‘ত্রিপুরা’ বাংলাদেশের একটি অন্যতম আদিবাসী জাতি। ত্রিপুরা জাতি ৩৬টি গোত্রে বিভক্ত। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এ জাতির বসবাস দেখা যায়।বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, ফরিদপুর, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।ভারতের ‘ত্রিপুরা’ ও ‘মিজোরাম’ রাজ্যে ত্রিপুরাদের বসতি রয়েছে। বার্মাতেও ত্রিপুরাদের বসতি আছে বলে জানা যায়। এ জাতির ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ।‘ত্রিপুরাব্দ’ নামে এ জাতির নিজস্ব এক অব্দও প্রচলিত আছে যা বঙ্গাব্দ থেকে ৩ বছরের প্রাচীন।
ভাষা :
ত্রিপুরা জাতির ভাষার নাম ককবরক। ‘কক’ মানে ‘ভাষা’। ‘বরক’ মানে ‘মানুষ’। ‘ককবরক’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘মানুষের ভাষা’ চীন পরিবারের তিব্বতী-বর্মী উপ-পরিবারের ভাষা। এ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। ককবরক ভাষায় দু’ধরনের লিপিতে লেখার প্রচলন রয়েছে- রোমান ও বাংলা। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ ত্রিপুরা ককবরক ভাষায় কথা বলে। মধ্যযুগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী-শাষিত পূর্ববঙ্গের এক বিশাল এলাকায় ককবরক প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে ত্রিপুরাদের অবস্থান তৃতীয়। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে এদের জনসংখ্যা ৭৯ হাজার ৭৭২ জন। টিপরা ও ত্রিপুরা একই জনগোষ্ঠী। ত্রিপুরা জাতি মোট ৩৬টি দফায় বা গোত্রে বিভক্ত। বাংলাদেশে ১৬টি গোত্রের সন্ধান পাওয়া যায় যাদের মধ্যে উপভাষা-ভেদ রয়েছে। অনেক আগে থেকেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরক ভাষা বাংলা হরফে লিখিত হয়ে আসছে। ককবরকের ব্যাকরণ অনেক পুরনো। প্রায় একশ বছর আগে এই ব্যাকরণ রচিত হয়েছে। আর সকলের মতো ত্রিপুরাদেরও রয়েছে তাদের মাতৃভাষা ককবরকের প্রতি অনুরাগ। একটি ককবরক কবিতায় ধরা পড়েছে মাতৃভাষার প্রতি কবির অকৃত্রিম দরদ, ‘ককবরক অংখা, চিনি আমানি কক্/ ছুঁ ককনৗ হামজাকাদি, অৗ বরকরক।…/ জৗতনি খানাতক আমানি কক্/ মানৗ কসল হামজাকদি নক।’ অর্থাৎ, ‘ককবরক মোদের প্রিয় মাতৃভাষা,/ এ ভাষাকে ভালবেসো হে জনগণ।…/ সবার সেরা মোদের প্রিয় মাতৃভাষা,/ সকলেই ভালবেসো মায়ের মতন।’ককবরক ভাষাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করার আকুতিও রয়েছে ত্রিপুরাদের মনে।
ভাষার যেসব দিকের প্রতি এখনো বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়নি, সেদিকে লক্ষ্য করে একজন ত্রিপুরা কবি ‘ত্রিপুরাগণ’-এর প্রতি আবেদন রাখছেন: ‘কক বরক বাই বিসিনি সালতালনৗ,/ সিনানি নাইদি তিপ্র জাতিনি ককনৗ/ রাচাদি, চিঠি সুইদি ইঁ কক বাই নক/ আইক্যাং খালাইদি অৗ তিপ্রারক।’ এর অর্থ, ‘ত্রিপুরাদের দিন, মাস তারিখ গণনা,/ ত্রিপুরা ভাষায় কী তা কেউ জানে না/ গান গেয়ো, চিঠি লেখো, দিয়ে মাতৃভাষা,/অভ্যাস করতে থেকো ওহে ত্রিপুরাগণ। টিপ্রা কথাটি এসেছে ত্রিপুরা শব্দটি থেকে। বিষ্ণুপুরাণে কিরাত ভূমির উল্লেখ পাওয়া যায়। ত্রিপুরা নামে এক ব্যক্তি ওই কিরাতভূমিতে রাজত্ব করতেন। তার নামানুসারেই ত্রিপুরারাজ্যের নামকরণ হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। ত্রিপুরা ভাষায় টুই অর্থ পানি এবং প্রা অর্থ আধিপত্য। পার্বত্য ত্রিপুরা পূর্বে ছিল পানিদ্বারা বেষ্টিত। এখানে যারা আধিপত্য করত তাদের বলা হতো টুইপ্রা। গবেষকরা মনে করেন, এই টুইপ্রা শব্দটিই কালক্রমে রূপান্তরিত হয়ে টিপ্রা হয়েছে। বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে ত্রিপুরাদের বসবাস রয়েছে। এদের ৩৬টি গোত্রের মধ্যে এ দেশে বসবাস করছে চৌদ্দটির মতো গোত্র। যেমন: দেনদাউ, গাবিঙ, খালি, নাইতুঙ, ফাদুঙ, হারবাঙ, পুরাণ, কেওয়া, ওসই, কেমা, রিয়াং, মাইপালা, আসলং, নবতিয়া।
বিয়ে :
ত্রিপুরা সমাজে পিতার পরিচয়েই সাধারণ সন্তানের বংশ পরিচয় নির্ধারিত হয়। তবে কোনো কোনো গোত্রে মেয়ে সন্তানরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিত হয়। এদের একই গোত্রে বিয়ে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। গোত্র মিলিয়ে তারা বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকে। যেমন : পুরাণ গোত্রের সঙ্গে রিয়াং, রিয়াং গোত্রের সঙ্গে নবতিয়া, নবতিয়া গোত্রের সঙ্গে ওসই, ওসই গোত্রের সঙ্গে পুরাণ, ওসই গোত্রের সঙ্গে নবতিয়া, পুরাণ গোত্রের সঙ্গে নবতিয়া, রিয়াং গোত্রের সঙ্গে পুরাণ, ওসই গোত্রের সঙ্গে রিয়াং। যেসব সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ত্রিপুরা বিয়ে নিষিদ্ধ থাকে সেগুলো হচ্ছে- ১. আপন ভাইবোন; ২. আপন খালা, চাচা-চাচি, মামা-মামি; ৩. আপন খালাতো ভাইবোন, চাচাতো ভাইবোন, মামাতো ভাই বোন এবং ৪. সৎ মা, সৎ ভাইবোন ইত্যাদি।
ত্রিপুরা আদিবাসী সমাজে সাধারণত দু’ধরনের বিয়ে রীতির প্রচলন রয়েছে। যেমন- হিকনানানী বা গন্ধর্ব বিয়ে এবং কাইজগন্নী বা প্রাজাপত্য বিয়ে। এছাড়া এদের গোত্রভেদে বিভিন্ন বিয়ে আচারের প্রচলন রয়েছে।বর-কনে পরস্পরকে ভালোবেসে পছন্দ করে যে বিয়ে করে তাকে হিকনানানী বা গন্ধর্ব বিয়ে বলা হয়। এই বিয়েতে কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতা বা উৎসবের প্রয়োজন হয় না। পরস্পরকে স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে গ্রহণই একমাত্র আনুষ্ঠানিকতা। তবে বিয়েতে অনেক সময় অভিভাবকদের অনুমতি থাকে না। বিয়ের পর নবদম্পতিকে সমাজে ফিরতে হলে গ্রাম প্রধানের অনুমতি নিয়ে একটি ভোজের আয়োজন করতে হয়। তবে সকলের জন্য এই ভোজের বাধ্যবাধকতা নেই।
আবার পারিবারিকভাবে অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী পাত্রপাত্রী নির্বাচনপূর্বক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নানা রকম সামাজিক অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে কাইজগন্নী বা প্রাজাপত্য বিয়ে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। আদিতে অভিভাবকের মাধ্যমে বর-কনে ঠিক হয়ে গেলে নির্দিষ্ট একটি দিনে বরের কয়েকজন বন্ধু বরকে দুবোতল মদ ও কিছু পান-সুপারিসহ শ্বশুড়বাড়িতে রেখে আসত। ওখানে বর দু’বছরের জন্য শ্বশুর পরিবারের সদস্য হিসেবেই থেকে যেত। এ সময় তাকে জমিতে কাজকর্ম করে প্রমাণ করতে হতো ভবিষ্যতে সংসারজীবনে সে সমর্থ কি না! শ্বশুরবাড়ি থাকাকালীন তারা স্বামী-স্ত্রীরূপে থাকার অধিকার পেত। কিন্তু বর্তমানে ত্রিপুরা সমাজে এ বিয়ে প্রথার প্রচলন একেবারেই দেখা যায় না।বর যদি কনে পক্ষের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে কনের বাড়িতেই বিয়ে সম্পন্ন করে এবং ঘরজামাই হিসেবে শ্বশুড়বাড়িতে বসবাস করে তবে ওই বিয়েকে কাইজালাই কুসুর বিয়ে বলে। আবার কোনো কনে বিয়েতে রাজি না হলেও জোরপূর্বক তাকে তুলে এনে তিনজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে যে বিয়ে সম্পন্ন হয়, সেটিও কাইজালাই কুসুর বিয়ে। তবে আধুনিক ত্রিপুরা সমাজে এ ধরনের বিয়েরও এখন তেমন প্রচলন নেই। ত্রিপুরা সমাজে বিয়ে রীতিতে ঘটকের মাধ্যমে প্রাথমিক আলোচনা করা হয়। এরপর বরপক্ষকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেয়ার জন্য দু’বোতল মদ, এক জোড়া নারকেল, এক পণ সুপারি, দুই বিড়া পান সঙ্গে নিয়ে কনের বাড়ি যেতে হয়। কনে পাড়ার মুরুব্বীদের জন্যও এক বোতল মদ সম্মানী হিসেবে নেয়া হয়। কিন্তু এ সময় বরপক্ষ সরাসরি কোনো বিয়ের প্রস্তাব তুলে না। কনেপক্ষও সরাসরি সম্মতি বা অসম্মতি প্রকাশ করে না। সব কথাই হয় রূপক অর্থে।
বরপক্ষের প্রস্তাবে মেয়ের বাবা সম্মতি প্রকাশ করলে বরপক্ষকে দ্বিতীয়বার আরো বেশি পরিমাণ মদ ও উপহার নিয়ে কনেপক্ষের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। ওইদিন বিয়ের দিনক্ষণ ও পণ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও সব বিষয়ে আলোচনা করে নেয় ত্রিপুরা আদিবাসীরা। বিয়ের দিন কনে বাড়ি যাত্রার আগে কাথারক দেবতার পূজা ও ভোগ দেয় এরা। এ পূজার আচার হিসেবে বরের বাড়ির উঠানে বাঁশের বেদী সাজিয়ে সেখানে একটি মোরগ ও একটি মুরগি বলি দিয়ে দেবতার আশীর্বাদ নিয়ে যাত্রা শুরু করা হয়। কনে বাড়িতে পৌঁছানোর পর কনেপক্ষের যুবতী ও কিশোরীরা মাথায় বোতল ও প্রদীপ জ্বেলে ভরা কলসির ওপর থালায় দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিমায় কাথারক নৃত্য পরিবেশন করে। অতঃপর একটি কুলায় ঘট বসিয়ে তাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে হাত পাখার বাতাস দিতে দিতে কনের বাবা-মা বরযাত্রীদের বরণ করে ঘরে তোলেন। অতঃপর কনের জন্য আনা বিয়ের কাপড় ও জিনিসপত্র সবার সামনে খোলা হয় এবং সবার আশীর্বাদ নেয়া হয়। বিয়েতে কনের বাড়ি ও দরজার দুই পাশে দুটি কলাগাছ পুঁতে দুটি ঘটে আমপাতা ও সিঁদুর এবং নানা রঙের কাগজের ঝালর কেটে সাজানো হয়। একইভাবে সাজানো হয় গেট ও মণ্ডপ। এরপর বিয়ের বেদীতে বসানো হয় বরকনেকে। কনে বসে বরের বামদিকে। বিয়ের কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব থাকে একজন বিশুদ্ধ নারীর। যিনি বিয়ের আগে বিশুদ্ধ যুবতী ছিলেন এবং বিয়ের পর বিধবা হননি। এ ছাড়া বিয়েতে দুজন বালককে বরের সঙ্গে এবং দু‘জন বালিকাকে কনের পাশে বসানো হয়। তাদের সামনে রাখা হয় আমপাতায় সিঁদুর দেয়া জলভরা ঘট, কিছু চাল ও কার্পাস তুলা, অচাই বা পুরোহিতের জন্য এক বোতল মদ। একটি পাত্রে থাকে ভাতের দলা ও রান্না করা দু’টি মুরগির রান। এ ছাড়া বর-কনের সামনে দুটি বাঁশের চোঙায় একটিতে পানি ও অপরটিতে মদ রাখা হয়।
প্রথমে বরকনেকে একটি চাদরে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুরোহিত লামপ্রা দেবতার উদ্দেশে মোরগ ও হাঁস বলি দিয়ে শুরু করেন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। এরপর তিনি চাল ও তুলা হাতে চোঙা থেকে সামান্য পানি নিয়ে চন্দ্র, সূর্য, গঙ্গা ও বসুমতিকে স্মরণ করে সবাইকে সাক্ষী রেখে সাত পাক ঘুরিয়ে পানি, চাল ও তুলা বর-কনের মাথার ওপর ছিটিয়ে দেন। ত্রিপুরারা বিশ্বাস করে বর-কনের বিয়েতে যদি কোনো বাধা-বিপত্তি থাকে তবে ওই আচারের মাধ্যমে তা দূর হয়ে যায়। অতঃপর বরের কোলে কনেকে বসানো হয়। পুরোহিত তখন উভয়ের দীর্ঘায়ু ও সুখী হওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার পানি, চাল ও তুলা তাদের মাথায় ছিটিয়ে দেন এবং পিতামাতার নাম উল্লেখ করে বরকনের দু’দিকের চাদরের কোণা একত্রে বেঁধে দেন। তখন উপস্থিত প্রবীণদের মধ্য থেকে তিন বা সাতজন চাল ও তুলা হাতে তাদের আশীর্বাদ করলেই বিয়ের আনুষ্ঠানিক কাজ সমাপ্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গেই বরকে কনের কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুর দিতে হয়। অতঃপর কনে মদের অর্ধেক পান করার পর বাকি অর্ধেক বরকে পান করিয়ে দেয়। আনুষ্ঠানিকতা শেষে নব দম্পতি সবার সামনে তাদের ভোজন পর্ব শেষ করে এবং সবার আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। এ পর্বটিকে ত্রিপুরারা যাগ সংগীই মাই চানাই বলে থাকে।
ধর্ম :
ধর্ম বিশ্বাসে ত্রিপুরা জাতি সনাতন ধর্মের অনুসারী। মধ্যযুগে একমাত্র ত্রিপুরা রাজ্যটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যায়িত ছিল। বর্তমানকালে ত্রিপুরীদের অনেকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে।ত্রিপুরীরা ৩৬টি দফা বা গোত্রে বিভক্ত। এগুলি হলো: গুরপাই, রিয়াং, খালি, জমাতিয়া, নাইতং, কেওয়া, কেমা, দেনদাক, গাবিং, আসলং, তংপাই, আনোক, ফাতং, গর্জং, খাকুলু, কলই, মোকছাক, মুইচিং, উসুই, গাইগ্রা, বেরী, রুক্কিনী, মলসম, হারবাং, রংচের, বঙ, জানতং, চরই, দাম্পা, মংবাই, হালাম, কলি, মুরাসিং, মাখ্রা এবং মাইপালা।ত্রিপুরীদের বর্ষপঞ্জিকার নাম ত্রিপুরাব্দ। সংক্ষেপে লেখা হয় ‘ত্রিং’। ত্রিপুরাব্দ বর্ষপঞ্জিকা বঙ্গাব্দ থেকে ৩ বছরের প্রাচীন ও মগাব্দ থেকে ৪৮ বছরের প্রাচীন। তবে খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৯০ বছরের কনিষ্ঠ। ত্রিপুরাব্দ বর্ষপঞ্জিকা ৫৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে প্রচলিত ছিল। এখনও ত্রিপুরী জনজীবনে এ পঞ্জিকার প্রচলন রয়েছে। ত্রিপুরাব্দ সৌরবর্ষ ভিত্তিক পঞ্জিকা। রাজমালা গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, ত্রিপুরা মহারাজা বীররাজ হামতর ফা ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ জয় করেন।
ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা:
ত্রিপুরাদের আউটদূর খেলাধুলার মধ্যে অন্যতম হলো সুকই, গুদু, চু বা চুর, ওয়াসৌলাই, পর খেলা, হাতিতি, ওযাক-মৌসা, ওয়াংদে ইত্যাদি এবং ইনডোর খেলাধুলার মধ্যে তকঃ, চেচঙ, পাইং, খগ্রি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
খাদ্য :
ত্রিপুরাদের প্রধান খাদ্য ভাত। প্রতিবেলায় ভাতের সঙ্গে থাকে সেদ্ধ সবজি, মরিচ ও ভুট্টা। তাদের শাক-সবজি সিদ্ধ মানেই এই মরিচ ও ভুট্টার উপস্থিতি। তারা বাঁসকোড়লকে চাখৈ, মৈতুরু, বাংসোং, কেসক, লাকসু, বাজি প্রভৃতি বিভিন্ন উপায়ে খেয়ে থাকে। সবজি হিসেবে ঢেড়স, কলাগাছ, মাসরুম ঝিঙ্গা, হলুদ ফুল, আদা ফুলকে তারা সিদ্ধ এবং গুদাক (বিশেষ এক প্রক্রিয়া) করে খায়। ত্রিপুরারা মাছকে রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়ে খেতে পছন্দ করে। তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘বৈসুক’ উত্সবে মাংস রান্নার প্রচলন রয়েছে। ত্রিপুরাদের মাংস রান্নাকে সুস্বাদু করতে একরকম বিশেষ সুগন্ধি পাতা ‘বানা’ দেয়া হয়। এছাড়া এদিন মহিলারা বিন্নি চালের পিঠা ও চোলাই মদ তৈরি করে। বৈসুকে পিঠা বেশ প্রসিদ্ধ। বিন্নিচাল, কলাপাতা এবং লাইরু পাতা দিয়ে তারা পিঠা তৈরি করে থাকে। অতিথি আপ্যায়নে ত্রিপুরাদের রয়েছে বিশেষ সুপরিচিতি।
সামাজিক উৎসব:
ত্রিপুরাদের প্রধান সামাজিক উৎসবের নাম ‘বৈসু’। ত্রিপুরারা তিনদিন ধরে এই উৎসব উদযাপন করে থাকে।এগুলো হল – ১) হারি বৈসু, ২) বৈসুমা ও ৩) বিসিকাতাল। পুরনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বাগত জানানোকে কেন্দ্র করে এ ঐতিহ্যবাহী উৎসব উদযাপন করা হয়ে থাকে।এই তিন দিনে বিন্নি চাল দিয়ে নানান ধরনের পিঠা তৈরি করা হয়। নারী পুরুষেরা নূতন নূতন কাপড়-চোপড় পরিধান করে আনন্দে মেতে উঠে।এদিনে গান বাজনা হয়, খেলাধুলা হয়। বৈসু উপলক্ষে ৫/৭ দিন গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করা হয়। দল বেঁধে গড়িয়া দল গ্রামে গ্রামে ঘুরে গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করে।বৈসুমার দিনে ধনী-গরিব সবাই সামর্থ্যনুযায়ী নানা ধরনের পিঠা, মদ, সরবত, পাঁচন ইত্যাদি অতিথিদের পরিবেশন করে। তবে ‘বৈসুমা’র দিনে প্রানীবধ একেবারেই নিষিদ্ধ।‘বৈসুমা’র দিনে ও গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করা হয়। গড়িয়া নৃত্য ছাড়াও পালা গান ও বিভিন্ন খেলাধুলা সারাদিন ধরে চলে। বিসিকাতাল দিনে নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়।এদিকে নতুন বছরে সুন্দর ও নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশায় সমাজের সকল বয়সের মানুষ বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট আর্শীবাদ গ্রহণ করা হয়।বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতী নতুন কাপড়-চোপড় পরিধান করে গ্রামের ঘরে ঘরে হাঁস-মুরগি ও অন্যান্য পশু-পাখির খাবার বিলিয়ে দেয় এবং ত্রিপুরা সামাজিক রীতি অনুসারে বয়স্কদের পা ধরে সালাম করে আর্শীবাদ গ্রহণ করে।এদিনে পরিবারের সকল সদস্যের মঙ্গলের জন্য পূজা ও উপাসনা করা হয়।
চাষাবাদ :
ত্রিপুরাদের প্রধান উপজীবীকা চাষাবাদ হচ্ছে জুম চাষ। পাহড়ের ওপরে বিশেষ কায়দায় করা হয় চাষাবাদ। পাহাড়ে এই বিশেষ ধরনের চাষাবাদকেই জুম চাষ বলা হয়। জুম চাষের প্রকৃত অর্থ হলো স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে চাষাবাদ। এ ধরনের চাষাবাদে শুকনো মৌসুমে (ফাল্গুন-চৈত্র) মাসে পাহাড়ের গাছপালা কেটে ও পুড়িয়ে এক বছর চাষাবাদের পর আবার কম পক্ষে ৪-৫ বছর পতিত রাখা হয়। এই পতিত রাখার সময়ে জমি আবার তার উর্বরতা ফিরে পায়; কিন্তু বর্তমানে জনসংখ্যার তুলনায় জমি কম হওয়ায় মাত্র তিন-চার বছর জমি পতিত রাখা হচ্ছে। জমি নির্বাচনের সময় বাঁশ, গাছ, আগাছাসহ ঢালু জমি নির্বাচন করা হয়। এরপর বাঁশ বা গাছ কেটে রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। পরে এগুলোতে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে পুরে গাছগুলো ছাই হয়ে যায় এবং আধা ইঞ্চি মাটিও পুড়ে যায়। এই পোড়ামাটি ও ছাই জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এরপর বৃষ্টি হয়ে মাটি একটু নরম হলে ফসল বোনা হয়। জুম চাষে একসঙ্গে অনেক ফসল বোনা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফসল ঘরে তোলা হয়। ত্রিপুরাদের জীবন যাপনের জন্য জুম চাষ অপরিহার্য একটি বিষয়। সাধারণত জুম চাষে ধান চাষ ছাড়াও আদা, হলুদ, মিষ্টিকুমড়া, কলা, ভুট্টা, তিল, তুলাসহ আরো প্রভৃতি ফসলের চাষ হয়ে থাকে।
আর্থ-সামাজিক অবস্থা:
ত্রিপুরাদের প্রধান পেশা কৃষি। কৃষির মধ্যে রয়েছে জুমচাষ, লাঙ্গলচাষ ও ফলবাগান চাষ।এ সব চাষের সাথে জড়িত চাষীদের বাইরে রয়েছে চাকরীজীবী, কতিপয় ব্যবসায়ী ও দিনমজুর।এছাড়া সমাজে আর একটি পেশাজীবী রয়েছে যারা প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। তারা জঙ্গল থেকে লাকড়ি, শন, তরকারী ইত্যাদি সংগ্রহ করে বিক্রি করে জীবনধারণ করে।ত্রিপুরা জাতির মাঝে ব্যবসা করে এমন লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম। সে কারণে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দৈন্যতা খুব বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়।‘জুম চাষ’ত্রিপুরাদের জীবন-জীবিকার প্রধান পেশা। সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ত্রিপুরা আদিবাসীরা অতীতে মূলত জুম চাষের উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করতো।জুমের উপর ভিত্তি করেই ত্রিপুরাদের অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ত্রিপুরাদের নাচ, গান, ছড়া, গল্প, মূল্যবোধ, বাদ্য-যন্ত্র, পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি গড়ে উঠেছে জুম চাষকে কেন্দ্র করে।পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতো ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর আবাদী ভূমি ও বাস্তুভিটা বেহাত হয়ে যাচ্ছে। ভূমির উপর তাদের প্রথাগত অধিকারকে পদদলিত করে সরকার তাদের জুমভূমি বনায়ন, ইকো-পার্ক, পর্যটন কেন্দ্র, সামরিক স্থাপনা, অভিবাসী বাঙ্গালি বসতি প্রদান ইত্যাদি অজুহাতে অধিগ্রহণ করে চলেছে।
তথ্যসূত্র:জুমজার্নাল ,দৈনিক-বাংলাদেশ |