Image default
ইতিহাস

ফয়েজ লেক গণহত্যা: চোখের সামনে বীভৎস নারকীয়তা!

ফিচার ডেস্ক

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস। দিনটি ছিল পবিত্র রমজান মাসের ২০ তারিখ। সেহরি শেষ করে আকবর শাহ জামে মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করে ভোর সাড়ে ৫টায় মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলেন মুসুল্লিরা। হঠাৎ একজন অবাঙালি অর্থাৎ বিহারি এসে রেলওয়ে কর্মকর্তা এ কে এম আফছাব উদ্দীনের কাছে এসে অভিযোগ করল যে বাঙালিরা নাকি বিহারিদের মেরে ফেলছে, মেরে মসজিদের পূর্বদিকে পাহাড়ের কিনারে সমতল জায়গায় ফেলে রাখছে। শুনে আফছাব আরও কয়েকজনকে নিয়ে দ্রুত অকুস্থলে গেলেন। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী রাস্তা পেরিয়ে তিনি যখন খোলা জায়গায় পৌঁছালেন, সেখানে কোনো বিহারির লাশ না দেখতে পেলেও চারপাশের অবস্থা যা দেখলেন, তাতে তার গলা শুকিয়ে এলো। অগণিত বিহারিরা বন্দুক ও নানা রকমের ধারালো অস্ত্র নিয়ে শোরগোল দিচ্ছে, তাদের স্লোগানের মধ্যে “খতম করো” শব্দটা বারবার শোনা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন তারা কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। পাহাড়তলীর রেলওয়ে কলোনির মানুষগুলোর কল্পনাও করতে পারেননি কি ভয়াবহ বিভীষিকার মুখোমুখি হবেন তারা কিছুক্ষণ পরেই।

অস্ত্রধারী বিহারিদের মধ্যে অন্যতম ছিল মো. আকবর খান। সে পাহাড়তলী লোকোশেডের একজন বয়লার মেকার। সে তখন পাহাড়তলী ডি এস অফিসে মোহাম্মদ ইসরাইল (ডিভিশন পারসোনাল অফিসার) এবং গোলাম ইউসুফের (ডিভিশনাল সুপারিন্টেডেন্ট) দেহরক্ষী হিসেবে অফিসে বন্দুক হাতে পাহাড়া দিত এবং বাঙালিদের নিয়মিত ভয় দেখাত। কোনো লোক অফিসের দরজায় গেলে তাড়া করত। এছাড়াও ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ইউসুফ, পাহাড়তলী রেলওয়ে অফিসের ড্রইং সেকশনের অফিসার ইফতিখার উদ্দিন, জিয়াউল হক এবং রিটায়ার্ড অফিস সুপারিন্টেনডেন্ট হামিদ হোসেনও উপস্থিত ছিল, এরা সকলেই বিহারী এবং সকলের হাতেই চাপাতি-রামদাসহ ধারালো অস্ত্র। দূর থেকেই আফছাব উদ্দিনসহ বাঙ্গালী কর্মকর্তাদের দেখে আকবর অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে বলল, “ইহাঁছে ভাগো সালে বাঙ্গাল লোক”!

কিন্তু তার এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই পাশ থেকে কেউ বলে উঠল, “ভাগনে মাত দেও ইস লোগকো, খাতাম কারো”! শুনে দ্রুত পায়ে আফছাব বাকিদের নিয়ে ফিরে এলেন এবং আশেপাশের কলোনির বাড়িগুলোতে চিৎকার করে সতর্ক করলেন যে বিহারিরা আসছে। তার সঙ্গে থাকা রেলওয়ে কর্মকর্তা আকবর হোসেন তার স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে দ্রুত পায়ে নিজের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। তার বাসার একেবারেই সামনে রাস্তায় হঠাৎ তাকে কয়েকজন বিহারি ঘিরে ধরল। বাঁচার জন্য দৌড়ে পালাতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত পারেননি আকবর হোসেন। তাকে ধাওয়া করে সেই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সমতল রাস্তার দিকে নিয়ে যায় তারা। সেখানেই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। স্ত্রী-সন্তানদের শেষবারের মত দেখার সুযোগ পেলেন না তিনি।

কিন্তু আবদুল গোফরানকে দেখতে হয়েছিল আরও ভয়াবহ বীভৎসতা। আকবর শাহ মসজিদের পাশেই গোফরানের একটি দোকান ছিল, সেদিন সকাল ৬টায় তাকে সেই দোকান থেকেই তুলে নিয়ে যায় বিহারীরা। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে ভাগ্যের হাতেই নিজেকে সমপর্ণ করেছিলেন গোফরান, কিন্তু নিয়তির হিসেব ছিল অন্যকিছু। ফয়েজ লেকের রাস্তা দিয়ে গোফরানকে যখন পূর্বদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি লেকের গেট পেরোবার পর পাম্প হাউজের আশেপাশে ও ওয়্যারলেস কলোনির রাস্তার উপর ভিড় করে উল্লাস করতে দেখেন কয়েকশ বিহারিকে। একটু পরেই উল্লাসের কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাম হাউজের সামান্য উত্তরদিকে উঁচু জায়গায় পাশে যে ঝিলটা আছে, সেখান অসংখ্য বাঙ্গালীকে ইতোমধ্যে ধরে এনে হাত পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন বিহারী জল্লাদের হাতে খোলা তলোয়ার ও রামদা। গোফরান দেখলেন ৫-৬ জন করে বাঙ্গালীকে ওরা প্রচন্ড মারধোর করে ঠেলে দিচ্ছে জল্লাদদের সামনে, জল্লাদেরা মহাউল্লাসে তলোয়ার দিয়ে এক কোপে তাদের মাথা কেটে ফেলছে। রীতিমত নরবলিদানের মহোৎসব!

এভাবে বেশ কয়েকটা দল যখন জবাই হলো, গোফরান নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন। তার গায়ে একটা দামী উলের জাম্পার ছিল, এক অবাঙালি ছেলের সেটা চোখে পড়তেই সে এসে সেটা খুলে নিল। আরেকজন এসে হাত চেপে ধরতে তার দিকে ঘুষি বাগিয়ে তুলতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটা সুযোগ পেয়ে আর কিছু না ভেবে তিনি বিহারি ছেলেটাকে পাল্টা ঘুষি মেরে পাশের ঝিলের পানিতে লাফিয়ে পড়েন। এক ডুবে সাঁতরে তিনি ঝিলের ওপারে গিয়ে ওঠেন, এদিকে জল্লাদের সহযোগী বিহারী ছেলেগুলো নিশ্চিত শিকার ফসকে যাওয়ার ক্ষোভে পানিতে এবং এপারে একটানা পাথর ছুঁড়ে মারছে। একপর্যায়ে তাদের কয়েকজন পানিতে নেমে গেল এপারে এসে গোফরানকে ধরতে। তাদের নামতে দেখে গোফরান এপারের কাঁটাবন ও ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে মড়ার মত পড়ে থাকেন যেন তারা টের না পায়। বিহারি হায়েনাগুলো তাকে এপারে এসে অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ফিরে যায়। কপাল গুণে বেঁচে যাওয়া গোফরান এপারে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত চোখে দেখতে থাকেন এক বীভৎস বিভীষিকা।

বাঙালিদের প্রতি দলে ৫-৬ জন করে ছিল। তাদের হাত-পা বেঁধে উঁচু ঢিবির উপর দাঁড় করানো হয়। প্রচণ্ড মারধর করে আধমরা করে এরপর ধাক্কা দিয়ে তলোয়ার হাতে অপেক্ষমান জল্লাদদের দিকে ঠেলে দেয়। জল্লাদেরা পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে ও মাথা কেটে লাথি মেরে ঝিলের উপর ও এদিক-ওদিক ফেলে দিতে থাকে। আবার কিছু মৃতদেহ কয়েক টুকরা করে পূর্ব দিকের পাহাড়ের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে ওরা। ভোর থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত এইভাবে একের পর এক চলতে থাকে নির্বিচারে নিরীহ নিরপরাধ বাঙালিদের নিধন। কত মানুষকে সেদিন এভাবে জবাই করে টুকরা করেছিল বিহারিরা, সেটা আর গুণে হিসেব রাখতে পারেননি গোফরান। দুপুর দুইটার দিকে কোথা থেকে ১০-১২ জনকে ধরে নিয়ে এলো বিহারিরা। দেখে মনে হলো আশেপাশের লাশগুলো পুঁতে ফেলতে গর্ত খোঁড়ার জন্য তাদের ধরে এনেছে। তারা হাতজোড় করে সম্ভবত প্রাণে না মারার অনুরোধ জানাচ্ছিল। গোফরানের দেখে মনে হলো বিহারিরা তাদের আশ্বাস দিচ্ছে যে তাদের মারা হবে না।

গর্ত খোড়া শেষে একে একে আশপাশ থেকে হতভাগ্য বাঙালিদের লাশ তুলে এনে সেই গর্তে ফেলতে লাগল গোরখোদকেরা। তারপরেই সেই গোরখোদকদের পেছন থেকে কুপিয়ে এবং গুলি করে সেই গর্তে ফেলে দেওয়া হলো। কয়েকজন বেঁচে ছিল তখনও, তাদের আকুতিমিনতি বিফলে গেল। চারপাশে যখন আর কোনো বাঙালি বেঁচে নেই তখন বিহারীরা আনন্দে হৈ হৈ করতে করতে ফিরে গেল। কিছুক্ষণ পর থেকেই ধীরে ধীরে শকুনের পাল এবং কুকুরের দল এসে জুটতে লাগলো সেখানে। তখনও অনেক লাশ এবং লাশের খণ্ডিত অংশ পাহাড় এবং ঝিলের আশেপাশে পড়ে আছে। তাতে এবার এদের ভুরিভোজের ব্যবস্থা হবে।

সারাদিন ধরে চোখের সামনে এই ভয়াবহ নির্মমতম ম্যাসাকার দেখতে দেখতে ক্লান্ত গোফরান অবশেষে সন্ধ্যা হওয়ার পর খুব সাবধানে ঝিল পার হয়ে লুকিয়ে বেরিয়ে যান সেই বধ্যভূমি থেকে। রেলওয়ে কর্মকর্তা আফছাব পরে গোফরানের কাছ থেকে বর্ণনা শুনে এসে দেখেন ঝিলের আশেপাশে উঁচু ভিটার উপরে এবং নীচে অসংখ্য দ্বিখন্ডিত লাশ এবং লাশের টুকরো, মাথা, হা-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এক জায়গায় গর্তের মধ্যে লাশগুলোর মাথা কোনোরকমে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। পা এবং পুরো শরীর বেরিয়ে ঝুলে আছে বাইরের দিকে। আরেক গর্ত ভর্তি কেবলই মানুষের কাটা মাথা। শত শত চোখ মেলে থাকা রক্তাক্ত মাথা।

কিন্তু আফছাবের জন্য বিভীষিকা সেখানেই শেষ হয়নি। পরদিন স্থানীয় কয়েকজনের দেওয়া সংবাদে ফয়েজ লেকের বিপরীত দিকের পাহাড়ে অনেক লাশ পড়ে থাকার সংবাদ শুনে আরও কয়েকজনকে নিয়ে আফছাব পাহাড়ে গেলেন। গিয়ে তিনি যা দেখলেন, সেটা বর্ণনাতীত। অজস্র নারীর লাশ, সবই বিবস্ত্র। বেশিরভাগ নারীর পেট ফোলা, পচন ধরেছে ইতোমধ্যে। মৃতদেহগুলো স্তুপ করে রাখা হয়েছে, একেক স্তুপে ১০-১৫টি করে লাশ, এমন স্তুপ অগণিত। পেট দুভাগ করা, ভেতরে মানবশিশুর আকার, পচন ধরেছে। দেখে মনে হলো বড় ছুরি বা তলোয়ার দিয়ে আড়াআড়িভাবে পেট কেটে এই হতভাগ্য নারীদের মারা হয়েছে। তারা ১০৮২টি মরদেহ পর্যন্ত গুণতে পারলেন। এরা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যাওয়া হাজার হাজার নারীদের একাংশ, যাদের দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখে চরমতম পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে পেটে বাচ্চা আসায় এখন তুলে এনে এখানে মেরে ফেলে গেছে পাকিস্তানীরা। বিহারি অধ্যুষিত ওয়্যারলেস এবং ফিরোজ শাহ কলোনির বাসিন্দাদের সহযোগিতায় এই লাশগুলো এই দুর্গম পাহাড়ে এনে ফেলা হয়েছে, যেন কেউ জানতে না পারে।

আজ সেই বধ্যভূমি, হাজারো শহীদের রক্তে ভেজা পাহাড়, সেই ফয়েজ লেক নিপাট বিনোদন কেন্দ্র। শহীদের চাপা পড়ে যাওয়া আর্তনাদ এতো বছর পর আর কেইই বা মনে রাখে!

ভুক্তভোগী প্রত্যক্ষদর্শী:

১. আবদুল গোফরান
ব্যবসায়ী, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম

২. এ কে এম আফছাব উদ্দিন
প্রাক্তন রেলওয়ে কর্মকর্তা, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম

সারাবাংলা/এসএসএ

Source link

Related posts

বাংলার বীরাঙ্গনা ‘রায়বাঘিনী’ ভবশঙ্করী রায়

News Desk

নূর ইনায়াত খান: রাজকন্যা থেকে দুঃসাহসী এক গোয়েন্দা গুপ্তচর

News Desk

বঙ্গবন্ধুর জীবনের ধারাপাত

News Desk

Leave a Comment