পাহাড়ের বিজু উৎসব
ইতিহাস

পাহাড়ের বিজু উৎসব

নুকু চাকমা

বাংলা বছরের শেষ মাসটি হলো চৈত্রমাস। চৈত্র মাসটা এলেই পাহাড়ে জুড়ে এক ধরণের আনন্দ খেলা করে। পাহাড়ে ফোটে নানা রঙের সুগন্ধি ফুল। তাদের আবার একেকটার একেক ধরণের আবেদন রয়েছে। বিভিন্ন গানে, কবিতায়, নাটকে, পজ্জনে সেই সব ফুলের রোমান্টিক বর্ণনা আছে। যেমন: তুরিং ফুল’র ধুব রঙানি, রেবেক ফুলর তুমবাজ আনি। আবার চৈত্র মাসের আরেকটা ফুল নাকশা ফুল(নাগেশ্বর ফুল) এ ফুলের বর্ণনা পাওয়া যায় অমর প্রেমের কাহিনী রাধামন ধনপুদিতে। চৈত্র মাসের শেষ দু’দিন (১২ এবং ১৩ এপ্রিল) এবং বছরের প্রথমদিন(১৪ এপ্রিল) পাহাড়ে বর্ষবরণ উৎসব হয়।

বিজু মৌসুমের অন্যতম ফুল- কুরচি

এই উৎসব পাহাড়ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কাছে একেক নামে পরিচিত। চাকমাদের কাছে এটি বিজু উৎসব। মারমারা একে সাংগ্রাই বলে। ত্রিপুরাদের কাছে এটি বৈসুক এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে এটি বিষু নামে পরিচিত। আবার বৈসুক, সাংগ্রাই এবং বিজু তিন সম্প্রদায়ের উৎসবের অদ্যাক্ষর নিয়ে এই উৎসবটির সংক্ষিপ্ত নাম বৈসাবি। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিনকে চাকমারা ফুলবিজু বলে। ফুলবজিুর দিনে ফুল তুলে নদীতে পুজো দেওয়া হয়। মূলত: জীবনে পানির অবদানকে ম্বীকুতি জানাতে এটা করা হয়। এবং পানির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এই পুজো করা হয়। এছাড়াও পানির যত উৎস আছে সেখানেও ফুল এবং বাতি দেওয়া হয়। যেমন: কুয়া, ঝিরি, ঝরণা ইত্যাদিতে ।

পাহাড়ের বিজু উৎসবফুলবিজুর দিন ছড়াতে ফুল দিয়ে পুজো দেওয়া হয়েছে।

গ্রামে গবাদি পশুদের জন্য চাল,গম ভাত ছিটানো হয়। যাতে পশু পাখিরা সবাই খাবার পায়। আবার অন্যদিকে সুর্য ডোবার সাথে সাথে বিভিন্ন বড় গাছপালা, ঝিরি, ঝর্ণায় বাতি জা¦লানো হয়। প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য।

প্রকৃতি থেকে সারাবছর আমরা পানি পাই এবং প্রকৃতি থেকে জীবন ধারণ এর জন্য উপকরণ পাই তাই প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই এই আয়োজন। এই দিনে গ্রামের এবং পবিারের বয়োজ্যোষ্ঠদেরও স্নান করানো হয়। মূলত: আগের দিনে পানির উৎস দূরে থাকায় স্নানের এ আয়োজন করা হতো। ঐতিহ্য মেনে এবং আনুষ্ঠানিকতা করে এখনও এই রীতি পালন করা হচ্ছে।

ফুলবিজুর দিনে ফুল দিয়ে ঘর সাজানোও একটা ঐতিহ্য। সাথে থাকে নিমপাতা। প্রতিটি বাড়িকে পরিষ্কার পরিছন্ন করে ফুলবিজুর দিনে ঘর সাজানো হয়, বুদ্ধকে পুজো করা হয়। ফুলবিজুর দিন ভোরে উঠে স্নান করার একটা রীতি প্রচলিত আছে। বিশ্বাস যে আগে স্নান করবে সে আগে বিজুগুলো পাবে। আসলে এটি বিজুর মত একটি সামাজিক উৎসবে ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এরপর চৈত্রমাসের শেষদিনকে চাকমারা বিজু বলে। মূলবিজুর দিনে নানা ধরণের খাবারে আয়োজন করা হয়। এবং বাড়ি বাড়ি গিযে ন্যুনতম সাত বাড়ির পাজন খাওয়ার রীতি প্রচলন আছে। আসলে এটা সামাজিকতার শিক্ষা দেয়।

পাহাড়ের বিজু উৎসববিজুর দিনের খাবার: পাজন, জগরা আর তরমুজ।

বিজুর দিনের মূল খাবার হলো পাজন। পাজন হলো বহু সবজি এবং শাক মিশ্রিত একটা খাবার। এই পাজনে সর্বনিম্ন ২২ থেকে সর্বোচ্চ পদের সবজি মেশানো হয়। বিশ্বাস সারা বছর যেহেতু বিভিন্ন পদের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাই বছরের শেষদিন বিজুতে এসব তিতা, মিঠা খাবার খেয়ে শরীরে গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করা।

বিজুর দিনে পাজনে দেওয়ার জন্য আগের দিন’ই আম, কাঁঠাল পেরে রাখা হয়। এবং চাকমারা আম নিয়ে একটা ব্রত মানে সেটা হলো বিজুর আগে আম না খাওয়া। আসলে এর পেছেনে মূলত: দু’টো কারণ জড়িত। ১. সাধারণত বিজুর আগে আম বড় হয় না/খাওয়ার উপযোগী হয় না। ২. বিজুর দিন পাজনে আম মিশিয়ে রান্না করা হয় এবং তা প্রথমে সাধারণত বুদ্ধকে দেওয়া হয় এবং বয়োজ্যোষ্ঠদের দেওয়া হয়। তাই বিজুর আগে আম না খাওয়ার ব্রত মানে। গাছের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এর জন্য বিজুর দিন কোন ধরণের আম, কাঁঠাল পারা হয় না। ফুলবিজু দিনের মতই বিজুর দিনও সবুজ গাছের নীচে বাতি জ্বালিয়ে গাছের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এবং পরের দিন নুও বজর। অর্থ্যাৎ নতুন বছর। চাকমারা এ দিনকে চাকমা ভাষায় গজ্জ্যেপজ্জ্যে দিন বলে। অর্থ্যাৎ অবসরের দিন এবং সেইসাথে নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার দিনও।

চাকমাদের কাছে এই দিনটির আলাদা একটা তাৎপর্য আছে। এদিনটি নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার দিন। চাকমাদের মধ্যে একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে- নতুন বছরে যা যা ভালো কাজ করবে সারাবছর সে সেইসব ভালো কাজেই থাকবে। তাই প্রতিটি চাকমা চায় এদিন ভালো কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে। এদিন তারা কোন ধরণের সহিংসতায় লিপ্ত হয় না। যেমন: ছোট বাচ্ছাদের মারধোর করে না। গৃহস্থরা ভোরে উঠে রান্নাবান্না করে এবং বিহারে পিন্ড দান করে। চাকমারা বিশ্বাস করে এদিন সারাদিন পূণ্যকাজে লিপ্ত থাকলে সারাবছর পূণ্যে/ভালো কাজে দিন কাটবে। গুরুজনদেরকে বাড়িতে এনে খাওয়ানো হয়। আগামী বছর হয়তো তারা বেঁচে নাও থাকতে পারেন তাই তাদেরকে বাড়িতে ডেকে খাওয়ানো হয়। এবং ফুলবিজু, মূলবিজু এর মতই নতুন বছরেও সবুজ গাছের নীচে আর পানির উৎসে বাতি দেওয়া হয়। আর একদিন পরেই পাহাড়ে বিজু উৎসব শুরু। সবার প্রাণে বিজুর আনন্দ ছুঁয়ে যাক। বিজুর তাৎপয্য সবাইকে উজ্জীবিত করুক।।

লেখক: নারী অধিকার এবং উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এএসজি

Source link

Related posts

ভাটির কিংবদন্তি বাউলসম্রাট আবদুল করিম

News Desk

দিল্লির দরবারে ব্রিটিশরাজ

News Desk

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উড়ানো হয়েছিল যেদিন

News Desk

Leave a Comment