ওই ব্যক্তির স্ত্রী, যিনি মনে করেন যে তার স্বামী মৃত, চার্চে পুনর্বিবাহ করছেন।
চলচ্চিত্র কলা
এইসব চমকপ্রদ প্রয়োগকৌশল আর তার সঙ্গে চলতি বাণিজ্যিক মঞ্চের নাটকীয়তা, এই দুইয়ের যথোপযুক্ত মিশ্রণের মাধ্যমে মার্কিন চলচ্চিত্রই সেই সময় জুড়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রের পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ ছিলেন সেইসময়ের আমেরিকান চলচ্চিত্রের স্তম্ভস্বরূপ। দর্শকদের মধ্যে নাটকীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। তবে সিসিল ডিমিলে তৎকালীন আমেরিকান সমাজের সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তিনি তার দা চিট (১৯১৫) ছবিতে চরিত্রের দোলাচলচিত্ত আরো সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ করতে পারলেন। মরিস টার্নার নন্দিত ছিলেন তার পরিশোধিত সৌন্দর্য্য প্রকাশের ক্ষমতা ও সূক্ষ্ম কল্পনাপ্রবণতার জন্য, অভিনেতাদের থেকে তিনি যথাযথ মুহূর্তে স্বাভাবিকতা আদায় করে নিতে পারতেন। তার এইসব ক্ষমতার প্রকাশ দেখা যায় এ গার্লস ফলি (১৯১৭) ছবিতে।
কৌতুকাভিনয়ে শালীনতা নিয়ে আসেন সিডনি ড্রিউ, অন্যদিকে স্ল্যাপস্টিক কমেডিকে পরিমার্জনা করে অনেক উন্নত করেন ফ্যাটি অর্বাকল আর চার্লস চ্যাপলিন। শেষোক্ত দুজনেই মার্ক সেনেটের কিস্টোন কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন কিন্তু সেনেটের ছবির গতানুগতিক ক্ষিপ্র গতিময়তাকে অনেক কমিয়ে এনে দর্শকদের অভিনয়ের সূক্ষ্মতা ও চাতুর্য্য উপলব্ধির সুযোগ করে দেন। ১৯১৭ র মধ্যে চ্যাপলিন তার ছবিতে আরো নাটকীয় প্লট নিয়ে আসেন, এবং কৌতুকাভিনয় ও ভাবপ্রবণতার সুচতুর মিশ্রণ ঘটান।
রাশিয়ায় নির্দেশক এভগেনি বেয়ার তার ছবিতে ধীর প্রাবল্যের অভিনয় আর প্রতীকী উগ্রতার অনন্য সংমিশ্রণ করেন।
সুইডেনে ভিক্টর সস্ত্রম এক শ্রেণীর ছবিতে মনুষ্যজীবনের বাস্তবতা ও তার পারিপার্শ্বিককে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনা করতে থাকেন। অন্যদিকে মরিৎজ স্টিলার বাস্তবধর্মী কৌতুকাভিনয়কে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান।
জার্মানিতে আর্নস্ট লুবিচ অগ্রজ নাট্যনির্দেশক ম্যাক্স রেইনহার্ড এর বুর্জোয়া কমেডির থেকে অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করেন এবং নিজের ডাই পাপে (পুতুল, ১৯১৯), ডাই অস্তর্নপ্রিঞ্জেসিন (ঝিনুক রাজকন্যা, ১৯১৯), মাদাম দুবারি (১৯১৯), ইত্যাদি ছবিতে সেই ধ্যানধারণা প্রয়োগ করেন।
হলিউডের জয়ডঙ্কা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকেও ফরাসী ও ইতালীয় ছবিগুলির বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা বজায় ছিল, কিন্তু ঐ যুদ্ধই ইউরোপের চলচ্চিত্র শিল্পকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। আমেরিকার চলচ্চিত্র শিল্প ততদিনে ক্যালিফোর্নিয়ায় পাকাপাকিভাবে স্থানান্তরিত আর হলিউড নামে সর্বজনবিদিত। ঐ সময় থেকেই হলিউড বিশ্ব চলচ্চিত্রে একমেবদ্বিতীয়ম হয়ে দাঁড়ায়, চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং বিশ্বজুড়ে রফতানির প্রধান কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নেয়।
১৯২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে গড়ে প্রায় ৮০০ টি ছবি তৈরি হওয়া শুরু হয়,যা ছিল সমগ্র বিশ্বের নিরিখে ৮২ শতাংশ। চার্লি চ্যাপলিন ও বাস্টার কিটন এর কৌতুকাভিনয়, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস এর রোমাঞ্চকর অভিযান, ক্লারা বাও এর রোমান্স, সবকটি মহাদেশে পরিচিতি পেয়ে যায়। চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশ্চাত্ত্য দৃষ্টিভঙ্গি, কন্টিন্যুইটি সম্পাদনা, ইত্যাদি সমস্ত কিছুই মানদণ্ড হিসেবে পরিগণিত হয় এবং সমগ্র বিশ্বই একাদিক্রমে তা অনুসরণ করে। তবে দূরপ্রাচ্যের, যেমন জাপানের পরম্পরায় কঠোর বাস্তববাদ কখনই প্রবল ছিলনা, তাই এখানে পাশ্চাত্ত্যের অনুকরণ হয়েছে অনেক ধীরে।
হলিউডের এই অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেই গড়ে ওঠে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসূচক স্টুডিও সিস্টেম, আর তার সর্বোত্তম প্রচার পদ্ধতি – স্টার সিস্টেম, যা অন্য দেশগুলোর কাছে আদর্শস্বরূপ হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে স্টুডিওর আপাদমস্তক নিয়ন্ত্রণ থাকত যার ফলে প্রয়োগিক সূক্ষ্মতা ও উচ্চমান অর্জন করা সম্ভব হত। সিস্টেম চলত সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক নিয়মে, শুধুমাত্র চটকদারিকেই গুরুত্ত্ব দেওয়া হত আর সাহসিকতা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে একটা মাত্রার পর নিরুৎসাহ করা হত। এই ব্যাপারে একটা খুব বড় উদাহরণ হলেন অস্ট্রীয়-আমেরিকান অভিনেতা এরিশ ফন স্ট্রোহাইম, ১৯২০ র আশেপাশে স্টুডিওর সঙ্গে মনান্তরের কারণে নির্দেশক হিসেবে যার কেরিয়ার শেষ হয়ে যায় যদিও তিনি বর্তমানে যুগেও সমাদৃত।
সবাক যুগ
১৯২৭ সালের শেষের দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত দা জ্যাজ সিঙ্গার ছবিটি মূলত নির্বাক হলেও কিছু দৃশ্যে সিঙ্ক্রোনাইজড বা সমলয় সংলাপ এবং সমলয় সংগীতের ব্যবহার ছিল। এই পদ্ধতির ব্যবহার অবশ্য ১৯১৪ সালেও দেখা গিয়েছিল চার্লস তেজ রাসেল এর দি ফটো-ড্রামা অফ ক্রিয়েশন ছবিতে, সেখানে ফনোগ্রাফ যন্ত্রে গৃহীত সংলাপ ও সংগীতকে স্লাইড ও চলন্ত ছবির সঙ্গে সমলয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। ভিটাফোন যন্ত্রের সাউন্ড অন ডিস্ক পদ্ধতির বদলে এই সময় থেকে সাউন্ড অন ফিল্ম পদ্ধতিতে শব্দগ্রহণ হতে থাকে, প্রধানত ফক্সের মুভিটোন, ডিফরেস্টের ফনোফিল্ম ও আরসিএ ফটোফোন জাতীয় যন্ত্রে। শিল্পপতিরা উপলব্ধি করেন যে এই কথা বলা ছবি বা ‘টকিস’ এর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
প্রযুক্তিতে পরিবর্তন আসতে থাকে দ্রুতগতিতে। ১৯২৯ সালের শেষে গিয়ে দেখা যায় হলিউডের প্রায় সমস্ত ছবিই সবাক। তখন অবশ্য শব্দগ্রহণ যন্ত্রের প্রমিতকরণ ঘটেনি, কিন্তু অতিদ্রুত সেটাও হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় মূলত অর্থনৈতিক কারণে এই পরিবর্তন এসেছে অনেক ধীরে। অবশ্য চীন ও জাপানের সংস্কৃতি নির্বাক ছবিকে সবাকের পাশাপাশি তিরিশের দশকেও ধরে রেখেছিল, এমনকি বেশ কিছু অসামান্য ছবির জন্মও হয়েছিল এই সময়ে, যেমন উ অংগ্যাং পরিচালিত দি গডেস (চীন, ১৯৩৪), বা ইয়াসুজিরো ওজু পরিচালিত আই ওয়াজ বর্ন, বাট… (জাপান, ১৯৩২)। কিন্তু এমনকি জাপানেও, নির্বাক ছবির সঙ্গে যারা ধারাবিবরণী দিতেন, সেই বেনশি শিল্পীদের কেরিয়ার শেষ হয়ে যেতে থাকে।
সবাক ছবি ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশেও প্রভাব বিস্তার করে, বড় প্রযোজকদের সঙ্গে পাল্লা না দিতে পেরে ছোট কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়, ফলে বড় প্রযোজকরা আরও বেশি করে দর্শক আনুকূল্য পান। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, শব্দের ব্যবহার শুরু হওয়াই হলিউডের চলচ্চিত্রশিল্পকে সেই সময়ের মারণ অর্থনৈতিক গ্রেট ডিপ্রেশনের হাত থেকে রক্ষা করে। এই সময় থেকে ১৯৪০ এর দশকের শেষ পর্যন্ত সময়কে ‘হলিউডের স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। অতি দক্ষতার সঙ্গে চটক ও চাকচিক্য পরিবেশন করে হলিউড সারা বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এই যুগের সর্বোত্তম অভিনেতা অভিনেত্রীরা, যেমন ক্লার্ক গেবল, ক্যাথরিন হেপবার্ন, হামফ্রে বোগার্ট, গ্রেটা গার্বো রা বর্তমানে ক্লাসিক হিসেবে সমাদৃত। তবে ১৯৩০ দশকে হলিউডে সর্বোচ্চ ব্যবসা দেন শিশুশিল্পী শার্লে টেম্পল।
সৃজনশীলতায় শব্দের প্রভাব
শব্দের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র যেন আবার সেই উৎপত্তির যুগে ফিরে গিয়েছিল। অভিনেতা ও নির্দেশক, কেউই যেন নিজে উঠতে পারছিলেন না যে এই নতুন প্রযুক্তিকে কিভাবে কাজে লাগাবেন! ফলস্বরূপ, বিশের দশক জুড়ে স্থবির ও নাটুকে চলচ্চিত্রেরই প্রাধান্য দেখা যায়। রঙ্গমঞ্চের অভিনেতা, নির্দেশক ও লেখকেরা চলচ্চিত্রে আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং তাদের মতো করে সংলাপসমৃদ্ধ কাহিনীনির্ভর ছবি তৈরী করতে শুরু করেন। নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতারা গুরুত্ত্ব হারিয়ে ফেলতে থাকেন।
যদিও এই সমস্যা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, ১৯২৯ সালেই যেন সমস্যার মেঘ কেটে যেতে শুরু করে। নতুন যুগের চলচ্চিত্র নির্মাতারা শব্দ নিয়ে সৃজনশীল পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে দেন। ঐ বছরের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে ছিল উইলিয়াম ওয়েলম্যান এর তৈরী চায়নাটাউন নাইটস আর দ্য ম্যান আই লাভ, রুবেন মাম্যুলা র তৈরী অ্যাপলস এবং আলফ্রেড হিচকক এর পরিচালনায় ব্ল্যাকমেইল।শেষোক্ত ছবিটি ছিল যুক্তরাজ্যের প্রথম সবাক ছবি। এইসমস্ত পরিচালকরা মাইক্রোফোনের ব্যবহার ও আলোকচিত্রগ্রহণের পরে শব্দ পুনর্যোজনার প্রযুক্তিকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যান।
নির্বাকের তুলনায় সবাক যুগে ছবিতে কৃষ্ণাঙ্গ ইতিহাসের গুরুত্ত্ব বাড়ে, বিষয়বৈচিত্রও বৃদ্ধি পায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই মিউজিক্যাল বা সঙ্গীতধর্মী চলচ্চিত্র তৈরী শুরু হয়। প্রথম হলিউড মিউজিক্যাল কাহিনীচিত্র ছিল দি ব্রডওয়ে মেলোডি (১৯২৯), তবে এইবিষয়ে প্রথম মুখ্য নির্মাতা ছিলেন বাসবি বার্কলে, তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ছিল ফর্টিসেকেন্ড স্ট্রিট (১৯৩৩), ডেমস (১৯৩৪), ইত্যাদি। ফরাসী আভাঁ-গার্দ পরিচালক রেনে ক্লেয়ার সংগীত এবং নৃত্যে পরাবাস্তববাদী অনুষঙ্গ ব্যবহার করে তৈরী করেন সোউ লে তোয়েটস দে পারি (১৯৩০) এবং লে মিলিয়ন (১৯৩১)। ইউনিভার্সাল পিকচার্স চালু করেন গথিক হরর ছবি, যেমন ড্রাকুলা আর ফ্রাঙ্কেস্টাইন, দুইই ১৯৩১ সালে। ১৯৩৩ সালে আরকেও পিকচার্স বানায় অতিকায় দানব নিয়ে কিংবদন্তি ছবি কিং কং, পরিচালনায় মেরিন সি কুপার। মিউজিক্যাল ছবি তৈরীর প্রবণতা প্রবণতা সবচেয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ভারতবর্ষে, সংস্কৃতিতে সংগীত ও নৃত্যের আধিক্য সেখানকার সবাক চলচ্চিত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। যদিও ভারতের চলচ্চিত্র বহুদিন পর্যন্ত পাশ্চাত্ত্য দুনিয়ার কাছে বস্তুত অলক্ষিতই থেকে গিয়েছিল, বর্তমানে ভারতবর্ষ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র তৈরী ও বিক্রিতে বিশ্বের অন্যতম সেরা।
এইসময় যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাংস্টার মুভি অর্থাৎ দুর্বৃত্তদলের কার্যকলাপ নিয়ে ছবি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, যেমন মার্ভিন লেরয় পরিচালিত লিটল সিজার (১৯৩১), উইলিয়াম ওয়েলম্যান পরিচালিত দি পাবলিক এনিমি (১৯৩১), ইত্যাদি। হলিউড কমেডিও স্ল্যাপস্টিক এর গণ্ডি ছাড়িয়ে নজর দেয় বুদ্ধিদীপ্ত প্রহসনের দিকে দি ফ্রন্ট পেজ (১৯৩১) এবং ইট হ্যাপেনড ওয়ান নাইট (১৯৩৪) ছবিতে, বা মার্ক্স ব্রাদার্স এর নৈরাজ্যবাদী আজগুবি পরিমণ্ডল, যেমন দেখা গিয়েছিল ডাক স্যুপ (১৯৩৩) ছবিতে। ওয়াল্ট ডিজনি নতুন দিগন্ত খুলে দেন অ্যানিমেশন ছবি স্নো হোয়াইট এন্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফ (১৯৩৭) ছবিতে। তেমনই ১৯৩৯ সাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে দি উইজার্ড অফ অজ আর গন উইথ দ্য উইন্ড ছবির জন্য।
রঙিন চলচ্চিত্র
সাবেক ধারণা অনুযায়ী ১৯০৯ সালে লন্ডনের প্যালেস থিয়েটারে প্রথম রঙিন ছবি প্রদর্শিত হয়। জর্জ স্মিথের তৈরী এই কিনেমাকালার প্রযুক্তিতে রঙ ব্যবহার হত দুটি, সবুজ এবং লাল। কিন্তু পরে জানা গিয়েছে ১৯০১ সালে প্রথম রঙিন ছবি তৈরী হয়। এই অনাম্নী ছবিটির পরিচালক ছিলেন পেশায় চিত্রগ্রাহক এডওয়ার্ড রেমন্ড টার্নার এবং তার পৃষ্ঠপোষক ক্রীড়াবিদ ফ্রেডরিক মার্শাল লী। তারা সাদাকালো ফিল্মে ছবি তুলে বিশেষ অভিক্ষেপন যন্ত্রে সবুজ, লাল ও নীল রঙের ফিল্টার লাগিয়ে প্রদর্শন করেছিলেন। তবে কিছু অসংশ্লিষ্ট কারণে এই চিন্তাভাবনা তখন আর বেশিদূর এগোয়নি।
পরবর্তীকালে, ১৯১৬ সালে, টেকনিকালার প্রযুক্তি বাজারে আসে। এই প্রযুক্তিতেও ব্যবহার হত তিনটি রঙ, সবুজ, লাল ও নীল, তিনবার ফটোগ্রাফিক মুদ্রণ করতে হত, তাছাড়া প্রয়োজন হত বিশালাকৃতি ক্যামেরার। সম্পূর্ণ এই প্রযুক্তিতে তৈরী প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ছিল ওয়াল্ট ডিজনির ফ্লাওয়ার্স এন্ড ট্রিস (১৯৩২), পরিচালক ছিলেন বার্ট গিলেট, প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি হয় রুবেন মাম্যুলার তৈরী দ্য ভ্যানিটি ফেয়ার (১৯৩৫)। টেকনিকালার প্রযুক্তি বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হতে থাকে সঙ্গীতধর্মী ছবিতে, যেমন দি উইজার্ড অফ অজ (১৯৩৯) বা রোমাঞ্চকর ছবি, যেমন দি অ্যাডভেঞ্চার অফ রবিন হুড (১৯৩৮), আর অ্যানিমেশন ছবি, যেমন স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফ (১৯৩৭), ইত্যাদিতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার ফলাফল
যুদ্ধের সময় অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারমূলক ছবির চাহিদার ওপর ভর করে যুক্তরাজ্যের চলচ্চিত্র শিল্পে নবজাগরণ ঘটে। প্রচুর বাস্তবধর্মী যুদ্ধনাট্য তৈরী হয়, যেমন ফর্টিনাইনথ প্যারালাল (১৯৪১), ওয়েন্ট দা ডে ওয়েল? (১৯৪২), দা ওয়ে অ্যাহেড (১৯৪৪), ইত্যাদি। নোয়েল কাওয়ার্ড আর ডেভিড লিন তৈরী করেন নৌবাহিনী নির্ভর ছবি ইন হুইচ উই সার্ভ (১৯৪২), এই ছবিটি একটি বিশেষ একাডেমি পুরস্কার লাভ করে। এই বাস্তববাদী ছবিগুলোর পাশাপাশি তৈরী হতে শুরু করে বেশ কিছু ছবি যেখানে ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে দেখান হয়, যেমন মাইকেল পাওয়েল আর এমেরিক প্রেসবার্গার জুটির দি লাইফ অ্যান্ড ডেথ অফ কর্নেল ব্লিম্প (১৯৪৩), এ ক্যান্টারবেরি টেল (১৯৪৪), এ ম্যাটার অফ লাইফ অ্যান্ড ডেথ (১৯৪৬)। উইলিয়াম শেকসপিয়র এর নাটকের ভিত্তিতে লরন্স অলিভিয়ে তৈরী করেন পঞ্চম হেনরি (১৯৪৪)। স্নো হোয়াইট এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ডিজনি তৈরী করেন পিনোচ্চিও (১৯৪০), ফ্যান্টাসিয়া (১৯৪০) আর বামবি (১৯৪২)।
যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের পরে সেখানেও দেশভক্তিপূর্ণ প্রচারমূলক ছবি তৈরির জোয়ার আসে, তৈরী হয় ডেসপারেট জার্নি (১৯৪২), মিসেস মিনিভার (১৯৪২), ফরএভার অ্যান্ড এ ডে (১৯৪৩), অবজেকটিভ, বার্মা! (১৯৪৫) এর মত ছবি। এছাড়া উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হল দ্যশীল হ্যামেট এর চিত্রনাট্যে ওয়াচ অন দা রাইন (১৯৪৩), থর্নটন ওয়াইল্ডার এর চিত্রনাট্যে হিচককের নির্দেশনায় শ্যাডো অফ এ ডাউট (১৯৪৩), জেমস ক্যাগনি অভিনীত জর্জ এম কোহেন এর জীবনী অবলম্বনে ছবি ইয়াঙ্কি ডুডলি ড্যান্ডি (১৯৪২)। হামফ্রে বোগার্ট অভিনেতা হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় হন, ১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ এর মধ্যে ৩৬টি ছবিতে অভিনয় করেন। তার মধ্যে ছিল মাইকেল কার্টিজ এর ক্যাসাব্লাঙ্কা (১৯৪২) আর জন হেস্টন এর দি ম্যালটিস ফ্যালকন (১৯৪১)। শেষোক্ত ছবিটি প্রথম যুগের নোয়া চলচ্চিত্র (অপরাধ জগৎ নিয়ে নির্মিত থ্রিলারধর্মী ছবি) হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৪১ সালে আরকেও পিকচারের প্রযোজনায় অরসন ওয়েলস পরিচালনা করেন সিটিজেন কেইন, এই ছবিকে এযাবৎকালের শ্রেষ্ঠ ছবিগুলির মধ্যে একটি বলে গণ্য করা হয়। সিটিজেন কেইন দিয়েই যেন আধুনিক চলচ্চিত্রের সূত্রপাত হয়।
যুদ্ধের সময়ের বদ্ধ জীবনযাত্রা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে অনেক চমকপ্রদ কল্পনাপ্রসূত বিষয়ের আনয়ন করে। লন্ডনের গ্রেনসবরো ষ্টুডিও র প্রযোজনায় জনপ্রিয় ছবিগুলি ছিল মেলোড্রামা (দি ম্যান ইন গ্রে, দি উইকেড লেডি, ইত্যাদি), ও কমেডি-ফ্যান্টাসিতে (হিয়ার কামস মিস্টার জর্ডন, হেভেন ক্যান ওয়েট, আই ম্যারেড এ উইচ, ব্লিথ স্পিরিট, ইত্যাদি) পরিপূর্ণ। ভ্যাল লিউটন আরকেও পিকচার্সের জন্য বেশ কিছু স্বল্প বাজেটের হরর ছবি বানান, তার মধ্যে ছিল ক্যাট পিপল, আইল অফ দ্য ডেড, আর দ্য বডি স্ন্যাচার। এই সময়ে বেশ কয়েকটি ছবি তৈরী হয় যেখানে গুরুত্ত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন মহিলারা, তার মধ্যে নাও, ভয়েজার, র্যান্ডম হারভেস্ট, মিলড্রেড পিয়ার্স ছবিগুলি ভালো জনপ্রিয়তা পায়।
১৯৪৬ সালে ফ্রাঙ্ক কাপরা তৈরী করেন ইটস এ ওয়ান্ডারফুল লাইফ। যুদ্ধফেরত সৈনিকদের জীবনের অনুপ্রেরণায় তৈরী হয় দা বেস্ট ইয়ার্স অফ আওয়ার লাইভস জাতীয় ছবি, বস্তুত চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্যামুয়েল ফুলার তার নিজের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়েই বানান দা বিগ রেড ওয়ান ছবিটি। অভিনেতা ও চিত্রনাট্য লেখকদের সংগঠন দি অ্যাক্টরস ষ্টুডিও তৈরী হয় ১৯৪৭ সালে, মূলত এলিয়া কাজান, রবার্ট লুইস আর শিরিল ক্রফোর্ড এর চেষ্টায়। ওই বছরেই অস্কার ফিসিঞ্জার তৈরী করেন বাখের সঙ্গীতসমৃদ্ধ অ্যানিমেশন ছবি মোশন পেন্টিং নাম্বার ওয়ান।
১৯৪৩ সালে ইতালিতে লুচিনো ভিসকন্তি পরিচালিত ওসেসিওনে ছবির প্রদর্শন দিয়ে ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম বা ইতালীয় নয়াবাস্তববাদ ঘরনার সূচনা হয়। এই ঘরানার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি হল বাইসাইকেল থিভস, রোম, ওপেন সিটি, দা আর্থ ট্রেম্বলস, ইত্যাদি। ১৯৫২ তে ভিত্তোরিও দে সিকা পরিচালিত উমবের্তো ডি ছবিটি নৈরাশ্যবাদীতার জন্য বহুলনিন্দিত হয়। অনেক ফিল্ম ঐতহাসিক এই ছবিটিতেই নয়াবাস্তববাদ ঘরানার অবসান বলে চিহ্নিত করেন।
চল্লিশের দশকের শেষের দিকে ব্রিটেনের অনেক জনপ্রিয় কমেডি ছবির নির্মাতা ছিল ইলিং ষ্টুডিও, উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হল হুইস্কি গ্যালোর, পাসপোর্ট টু পিমলিকো, কাইন্ড হার্টস অ্যান্ড করোনেটস, দা ম্যান ইন দা হোয়াইট সুট, ইত্যাদি। ক্যারল রিড পরিচালনা করেন বেশ কয়েকটি গুরুত্ত্বপূর্ণ থ্রিলার ছবি, যেমন অড ম্যান আউট, দি ফলেন আইডল, আর দা থার্ড ম্যান। ডেভিড লিন বিশ্ব চলচ্চিত্র দুনিয়ায় আরও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ব্রিফ এনকাউন্টার এবং চার্লস ডিকেন্সের গল্প থেকে তৈরী গ্রেট এক্সপেক্টেশন আর অলিভার টুইস্ট ছবির মাধ্যমে। মাইকেল পাওয়েল এবং এমেরিক প্রেসবার্গার জুটি তাদের সৃজনশীল অংশীদারিত্ত্ব বজায় রাখেন ব্ল্যাক নার্সিসাস আর দি রেড শুস ছবিতে।
১৯৫০ এর দশক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রসমূহ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রসমূহের মধ্যকার টানাপোড়েনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র শিল্প বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৫০ দশকের গোড়ার দিকে হাউস আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিস কমিটি হলিউডে তদন্ত চালিয়ে প্রচুর অভিনেতা, লেখক, নির্দেশককে কালো তালিকাভুক্ত করে। এদের মধ্যে ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, ডালটন ট্র্যাম্বো ও আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি। এদের অনেকেই ইউরোপে, বিশেষত যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
এই কোল্ড ওয়ার জনিত প্যারানোইয়া চলচ্চিত্রের কাহিনীতেও প্রভাব ফেলে। ভিনগ্রহের ক্ষতিকর প্রাণীদের পৃথিবী আক্রমণ নিয়ে একাধিক ছবি তৈরী হয়, যেমন ইনভেশন অফ দা বডি স্ন্যাচারস, দি ওয়ার অফ দা ওয়ার্ল্ড, ইত্যাদি। কমিউনিষ্ট ষড়যন্ত্র নিয়ে তৈরী হয় দা মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট এর মতো ছবি।
ঠিক যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েই চলচ্চিত্র শিল্প অন্য এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। টেলিভিশনের ক্রমবর্দ্ধমান জনপ্রিয়তার সামনে প্রতিযোগিতায় পড়ে একাধিক প্রেক্ষাগৃহ দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। ষ্টুডিও সিস্টেমের সমালোচনা করে কিছু চলচ্চিত্র, যেমন সানসেট বুলেভার্ড (১৯৫০) বা দা ব্যাড অ্যান্ড দা বিউটিফুল (১৯৫২), এইসময়েই তৈরী হয়।
১৯৫০ এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ইসিডোর ইসোউ এর ছবি ট্রিটাইজ অন স্লাইম অ্যান্ড ইটার্নিটি প্রদর্শনের সময় ইসোউ এর অনুগামী লেট্রিস্ট আভাঁ-গার্দ আন্দোলনকারীরা হৈচৈ বাঁধিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে লেট্রিজম আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং উগ্র-লেট্রিস্ট রা হাইপারগ্রাফি নিয়ে কাজ চালিয়ে যান। ঐ দলের গুরুত্ত্বপূর্ণ সদস্য গি ডেবর পরিচালিত হাউলস অফ সাদ (১৯৫২) এই সময়ের একটি অন্যতম সৃষ্টি।
ষ্টুডিও এবং ফিল্ম কোম্পানিগুলো দর্শকদের আকর্ষণ করার জন্য নতুন উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার সন্ধানে ছিলেন। ১৯৫৩ সালে দ্য রোব ছবি দিয়ে টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স ষ্টুডিও চালু করলেন নতুন প্রশস্ত প্রদর্শন পদ্ধতি সিনেমাস্কোপ, ১৯৬৭ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা ছিল ফক্সের একচেটিয়া। চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীরা আরও জাঁকজমকপূর্ণ বিপণন পদ্ধতি চাইছিলেন, তাদের সাহায্য করল এইধরনের আরো নানারকম প্রদর্শন পদ্ধতি, যেমন ভিস্ট্যাভিশন, সিনেরামা, টড-এও, ইত্যাদি। এই বিশাল পর্দায় দেখানোর জন্য আবার এপিকধর্মী ছবি বানানো শুরু হল। এইসময়ের এইরকম কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হল দা টেন কমান্ডমেন্টস (১৯৫৬), দা ভাইকিংস (১৯৫৮), বেন-হার (১৯৫৯), স্পার্টাকাস (১৯৬০), এল সিড (১৯৬০), ইত্যাদি। মাইক টড এর টড-এও তে বানানো উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হল ওকলাহামা! (১৯৫৫), অ্যারাউন্ড দা ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি দেজ (১৯৫৬), সাউথ প্যাসিফিক (১৯৫৮), ক্লিওপেট্রা, ইত্যাদি। এইসময়ের আর এক গিমিক, ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্রের মেয়াদ অবশ্য স্থায়ী হয়েছিল মাত্র দুই বছর, ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪, তৈরী হয়েছিল হাউস অফ ওয়াক্স আর ক্রিয়েচার ফ্রম দা ব্ল্যাক লেগুন এর মত ছবি।
যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিষ্ঠানবিরোধী নাগরিক অধিকার আন্দোলন এর এক্টিভিজম বা সক্রিয়তাবাদী ঢেউ হলিউডেও এসে পড়েছিল, তৈরী হয়েছিল ব্ল্যাকবোর্ড জাঙ্গল (১৯৫৫), অন দা ওয়াটারফ্রন্ট (১৯৫৪), মার্তি (১৯৫৫), বা টুয়েলভ অ্যাঙ্গরি মেন (১৯৫৭) এর মতো ছবি। ডিজনি বানিয়ে চলেছিলেন তার স্বভাবসিদ্ধ অ্যানিমেশন ছবি যেমন সিন্ডারেলা (১৯৫০), পিটার প্যান (১৯৫৩), লেডি অ্যান্ড দা ট্রাম্প (১৯৫৫), স্লিপিং বিউটি (১৯৫৯), ইত্যাদি। তবে তিনি এবারে জীবন্ত মানুষের ছবিতেও আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছিলেন, প্রযোজনা করেছিলেন টোয়েন্টি থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দা সী (১৯৫৪) বা ওল্ড ইয়েলার (১৯৫৭) এর মত ছবি। সবমিলিয়ে টেলিভিশন কিন্তু চলচ্চিত্রকে প্রতিযোগিতায় ফেলে তার উৎকর্ষসাধনই করেছিল।
১৯৫২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি লাইমলাইট একটি বিশেষ কারণে স্মরণযোগ্য। এই ছবিতে ছবির দুই প্রধান চরিত্র চার্লি চ্যাপলিন এবং ক্লেয়ার ব্লুম তিনটি শতাব্দীকে একত্রিত করেছিলেন! চ্যাপলিনের প্রথম আবির্ভাব ঊনবিংশ শতাব্দীতে, ১৮৯৭ সালে, ক্লগ ডান্সিং এর দলে। আর ক্লেয়ার ব্লুম একবিংশ শতাব্দীতেও চুটিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিককালে দা কিংস স্পিচ (২০১০) ছবিতেও তার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে।
এশিয়ার চলচ্চিত্রে স্বর্ণযুগ
১৯৫০ এর দশক ছিল ইংরাজি নয় এমন ভাষার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে স্বর্ণযুগ বিশেষ করে এশিয়ার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে। এইসময়ে এশিয়ায় নির্মিত অনেক ছবিই সমালোচকদের দ্বারা বহুল প্রশংসিত, যেমন সত্যজিৎ রায়ের অপু ত্রয়ী (১৯৫৫-১৯৫৯) এবং জলসাঘর (১৯৫৮), ইয়াসুজিরো ওজু র টোকিও স্টোরি (১৯৫৩), কেনজি মিজোগুচির উগেৎসু (১৯৫৪) আর সানশো দা বেইলিফ (১৯৫৪), আকিরা কুরোসাওয়ার রশোমন (১৯৫০), ইকিরু (১৯৫২), সেভেন সামুরাই (১৯৫৪) এবং থ্রোন অফ ব্লাড (১৯৫৭)। এছাড়া উল্লেখযোগ্য ছবি হল রাজ কাপুর এর আওয়ারা (১৯৫১), মিকিও নারুসের ফ্লোটিং ক্লাউড (১৯৫৫), গুরু দত্ত এর পিয়াসা (১৯৫৭) এবং কাগজ কে ফুল (১৯৫৯), ইত্যাদি।
১৯৫০ এর দশকে জাপানের চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে সফল ছবিগুলোর অন্যতম ছিল আকিরা কুরোসাওয়া র রশোমন (১৯৫০), সেভেন সামুরাই (১৯৫৪) আর দা হিডেন ফোরট্রেস (১৯৫৮), ইয়াসুজিরো ওজু র টোকিও স্টোরি (১৯৫৩) এবং ইশিরো হন্দা র গডজিলা (১৯৫৪)। বিশ্ব চলচ্চিত্রে এই ছবিগুলোর প্রভাব সুগভীর ছিল, বিশেষ করে কুরোসাওয়ার সেভেন সামুরাই ছবিটিকে তো পাশ্চাত্ত্য চলচ্চিত্র জগতে বহুবার অনুকরণ করা হয়েছে, যেমন দা ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন (১৯৬০), ব্যাটেল বিঅণ্ড দা স্টার (১৯৮০), ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, এই ছবির অনুকরণে বলিউড এও তৈরি হয়েছে শোলে (১৯৭৫) আর চায়না গেট (১৯৯৮)। রশোমন অনুকরণে যে শুধু ছবি তৈরি হয়েছে তাই নয় (দি আউটরেজ, ১৯৬৪), ঐ ছবির গল্প বলার বিশেষ ধরন পরিচিতি পেয়েছে রশোমন এফেক্ট নামে, আর অনুসৃত হয়েছে অন্ধা নাল(১৯৫৪), দা ইউজুয়াল সাসপেক্ট (১৯৯৫), হিরো (২০০২), ইত্যাদি ছবিতে। দা হিডেন ফোরট্রেস থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে জর্জ লুকাসের স্টার ওয়ার্স (১৯৭৭)। এইসময়ের অন্যান্য বিখ্যাত জাপানী পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন কেনজি মিজোগুচি, মিকিও নারুসে, হিরোসি ইনাগাকি আর নাগিসা ওশিমা।[ ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ র মধ্যে হলিউডে যে নতুন ধরনের ছবি তৈরির আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার মূল অনুপ্রেরণাই ছিল জাপানের চলচ্চিত্র।
১৯৫০ এর দশকের ভারতীয় চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে বছরে অন্তত ২০০ ছবি বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হত, অন্যদিকে সমান্তরাল চলচ্চিত্রগুলি স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে। এর মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের তৈরি অপু ত্রয়ী (১৯৫৫-১৯৫৯)। সত্যজিতের ছবি বিশ্বজুড়ে অনেক পরিচালকের চলচ্চিত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাদের মধ্যে রয়েছেন আকিরা কুরোসাওয়া, মার্টিন স্কোরসেজি, জেমস আইভরি, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, এলিয়া কাজান, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, স্টিফেন স্পিলবার্গ, কার্লোস সাওরা, জাঁ-লুক গদার, ইসাও তাকাহাতা,গ্রেগরি নাভা, ইরা স্যাশ, ওয়েস অ্যান্ডারসন এবং ড্যানি বয়েল। দি আটলান্টিক মান্থলি পত্রিকার মাইকেল সারাগোর মতে মধ্য-পঞ্চাশের নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর শিল্পকলানির্ভর ছবিগুলি ভীষণভাবেই অপু ত্রয়ী ছবির কাছে ঋণী।সুব্রত মিত্র তার বিশেষ চিত্রগ্রহণ কৌশল বাউন্স লাইটিং এই অপু ত্রয়ী ছবিতেই উদ্ভাবন করেছিলেন। এইসময়ের ভারতের আরও কয়েকজন বিখ্যাত পরিচালক হলেন ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, বিমল রয়, গুরু দত্ত, কে আসিফ, মেহবুব খান, ইত্যাদি।
দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র এরও সেই সময় ছিল স্বর্ণযুগ। ১৯৫৫ সালে কোরিয়ার উপকথা চুনহ্যাংজিওন অবলম্বনে লি-কু-হান এর ছবি ভীষণ জনপ্রিয় হয়। ঐ বছরেই ইয়াংসান প্রভিন্স ছবির মুক্তি দিয়ে প্রখ্যাত পরিচালক কিম-কি-ইওং এর কেরিয়ার শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে কোরিয়ান ছবির সংখ্যা ও মান দুয়েরই ব্যাপক উন্নতি হয়। লি-বিয়ং-ইল এর ১৯৫৬ সালে বানানো কমেডি ছবি সিজিবগানেউন নাল (বিবাহের দিন) আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়। ১৯৫০ এর শুরুতে যেখানে কোরিয়ায় বছরে গড়ে ৫টি করে ছবি তৈরি হত, ১৯৫৯ সালে সেটা বেড়ে হয় ১১১।
ফিলিপিন্স এর চলচ্চিত্র তেও এইসময়ে স্বর্ণযুগ আসে। চলচ্চিত্রকারদের শিল্পবোধ অনেক পরিণত হয়, প্রয়োগকৌশলেও চোখে পড়ার মত উন্নতি আসে। নির্মিত ছবির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় প্রতিভারা বিদেশেও সমাদৃত হতে থাকেন। এইসময়ের প্রধান ফিলিপ পরিচালকরা হলেন জেরারদো দে লিও, গ্রেগরিও ফারনান্দেজ, এডি রোমেরো, লাম্বার্টো আভেলানা এবং সিরিও সান্তিয়াগো।
১৯৬০ এর দশক
১৯৬০ এর দশকে হলিউড ষ্টুডিও সিস্টেমে ক্ষয় ধরে, প্রচুর ছবি স্টুডিওর বাইরে লোকেশনে বা অন্য দেশের স্টুডিওতে তৈরী হওয়া শুরু হয় (যেমন যুক্তরাজ্যে পাইনউড বা রোমে সিনেচিত্তা)। হলিউড ছবি এখনও প্রধানত পারিবারিক দর্শকদের কথা ভেবেই তৈরী হত, আর পুরোনো ঢঙে তৈরী ছবিগুলোই সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল। এই দশকের সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়িক সাফল্যমন্ডিত ছবিগুলোর মধ্যে ছিল মেরি পপিন্স (১৯৬৪), মাই ফেয়ার লেডি (১৯৬৪) আর দি সাউন্ড অফ মিউজিক (১৯৬৫)। স্বাধীন প্রযোজক আর কোম্পানিগুলোর উত্থান আর অভিনেতাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, এই দুইয়ে মিলে চিরাচরিত ষ্টুডিও সিস্টেমের পতন ত্বরান্বিত করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে এইসময়ে বিদেশী ভাষার ছবি নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ বা ফরাসি নবকল্লোল আন্দোলনের পুরোধা জাঁ-লুক গদার এবং ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো হলিউড সিনেমার পরিচিত গল্প বলার রীতিকে ভেঙে দেন ব্রেথলেস, ফোর হান্ড্রেড ব্লোস এবং জুল এ জিম ছবিতে। পশ্চিমী দর্শকেরা ইতালীয় পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনির নৈরাশ্যবাদ এবং সুইডেনের ইঙ্গমার বার্গম্যানের চমকপ্রদ স্বপ্নময়তার সাথেও পরিচিত হন।
ব্রিটেনে লিণ্ডসে অ্যান্ডারসন, টনি রিচার্ডসন এবং অন্যান্যরা বাস্তববাদী আর উদ্ভাবনীমূলক স্যাটারডে নাইট অ্যান্ড স্যাটারডে মর্নিং, এ কাইন্ড অফ লাভিং, দিস স্পোর্টিং লাইফ জাতীয় ছবি তৈরী করছিলেন। অন্যান্য ব্রিটিশ ছবি যেমন রিপালশন, ডার্লিং, আলফি, ব্লো-আপ, জর্জি হিল (১৯৬৫-১৯৬৬) ছবিগুলি নিষিদ্ধ যৌনতা ও নগ্নতাকে পর্দায় নিয়ে আসে। অন্যদিকে জেমস বন্ড সিরিজের ছবিগুলো খুচরো যৌনতা ও হিংস্রতাকে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলে।
এসময়েই উসমান সেমবেন অনেকগুলি ফরাসি এবং উলফ ভাষার ছবি বানিয়ে আফ্রিকার চলচ্চিত্রের জন্মদাতা হিসেবে পরিচিত হন। লাতিন আমেরিকার পরিচালকরাও হলিউডের দৌরাত্মকে রীতিমত চাপের মুখে ফেলেন। ফার্নান্দো সোলানাস এবং অক্টাভিও গেটিনো হলিউডের বৈপরীত্যে রাজনৈতিক থার্ড সিনেমা আন্দোলনের সূচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা (যেমন ১৯৬২ র কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকট) হলিউড চলচ্চিত্রেও প্রভাব ফেলেছিল, স্ট্যানলি কুবরিক তৈরী করেছিলেন ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ বা ফল সেফ এর মত বিদ্রুপাত্মক ছবি।
তথ্যচিত্রের ক্ষেত্রে এইসময়ে ডিরেক্ট সিনেমা নামে এক নতুন ঘরানার উদ্ভব হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে এমিল ডি আন্তোনিও তৈরী করেন বিতর্কিত ছবি ইন দা ইয়ার অফ দা পিগ (১৯৬৮)।
১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে সামাজিক বিপ্লবের পটভূমিকায় অনেক ভিন্নধর্মী ছবি তৈরী হয়। এই নতুন যুগের হলিউড ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বনি অ্যান্ড ক্লাইড (১৯৬৭), দি গ্রাজুয়েট (১৯৬৭), ২০০১: এ স্পেস ওডিসি (১৯৬৮), রোজমেরিস বেবি (১৯৬৮), মিডনাইট কাউবয় (১৯৬৯), ইজি রাইডার (১৯৬৯) এবং দি ওয়াইল্ড বাঞ্চ (১৯৬৯)। বনি অ্যান্ড ক্লাইড থেকেই নব্য হলিউড ছবির সূচনা হয়েছিল বলে ধরা হয়।
জাপানে অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া বানান অতি প্রভাবশালী ছবি ইয়োজিম্বো (১৯৬১)। এই ছবির অনুকরণে হলিউডে সের্জিও লেওনে তৈরী করেন এ ফিস্টফুল অফ ডলারস (১৯৬৪) আর ওয়াল্টার হিল বানান লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং। এই ইয়োজিম্বো ছবিটি থেকেই নামবিহীন ব্যক্তি নির্ভর চলচ্চিত্রের সূত্রপাত হয়।
১৯৭০ এর দশক
১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে স্টুডিও সিস্টেমের ক্ষয়ের পরে ১৯৭০ এর দশকে নব্য হলিউড ঘরানা জোরদার হয়। ১৯৬৮ তে হলিউডের ব্যবহার নির্দেশিকা প্রডাকশন কোড বাতিল হয়ে নতুন নিয়ম এমপিএ ফিল্ম রেটিং সিস্টেম বলবৎ হয়। এই দশকে চলচ্চিত্রে বিশদ যৌনতা ও হিংসার ব্যবহার বাড়ে, উদাহরণ হিসেবে ওয়েস ক্র্যাভেন এর দা লাস্ট হাউস অন দা লেফ্ট (১৯৭২) এর নাম করা যায়।
নতুন হলিউডের চলচ্চিত্রের গল্প বলার রীতিতে কয়েকটি চোখে পড়ার মত পরিবর্তন এসেছিল। ঘটনার কালক্রম এলোমেলো হতে পারত, কাহিনীর শেষে থাকত অপ্রত্যাশিত মোচড়, চরিত্রগুলোর আচার-আচরণ আশানুরূপ হতনা, এমনকি নায়ক ও খলনায়কের চরিত্রের সীমারেখা অস্পষ্ট করে দেওয়া হত। অবশ্য ১৯৪০ ও ১৯৫০ এর দশকে নোয়া চলচ্চিত্র ঘরানায় এইরকম প্রয়োগ আগেও হয়েছিল, যেমন রেবেল উইদাউট এ কজ (১৯৫৫) বা হিচককের সাইকো (১৯৬০)। ১৯৭১ সালে বেশকিছু বিতর্কিত ছবি মুক্তি পায়, যেমন স্ট্র ডগস, এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ, দা ফ্রেঞ্চ কানেকশন আর ডার্টি হ্যারি, যা ছবিতে যৌনতা ও হিংস্রতার ব্যবহার নিয়ে পুরোনো বিতর্ক উস্কে দেয়।
এই দশকে নতুন যে পরিচালকরা উঠে এলেন তাদের মধ্যে ছিলেন মার্টিন স্কোরসেজি, ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলা, জর্জ লুকাস, উডি অ্যালেন, টেরেন্স মালিক আর রবার্ট অল্টম্যান। সেইসঙ্গে জনপ্রিয় হতে থাকে অতার মতবাদ, যেখানে পরিচালকই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার নিজস্ব সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন। এই মতবাদের অনুসরণে পরিচালকরা ছবির ওপর আগের জমানার তুলনায় অনেক বেশি কর্তৃত্ব পান। শুধু তাই নয়, এইভাবে তারা বাণিজ্যিক সাফল্যও পান, যেমন স্কোরসেজির ট্যাক্সি ড্রাইভার, কাপোলার দি গডফাদার সিরিজের ছবিগুলি, উইলিয়াম ফ্রেড্রিক এর দি এক্সরসিস্ট, অল্টম্যানের ন্যাশভিল, উডি অ্যালেনের অ্যানি হল আর ম্যানহাটন, মালিকের ব্যাডল্যান্ডস আর ডেজ অফ হেভেন, এবং পোলিশ অভিবাসী রোমান পোলানস্কি র চায়নাটাউন। অবশ্য কিছুক্ষেত্রে ব্যর্থতার সম্মুখীন ও হতে হয় যেমন, পিটার বোগদানোভিচ এর অ্যাট লং লাস্ট লাভ আর মাইকেল সিমিনো র ব্যয়বহুল ওয়েস্টার্ন ছবি হেভেনস গেট, যার ফলে ইউনাইটেড আর্টিস্ট স্টুডিওর পতন ঘটে।
‘অতার মতবাদী’ পরিচালকরা ছবি তৈরির ক্ষেত্রে অপরিমিত সৃজনশীল ও আর্থিক স্বাধীনতার অধিকারী ছিলেন, কিন্তু হেভেনস গেট এর ব্যর্থতার পর এই নব্য হলিউড ঘরানায় ভাঁটা পড়ে। ১৯৭০ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গ এর তৈরী জ’স ছবির বিস্ময়কর সাফল্যে আধুনিক ব্লকবাস্টার ছবির ধারণার সূত্রপাত হয়। তবে ১৯৭৭ সালের জর্জ লুকাসের ষ্টার ওয়ার্স ছবির বিরাট সাফল্যই ব্লকবাস্টার ছবির ঘরানাকে মজবুত করে। ঐ ছবির বৈপ্লবিক স্পেশাল এফেক্ট এবং শব্দ ও সংগীতের বিশেষ ব্যবহারের কারণে ছবিটি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী ছবি হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে। এরপর থেকে হলিউড স্টুডিওগুলোর বাণিজ্যনীতি হয়ে দাঁড়ায় বড় বাজেটের স্বল্পসংখ্যক ছবি বানানো এবং প্রচার ও বিপণনে বেশি মনোযোগ দেওয়া। বিপর্যয় বা দুর্ঘটনা নিয়ে বানানো দি পসিডন অ্যাডভেঞ্চার (১৯৭২) বা দি টাওয়ারিং ইনফেরনো (১৯৭৪) ছবিগুলির ব্যবসায়িক সাফল্য থেকেই অবশ্য এই প্রবণতার পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল।
১৯৭০ এর দশকের মাঝামাঝি প্রাপ্তবয়স্কদের ছবি প্রদর্শনের জন্য আলাদা প্রেক্ষাগৃহ তৈরী হতে থাকে, আর পর্নোগ্রাফির আইনসম্মত উৎপাদন শুরু হয়। ডিপ থ্রোট এর মতো পর্ন ছবি এবং পর্নস্টার লিন্ডা লোভেলাস প্রভূত জনপ্রিয় হন এবং তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একই ধরনের প্রচুর ছবি তৈরী হয়। ১৯৮০ তে এসে পর্ন ছবির বাজার বাজার পড়ে যায় কারণ ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার বাজারে আসায় দর্শকরা বাড়িতে বসেই পর্নের মজা পেয়ে যান।
১৯৭০ এর শুরুতে ইংরাজি ভাষাভাষী দর্শকরা পশ্চিম জার্মানির চলচ্চিত্রর সঙ্গে পরিচিত হন প্রধানত সংবেদনশীল পরিচালক ওয়ার্নার হেরজগ, রেইনে ওয়ার্নার ফাসবিন্ডার আর উইম ওয়েন্ডার এর মাধ্যমে।
সারা বিশ্ব জুড়েই ১৯৭০ দশকে মার্শাল আর্ট চলচ্চিত্র বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়, প্রধানত ব্রুস লি র হাত ধরে। চীনদেশের ঐতিহ্যবাহী মার্শাল আর্ট চলচ্চিত্রে আরও বাস্তবতা আমদানি করে ব্রুস নিজস্ব স্টাইল তৈরী করেন। এশিয়ায় তার ছবি দা বিগ বস (১৯৭১) প্রভূত জনপ্রিয় হয়। তবে পশ্চিমি দুনিয়ায় তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয় তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ১৯৭৩ সালে, যখন এন্টার দ্য ড্রাগন ছবি মুক্তি পায়। ছবিটি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় মার্শাল আর্ট ছবি হিসাবে স্বীকৃত এবং এইধরনের ছবিকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রদূত। কিন্তু পরবর্তীকালে এই ছবির অনুকরণে আরও ছবি তৈরির প্রবণতাই এই ঘরানার পতন ডেকে আনে। ১৯৭৮ সালে হংকং এর পরিচালক উয়েন উ-পিং দুটি ছবি বানান, স্নেক ইন দা ঈগল শ্যাডো আর ড্রাঙ্কেন মাস্টার, যেখানে নায়ক জ্যাকি চ্যান মার্শাল আর্টের সঙ্গে কৌতুকাভিনয়ের মিশ্রনে এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করেন। এরপর থেকে মার্শাল আর্ট নির্ভর ছবি এই ঘরানাতেই তৈরী হতে থাকে।
হলিউডে সঙ্গীতনির্ভর ছবির বাজার পড়ে গেলেও ভারতবর্ষে তা রমরম করে চলতে থাকে, বোম্বে (বর্তমানে মুম্বই) শহরে তৈরী হিন্দি ছবি তুলনামূলকভাবে অধিক শিল্পসম্মত বাংলা ছবিকে সরিয়ে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করে। ঐ বোম্বে নাম থেকেই হলিউডের অনুকরণে বলিউড নামের উৎপত্তি। হিন্দি ছবি নির্মাতারা হলিউডের মিউজিক্যাল ছবির রীতির সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রকে মিশিয়ে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেন (মশালা), যা কিনা বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ছবির জগৎকে শাসন করে গেছে। এই ‘মশালা’ ছবিতে মারদাঙ্গা, কৌতুকাভিনয়, চাঞ্চল্যকর ঘটনা, রোমান্স, মেলোড্রামা আর সঙ্গীত ও নৃত্যের অভাবনীয় মিশ্রণ থাকত। এইধরনের ছবির সূত্রপাত হয় পরিচালক মনমোহন দেশাই এবং অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন এর হাত ধরে। ভারতের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ মশালা ছবি হল শোলে (১৯৭৫), ছবিটি কুরোসাওয়ার সেভেন সামুরাই এর অনুকরণে স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন ঘরানা অবলম্বনে তৈরী।
এই দশকের শেষের দিকে অস্ট্রেলিয়ার পিটার উইয়ার এর পিকনিক অ্যাট হ্যাঙ্গিং রক (১৯৭৫) আর দি লাস্ট ওয়েভ (১৯৭৭), এবং ফ্রেড শেপিসি র দি চান্ট অফ জিমি ব্ল্যাকস্মিথ (১৯৭৮) ছবিগুলি আন্তর্জাতিক খ্যাতি পায়। ঐ দেশেরই জর্জ মিলার কম বাজেটে ভীষণ হিংসাত্মক ছবি ম্যাড ম্যাক্স (১৯৭৯) তৈরী করে বিশ্বের নজর কাড়েন।
১৯৮০ র দশক
১৯৮০ র দশকে বাড়িতে বসে ভিডিও ক্যাসেটে ছবি দেখার প্রবণতা বাড়তে থাকে। শুরুর দিকে স্টুডিওর তরফ থেকে কপিরাইট ভঙ্গ জনিত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। শেষ পর্যন্ত ভিডিও রাইট বিক্রি চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য আরও একটা উপার্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
এই দশক জুড়ে হলিউড দাপিয়ে বেড়ায় লুকাস-স্পিলবার্গ জুটি এবং তাদের পুরোনো ছবিগুলোর সিক্যুয়েল। স্টার ওয়ার্স এর দুটি, জ’স এর তিনটি আর ইণ্ডিয়ানা জোনস এর তিনটি সিক্যুয়েল আশাতীত সাফল্য পায়। ১৯৮২ তে লুকাস নিজের লুকাসফিল্মস কোম্পানির নতুন বিভাগ টিএইচএক্স লিমিটেড শুরু করেন, অন্যদিকে স্পিলবার্গকে দশকের সেরা সাফল্য এনে দেয় ইটি দি এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল ছবিটি। ঐ বছরেই প্রথম ডিজনির মতো বড় মাপের স্টুডিও ব্যাপক কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহার শুরু করে ট্রন ছবি দিয়ে। এই দশকে আমেরিকার ইণ্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা আরও বেশি করে ধুঁকতে থাকে, যদিও মার্টিন স্কোরসেজি নিজেকে মূলধারায় প্রতিষ্ঠা করেন রেজিং বুল (১৯৮০), দা কিং অফ কমেডি (১৯৮৩) আর আফটার আওয়ার্স (১৯৮৫) ছবিতে। ১৯৮৩ তেই মুক্তি পায় এই দশকের অন্যতম সফল ছবি স্কারফেস, যা অভিনেতা আল পাচিনো কে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যায়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যসফল ছবি ছিল বব কেন এর কমিক্স স্ট্রিপ চরিত্র কে নিয়ে টিম বার্টন এর ছবি ব্যাটম্যান (১৯৮৯), ছবির খলনায়ক জোকার এর চরিত্রে অভিনয় করে জ্যাক নিকোলসন প্রায় $60,000,000 টাকা রোজগার করেন।
১৯৮০ র দশকের শুরুতে ডেভিড পাটনাম এর গোল্ডক্রেস্ট ফিল্ম কোম্পানির মাধ্যমে ব্রিটিশ চলচ্চিত্রে নতুন উৎসাহের সঞ্চার হয়। তাদের তৈরী ছবিগুলো সমাদৃত হয় মধ্যমবর্গীয় বুদ্ধিজীবী মহলে, যাদের হলিউড একরকম ব্রাত্যই করে রেখেছিল। এই শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হল চ্যারিয়টস অফ ফায়ার, গান্ধী, দা কিলিং ফিল্ডস, এ রুম উইথ এ ভিউ, ইত্যাদি। মাল্টিপ্লেক্সের উত্থানের জন্য হলিউডেও ছবি বিপণনের পদ্ধতির কিছুটা পরিবর্তন এল। আশাতীতভাবে মূলধারার ব্লকবাস্টার ছবিগুলোর প্রদর্শনসংখ্যা কমল না, বরং বেড়েই গেল। তবে বড়পর্দায় উপেক্ষিত অনেক ছবিই আবার ভিডিওর কল্যাণে দর্শকের কাছে পৌঁছনোর আরও একটা সুযোগ পেল।
জাপানে কম্পিউটার অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র বা অ্যানিমে র সাফল্য জাপানের চলচ্চিত্র শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করল। টিভি সিরিজ হিসেবে স্পেস ব্যাটেলশিপ ইয়ামাতো (১৯৭৩) আর মোবাইল স্যুট গানদেম (১৯৭৯) ব্যর্থ হলেও আশির দশকের গোড়ার দিকে এদের চলচ্চিত্র সংস্করণ বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে মোবাইল স্যুট গানদেম ছবিটি থেকে রিয়েল রোবোট মেকা অ্যানিমেতে গানদেম বলে একটি নতুন ঘরানারই সৃষ্টি হয়। ম্যাক্রস: ডু ইউ রিমেম্বার লাভ? ছবিটি থেকেও তৈরী হয় নতুন ম্যাক্রস ঘরানা। এই দশকেই পত্তন হয় ষ্টুডিও ঘিবলি র, যেখান থেকে তৈরী হয় হায়ায়ো মিয়াজাকি র প্রথম ফ্যান্টাসি ছবি নওসিকা অফ দা ভ্যালি অফ দা উইন্ড (১৯৮৪) এবং ক্যাসল ইন দা স্কাই (১৯৮৬), এছাড়াও ইসাও তাকাহাতা র ছবি গ্রেভ অফ দা ফায়ারফ্লাই (১৯৮৮)। প্রতিটা ছবিই জাপানে ভীষণ সাফল্যলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়েও সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। অরিজিনাল ভিডিও অ্যানিমেশন বা ওভিএ চলচ্চিত্রও এই সময় থেকেই শুরু হয়, এই ঘরানার সবচেয়ে প্রভাবশালী ছবি ছিল নোবোরু ইশিগুরো র সাইবারপাঙ্ক ছবি মেগাজোন ২৩ (১৯৮৫)। এই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যানিমে ছবি ছিল কাতসুহিরো ওতোমো র সাইবারপাঙ্ক ছবি আকিরা (১৯৮৮), যা কিনা প্রথমে জাপানে সেরকম জনপ্রিয় হয়নি, কিন্তু পরে আন্তর্জাতিক বাজারে সাফল্য পায়।
আশির দশকে হংকং এর অ্যাকশন চলচ্চিত্রের পুনরুত্থান ঘটে জ্যাকি চ্যান এর হাত ধরে। মার্শাল আর্ট ও কৌতুকাভিনয় মিশ্রিত দুটি ছবি করে তিনি সত্তর দশকেই জনপ্রিয় হয়েছিলেন। এবার এর সঙ্গে তিনি বিপজ্জনক স্টান্ট ও জুড়ে দেন, কতকটা নির্বাক যুগের কিছু বিখ্যাত ছবির আদলে। জ্যাকি চ্যান, স্যাম্মো হ্যান ও উয়েন বিয়াও, এই তিনজনকে নিয়ে গড়ে ওঠে জ্যাকি চ্যান স্টান্ট টিম, এদেরকে একত্রে থ্রি ব্রাদার্স বা তিন ভাইও বলা হত। এই টিমের তৈরী প্রজেক্ট এ (১৯৮৩) পুব দেশগুলিতে বিপুল জনপ্রিয় হয়। এই সাফল্যের ওপর ভর করে চ্যান অনেকগুলি ছবি করেন, যেমন হুইলস অন মিলস (১৯৮৪), পুলিশ স্টোরি (১৯৮৫), আর্মার অফ গড (১৯৮৬), প্রজেক্ট এ পার্ট টু (১৯৮৭), পুলিশ স্টোরি ২ (১৯৮৮) এবং ড্রাগনস ফরএভার (১৯৮৮)। অন্যদিকে মিশেল ইয়ো জনপ্রিয় হন মহিলাকেন্দ্রিক অ্যাকশন ছবিতে অভিনয় করে। সংগঠিত অপরাধমূলক ছবির ধারা শুরু করেন জন উ, আর এইধরনের ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে জনপ্রিয় হন চাও উন-ফ্যাট। পরবর্তী দুই দশকে হংকং এর অনেক অ্যাকশন ছবিই হলিউডে পুনর্নিমাণ করা হয়।
১৯৯০ এর দশক
১৯৯০ দশকের গোড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ইণ্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা নতুন রূপে ফিরে আসে, এবারে অভূতপূর্ব বাণিজ্যিক সাফল্যের সঙ্গে। স্টিভেন সোডারবার্গ এর সেক্স, লাইজ অ্যান্ড ভিডিওটেপ (১৯৮৯) আর কোয়েন্টিন টারান্টিনো র রিজারভয়ার ডগ্স (১৯৯২) প্রেক্ষাগৃহ এবং হোম ভিডিও, দুজায়গাতেই ভালো ব্যবসা করে। অন্যদিকে চলচ্চিত্রে স্পেশাল এফেক্টের প্রাধান্য ছিল ক্রমবর্ধমান, যেমন টার্মিনেটর টু: জাজমেন্ট ডে (১৯৯১), জুরাসিক পার্ক (১৯৯৩) আর টাইটানিক (১৯৯৭)! শেষোক্ত ছবিটি তো সর্বকালের সেরা ব্যবসায়িক সাফল্যের রেকর্ড করে এবং ২০০৯ এ অবতার ছবির আগে পর্যন্ত সেই রেকর্ড অক্ষুণ্ণ ছিল। আবার এই সময়েই সমস্ত রকম গিমিক বর্জন করে শুদ্ধ চলচ্চিত্র বানানোর লক্ষ্যে একটি নির্দেশিকা সহ ডগমে ৯৫ আন্দোলনের শুরু হয়, যার পুরোধা ছিলেন ডেনমার্কজাত পরিচালক লারস ভন ত্রিয়ে আর টমাস ভিন্টারবার্গ। প্রথমদিকে তাদের তৈরী কিছু ছবি সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়, যেমন ফেস্টেন (১৯৯৮), কিন্তু পরবর্তীকালে পরিচালকরা ঐ নির্দেশিকা থেকে বিচ্যুত হতে থাকেন এবং অচিরেই এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এই ইণ্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমার জনপ্রিয়তায় প্রভাবিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ স্টুডিওগুলো নিজস্ব ‘ইণ্ডিপেন্ডেন্ট’ প্রোডাকশন কোম্পানি তৈরী করেন। ১৯৯০ দশকের অন্যতম সফল কোম্পানি হল মিরাম্যাক্স ফিল্মস যেটা কিনে নেন ডিজনি, টারান্টিনোর পাল্প ফিকশন (১৯৯৪) মুক্তির এক বছর আগেই। এই সময়েই ফিল্ম ও ভিডিওর অনলাইন ডিস্ট্রিবিউশন প্রক্রিয়া চালু হয়। পরিবারকেন্দ্রিক অ্যানিমেশন ছবিও হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পায় ডিজনির বিউটি অ্যান্ড দা বিস্ট (১৯৯১), আলাদিন (১৯৯২) আর লায়ন কিং (১৯৯৪) এর মাধ্যমে। এই দশকেই কম্পিউটার-অ্যানিমেশন এর সাহায্যে নির্মিত হয় প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র টয় স্টোরি (১৯৯৫), প্রযোজনা করেন পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওস। এই ছবির সাফল্যের পর পূর্ণদৈর্ঘ্যের অ্যানিমেশন ছবির ক্ষেত্রে কম্পিউটার-অ্যানিমেশন ই মূল প্রযুক্তি হয়ে দাঁড়ায়, ড্রিমওয়ার্কস অ্যানিমেশন বা টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স এর মতো কোম্পানিরা ডিজনির সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়ে। এই দশকের শেষের দিকেই ডিজিটাল চলচ্চিত্র প্রযুক্তি আসার সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা হয়। অন্যদিকে হোম ভিডিওতে ভিএইচএস টেপ কে সরিয়ে বাজারের দখল নেয় ডিভিডি।
সাম্প্রতিক সময়ে
এই প্রথম ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্র ও আলাদা বাণিজ্যিক ধারা হিসেবে উঠে আসে, প্রধানত মার্চ অফ দ্য পেঙ্গুইন বা মাইকেল মুর এর বোলিং ফর কলম্বাইন আর ফারেনহাইট ৯/১১ এর কল্যাণে। তথ্যচিত্রে নতুন ঘরানাই সৃষ্টি করে দেয় মার্টিন কুনার্ট আর এরিক মেন এর ভয়েসেস অফ ইরাক, ঐ ছবির জন্য দেড়শো সস্তার ক্যামেরা সারা ইরাক জুড়ে বিতরণ করা হয়েছিল আর তার ফলে ইরাকি জনসাধারণই তথ্যচিত্র নির্মাণের অংশীদার হয়ে যান। অন্যদিকে এপিকধর্মী ছবির পুনরুত্থান ঘটে গ্ল্যাডিয়েটর ছবির মাধ্যমে আর মূলা রুজ ছবিটি সঙ্গীতময় চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শকদের উৎসাহ ফিরিয়ে আনে। হোম থিয়েটার সিস্টেম বাজারে আসার ফলে ঐ প্রযুক্তির উপযোগী ডিভিডি তৈরী হতে থাকে। লর্ড অফ দ্য রিংস ত্রয়ী ছবি যেমন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় তেমনি ডিভিডিতে বিশেষ প্রলম্বিত সংস্করণ একইসঙ্গে বাজারে আসে।
২০০১ সালে হ্যারি পটার সিরিজের কল্পকাহিনী নিয়ে ছবি বানানো শুরু হয় আর ২০১১ সালে এই সিরিজের শেষ ছবি আসতে আসতে সিরিজটা সর্বকালের সেরা বাণিজ্যিক ফিল্ম ফ্র্যানচাইজির শিরোপা দখল করে। ২০১৫ সালে অবশ্য এই শিরোপা ছিনিয়ে নেয় মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স।
ডিজনির ট্রেজার প্ল্যানেট দিয়ে ২০০২ সালে আইম্যাক্স সিনেমার যাত্রা শুরু হয়, তবে আইম্যাক্স জনপ্রিয় হয় ২০০৩ এ এসে দা ম্যাট্রিক্স রিভলিউশন ছবি আর দা ম্যাট্রিক্স রিলোডেড এর পুনর্মুক্তির মধ্যে দিয়ে। এই দশকের শেষের দিকে প্রথম যে গুরুত্বপূর্ণ ছবির আংশিক শুটিং ম্যাট্রিক্স প্রযুক্তিতে করা হয় তা হল দ্য ডার্ক নাইট।
এই দশকে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে চলচ্চিত্রেরও বিশ্বায়ন ঘটে, ইংরাজী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে বিদেশী ভাষার ছবিও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ক্রাউচিং টাইগার, হিডেন ড্রাগন (মান্দারিন), অ্যামেলি (ফরাসী), লগান (হিন্দি), স্পিরিটেড অ্যাওয়ে (জাপানি), সিটি অফ গড (ব্রাজিলিয় পর্তুগিজ), দি প্যাশন অফ ক্রাইস্ট (আরামাইক), অ্যাপোক্যালিপ্টো (মায়া) আর ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস (একাধিক ইউরোপীয় ভাষা)। এই দশকে শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার ছবি বিভাগে অ্যাকাডেমি পুরস্কারের তালিকায় ইতালি সর্বোচ্চ স্থান পায় ১৪টি পুরস্কার, ৩টি বিশেষ পুরস্কার ও ৩১টি মনোনয়ন সহ।
ত্রিমাত্রিক ছবি নিয়েও নতুন উৎসাহের সঞ্চার হয় জেমস ক্যামেরনের গোস্টস অফ দা অ্যাবিস ছবি দিয়ে। রিয়েলিটি ক্যামেরা সিস্টেম ব্যবহার করে বানানো এই ছবিটিই প্রথম ত্রিমাত্রিক পূর্ণদৈর্ঘ্যের আইম্যাক্স কাহিনীচিত্র। ফিল্মের বদলে এইচডি ভিডিও ক্যামেরা সহ এই সিস্টেম তৈরী করেছিলেন ক্যামেরন, তার এমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত চিত্রগ্রহণ-নির্দেশক ভিন্স পেস এর জন্য, তারই চাহিদা অনুযায়ী। এই সিস্টেমে তোলা উল্লেখযোগ্য ছবি ছিল স্পাই কিডস: গেম ওভার (২০০৩), এলিয়েনস অফ দা ডিপ (২০০৫), আর দা অ্যাডভেঞ্চার্স অফ শার্কবয় অ্যাণ্ড লাভাগার্ল (২০০৫)।
জেমস ক্যামেরনের ত্রিমাত্রিক ছবি অবতার এর রেকর্ডভাঙা সাফল্যের পর ত্রিমাত্রিক ছবি নিয়ে উৎসাহ আরও বাড়ে। বাণিজ্যিক সাফল্যমণ্ডিত এবং সমালোচকদের প্রশংসাধন্য ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ইউনিভার্সাল পিকচার্স/ইলুমিনেশন এন্টারটেইনমেন্ট এর ডেসপিকেবল মি, ড্রিমওয়ার্কস অ্যানিমেশন এর হাউ টু ট্রেইন ইয়োর ড্রাগন, শ্রেক ফরএভার আফটার, মেগামাইণ্ড, ইত্যাদি। মোশন ক্যাপচার টেকনোলজির সার্থক প্রয়োগে অবতার ছবিটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছবির কাছে প্রেরণাস্বরূপ হয়ে ওঠে, যেমন রাইজ অফ দা প্ল্যানেট অফ দা এপস।
২০১০ এ এসে চলচ্চিত্র নির্মান সংখ্যার নিরিখে বিশ্বে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, নাইজেরিয়া আর জাপানই এগিয়ে।২০০৮ থেকে শুরু করে মার্ভেল কমিকস ও ডিসি কমিকস এর অতিমানব চরিত্রদের নিয়ে তৈরী আয়রন ম্যান বা দ্য ডার্ক নাইট ছবি বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং এইরকম ছবি নিয়মিতভাবে তৈরী হতে থাকে।
সূত্র : উইকিপিডিয়া