ফিচার ডেস্ক
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয় বাঙালি জাতির সঙ্গে। প্রথমে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তারা। সেই সঙ্গে শুরু হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। কিন্তু সবধরনের উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে একাট্টা হয়ে ওঠে তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধুর সাহসী প্রতিবাদের মাধ্যমে যে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত, ছাত্র-তরুণ-যুবাদের রক্ত দানের মাধ্যমে তা রূপ নেয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার মানুষের সঙ্গে গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের একটা প্রাণের সংযোগ স্থাপিত হয়। এরপরই, ১৯৫৩ সালে, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭ টি মুসলিম (মোট আসন ছিল ৩০৯ টি) আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন অর্জন করে। তন্মধ্যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩ টি, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি ৪৮ টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ১৯ টি, গণতন্ত্রী দল ১৩ টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৪ টি ও পরে যোগ দেওয়া স্বতন্ত্র ৮ টি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে এ নির্বাচনে পরাভূত হয় ; তারা কেবল ৯টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়।
এ নির্বাচনে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য ৭২টি আসন সংরক্ষিত ছিল। এগুলোর মধ্যে কংগ্রেস লাভ করেছিল ২৪টি আসন, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি, শিডিউল্ড কাস্ট ফাউন্ডেশন ২৭টি, গণতন্ত্রী দল ৩টি এবং ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি ১৩টি আসন লাভ করেছিল। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী একটি আসনে জয়ী হয়েছিলেন।
এসময় ১৯৫২ সালের ৩ থেকে ১১ অক্টোবর, চীনের পিকিং (বেইজিং)-এ অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব শান্তি সম্মেলন। চীন সরকারের আমন্ত্রণে এই শান্তি সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ওই সম্মেলনে আর একজন বক্তা বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে সবার নজর কেড়েছিলেন, তিনি হলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত লেখক মনোজ বসু।
১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী পালন প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক গাজীউল হক লিখেছেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি মিছিল শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে। ভোর বেলাতেই জনাব আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জমায়েত হয়েছিলেন। মিছিল শুরু হলো। মিছিলের সামনে জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব শেখ মুজিবুর রহমান, ইমাদুল্লাহ। কালো পতাকাটি কখনো আমি, কখনো বা আব্দুল ওয়াদুদ পাটোয়ারি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সকল স্তরের জনগণ ছিল আমাদের সঙ্গে। সারা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে মিছিল এসে জমায়েত হলো আর্মানিটোলা ময়দানে। ছাত্রদের প্রত্যেক দল থেকে একজন করে এ সভায় বক্তৃতা করেন। যুবলীগ থেকে জনাব ইমাদুল্লাহ এবং আওয়ামী লীগ থেকে বক্তব্য রাখেন জনাব শেখ মুজিবুর রহমান। সভায় ভাষা আন্দোলনের বন্দিসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দাবি করা হয়। শহীদদের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে মোনাজাত করা হয়।’
প্রধান ইস্যু রাষ্ট্রভাষা বাংলা
১৯৫৩ সালে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন আবার চাঙ্গা হতে থাকে। সেই সঙ্গে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের আর্থ- সামাজিক শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধেও জনগণ ক্ষুব্ধ হয়। শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে আবারও এগিয়ে আসেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের অসুস্থতার কারণে দলের পক্ষ থেকে সেই গুরুদায়িত্ব শেখ মুজিবের উপর অর্পণ করা হয়। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে শেখ মুজিব বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্রতী হন। তার রাজনীতির মূল বিষয়ই ছিল সাধারণ মানুষ, মানুষের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ। তাই খুব অল্প দিনের মধ্যেই শেখ মুজিব শুধু আওয়ামী লীগেরই নয়, সারা বাংলার একজন জনপ্রিয় নেতাতে পরিণত হন। এসময় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কৃষক শ্রমিক পার্টি নামে একটি দল গঠন করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলায় সশরীরে উপস্থিত হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন।
এসময়, পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। ফলে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর, ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলামকে নিয়ে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। রক্তস্নাত ২১ ফেব্রুয়ারিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য নির্বাচনী দাবি-দাওয়াকে ২১টি দফার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে যুক্তফ্রন্ট এবং প্রথম দফায় মায়ের ভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করে।
২১ দফার মধ্যে যা ছিল
১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা;
২. বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ ও সকল প্রকার মধ্যস্বত্বের বিলোপ সাধন, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বণ্টন; ভূমি রাজস্বকে ন্যায়ঙ্গতভাবে হ্রাস করা এবং সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল করা;
৩. পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, পাট উৎপাদনকারীদের পাটের ন্যায্য মূল্য প্রদানের ব্যবস্থা, মুসলিম লীগ আমলের পাট-কোলেঙ্কারির তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা;
৪. সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা; কুটির শিল্পের বিকাশ ও শ্রমজীবীদের অবস্থার উন্নয়ন সাধন করা;
৫. পূর্ব বাংলাকে লবণের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে কুটির ও বৃহৎ পর্যায়ে লবণ শিল্প প্রতিষ্ঠা করা;
৬. অবিলম্বে বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন করা;
৭. সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করা;
৮. পূর্ব বাংলাকে শিল্পায়িত করা এবং আই.এল.ও কনভেনশন অনুযায়ী শিল্প শ্রমিকদের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা;
৯. অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন ও শিক্ষকদের জন্য ন্যায্য বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা।
১০, সরকারী ও বেসরকারী বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিভেদ বিলোপ করে সমগ্র মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন করা এবং মাতৃভাষাকে মাধ্যম করা;
১১. বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত সকল প্রতিক্রিয়াশীল কলাকানুন বাতিল করে তাকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা;
১২. প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচ করা এবং উচ্চ ও নিম্ন বেতনভোগী সরকারী কর্মচারীদের বেতনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা; যুক্তফ্রন্টের কোন মন্ত্রী এক হাজারের বেশি বেতন গ্রহণ না করা;
১৩. দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ উচ্ছেদের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের পর থেকে সকল সরকারী কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী কর্তৃক অর্জিত সম্পত্তির হিসেব গ্রহণ করা এবং সকল অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা;
১৪. নিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স বলে আটককৃত সকল নিরাপত্তা বন্দীকে মুক্তিদান এবং সমিতি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা;
১৫. শাসন বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথক করা;
১৬. ‘বর্ধমান হাউস’ আপাতত ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগার করা;
১৭. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন তাদের পবিত্র স্মৃতিকে রক্ষা করার জন্য শহীদ মিনার নির্মাণ করা;
১৮. একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ঘোষণা ও তাকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালন করা;
১৯. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সব বিষয় পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে অর্পণ, সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে রেখে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব বাংলায় স্থানান্তর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে পূর্ব বাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য এখানে বস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং আনসার বাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ মিলিশিয়া হিসেবে গড়ে তোলা;
২০. যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোন অজুহাতেই আইনসভার আয়ু বৃদ্ধি করবে না; সাধারণ নির্বাচনের ছয় মাস পূর্ব মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
২১. আইনসভার কোন আসন শূন্য হবার তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচনের মাধ্যমে তা পূরণ করা হবে এবং যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীরা পরপর তিনটি উপনির্বাচনে পরাজিত হলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।
প্রথম নির্বাচনেই বঙ্গবন্ধুর বিজয়
এদিকে যুক্তফ্রন্টের একজন অন্যতম নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান এই ২১ দফা দাবি নিয়ে বাংলার একপ্রান্ত হতে অপর প্রান্ত চষে বেড়ান। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও ছুটির দিন ঘোষণা, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসহ ২১ দফার সমর্থনে তিনি বড় বড় জনসভায় যে গুরুত্বপূর্ণ ও জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন।
এই নির্বাচনে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগ প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামানকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে টুঙ্গিপাড়া এলাকা থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট একচেটিয়াভাবে জয় লাভ করে এবং মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে। ১৯৫৪ সালের এই নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩টি এবং কৃষক শ্রমিক পার্টি মাত্র ৪৮টি আসন পায়। এই মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান যোগদান করেন। তিনি কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন।
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পিতভাবে আদমজি জুট মিলে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়, এই দাঙ্গায় প্রায় পাঁচশ’ বাঙালি নিহত হন। এর সব দায়-দায়িত্ব যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৩০ মে ৯২ (ক) ধারা বলে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করে। একই দিনে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মীর্জাকে পূর্ব বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপরই যুক্তফ্রন্টের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে জেলখানায় ঢোকানো হয়। আওয়ামী লীগের প্রায় তিন হাজার কর্মী ও ৫৩ জন এমএলএ গ্রেফতার হন। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক হন গৃহবন্দি। এসময় মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী বিদেশে অবস্থান করছিলেন। ফলে একটি নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সেসময় পূর্ব বাংলায় কোনো প্রতিবাদ সভা বা বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়নি।
সারাবাংলা/এসবিডিই