ভাইকিং’ শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন নর্স টার্ম ‘ভিকিঙ্গর’ থেকে। ‘ভিকিঙ্গর’ শব্দটির অর্থ জলদস্যু।আবার অনেকের মতে ,ভাইকিং শব্দের উত্পত্তি ভিক শব্দ থেকে যার অর্থ উপসাগর | ভাইকিং বলতে বোঝায় স্ক্যানডিনেভিয়ান পুরুষদের, যারা ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, রাশিয়া ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতো।
আগে ছোট্ট করে বলে দেয়া ভাল, স্ক্যানডিনেভিয়া অঞ্চলগত প্রধান তিনটি দেশ হচ্ছে সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ে অধিবাসীরা ৭৯৩-১০৬৬ সালের মধ্যে ব্রিটিশ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক আক্রমণ চালায় |
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মানুষেরা কেন এভাবে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপজুড়ে দুধর্ষ আক্রমণ চালিয়ে বেড়াত, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের জীবিকার্জনের পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। তাই সেখানকার অধিবাসীরা জীবিকার তাগিদে দস্যুতার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। আবার কেউ বলেন, ইউরোপের তৎকালীন রাজতন্ত্রের অন্তর্কোন্দলের সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানরা নিজেদের সম্পদশালী করতে চেয়েছিল, তাই তারা এই পথ বেছে নেয়।
এবার তাদের সামরিক কৌশল নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ভাইকিংরা যেহেতু চলাচলের পথ হিসেবে সমুদ্রকেই বেছে নিয়েছিল, তাই তাদের প্রধান বাহন ছিল জাহাজ। তাদের জাহাজগুলো গতানুগতিক জাহাজের মতো ছিল না। এগুলো ছিল সেই সময়ের জাহাজগুলোর তুলনায় খানিকটা লম্বা এবং হালকা, যাতে নাবিকেরা খুব সহজেই দিক পরিবর্তন করতে পারেন। ‘ড্রাক্কার’ নামের এই জাহাজগুলো বানানোর দায়িত্ব দেয়া হতো একদল বিশেষজ্ঞ কাঠমিস্ত্রীকে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির উপর জাহাজ তৈরির কাঠ নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পিত হতো। ডেভিড ফার্নান্দেজ আবেয়া নামের একজন বিশেষজ্ঞের মতে, “মধ্যযুগের আগপর্যন্ত ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী সভ্যতাগুলোর কোনো জাহাজই আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়ার মতো উপযুক্ত ছিল না। অথচ ভাইকিংদের দীর্ঘ জাহাজগুলো অনায়াসে পৃথিবীর যেকোনো সাগর পাড়ি দিতে পারত।
ভাইকিংদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে প্রধান ছিল ধারালো দু’মুখো তলোয়ার। ধারণা করা হয়, আজকের জার্মানি থেকে এসব ধারালো তলোয়ার সেসময় স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় রপ্তানি করা হতো (বলা রাখা ভালো, সেসময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো তলোয়ার তৈরি হতো জার্মানিতেই)। জার্মানির বিভিন্ন দেশের রাজ্যের শাসকেরা যখন বুঝতে পারেন এসব তলোয়ার তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন তারা এই তলোয়ার রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ভাইকিংদের পছন্দের কুড়ালগুলো আক্রমনের সময় প্রতিপক্ষের উপরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতো, কারণ সেসময় এমন কোনো জিনিস ছিল যা এই কুড়াল দিয়ে দুই টুকরা করা যেত না। এছাড়াও নৌযুদ্ধের সময় স্থানীয় জাহাজগুলোর উপর বৃষ্টির মতো তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করতে পারদর্শী ছিল ভাইকিংরা, যা তাদেরকে বাড়তি সুবিধা এনে দিত।
তবে ভাইকিংদের সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র ছিল, তা হচ্ছে তাদের খুনে মানসিকতা। সাধারণত একটি অভিযানে একই এলাকার বা ছোট থেকে একসাথে বড় হওয়া একদল যোদ্ধাকে প্রেরণ করা হতো। একজন ভাইকিংয়ের জন্য সবচেয়ে লজ্জাজনক ব্যাপার ছিল পরিচিত মানুষের সামনে যুদ্ধে পরাজিত হওয়া। যুদ্ধ কিংবা আক্রমণ শেষে যেখানে একই জাহাজে পাশাপাশি বসে মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে হবে, সেখানে কে-ই বা পরাজয়ের গ্লানি কাঁধে বয়ে নিতে চাইবে? আর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সংস্কৃতিতে যুদ্ধের বিজয়ীদের খুব বড় ও মহৎ করে দেখার যে প্রচলন ছিল, তাতে পরাজিতের জন্য কোনো সহানুভূতির স্থান ছিল না। এ কারণে কোনো আক্রমণের সময় ভাইকিং যোদ্ধারা জয়ের জন্য বাড়তি চাপ অনুভব করতেন, যেগুলো তাদের দক্ষতাকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিপক্ষ বিরুদ্ধে প্রকাশ করতে সহায়তা করত।
ভাইকিংদের আরেকটি বড় সুবিধা ছিল একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আবির্ভূত হওয়ার বিষয়টি। ভাইকিং লংবোটগুলোর খুব দ্রুতগতির হওয়ার কারণে এগুলো হুট করে কোনো উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানতে পারত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে রাজা ও তার পুত্রদের মধ্যে হয়তো গোলযোগ চলছে, এই সুযোগে অরক্ষিত উপকূলীয় অঞ্চলের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে ভাইকিংরা সব লুটপাট করে আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে বা এলাকা দখল করে নিজেরা শাসন করা শুরু করে দিয়েছে। ভাইকিংদের অতর্কিত আক্রমণের বিরুদ্ধে রাজার সামরিক বাহিনী কিংবা স্থানীয় জনগণ– কেউই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত না।
ইউরোপের যেকোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রে একটি নীতি ছিল যে একপক্ষ আরেকপক্ষের সবকিছু ধ্বংস করে দিলেও সন্ন্যাসীদের মঠ ও ধর্মীয় স্থাপনা– এগুলোতে কখনও আক্রমণ করবে না। কিন্তু ভাইকিংদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা আক্রমণ চালানোর পর লুটের ক্ষেত্রে সন্ন্যাসীদের মঠকেই বেছে নিত। কারণ এখানে সেসময়ের সবচেয়ে দামী জিনিসপত্র জমা থাকত। প্রথমদিকে সন্ন্যাসীরা দাবি করেছিল, ভাইকিংরা হচ্ছে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে প্রেরিত শাস্তিস্বরূপ। মানুষ অতিরিক্ত পাপাচারে লিপ্ত হওয়ায় ঈশ্বর হিসেবে ভাইকিংদের দ্বারা শাস্তি দিচ্ছেন– এই ধরনের বাণী প্রচার করতেন তারা।
ভাইকিংরা যেভাবে একসময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল ইউরোপের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে, তাতে তাদের সমসাময়িক জাতিগুলোর তুলনায় তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আর কারোও সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিত নয়। তাদের নিজস্ব সামরিক কৌশল, মানসিকতা ও উন্নত যুদ্ধাস্ত্রের কারণে তারা সমসাময়িক ইউরোপীয় জাতিগুলোর চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে ছিল এবং এগুলো তাদেরকে প্রায় প্রতিটি অভিযানেই সাফল্য এনে দিয়েছে।
ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের ইতিহাসবিদেরা তাদের লেখায় ভাইকিংদের ‘বর্বর’, ‘হিংস্র’ এই ধরনের নেতিবাচক বিশেষণে বিশেষায়িত করলেও বাস্তবে তারাও পরবর্তীতে বিদেশি রাজ্য দখলে নিতে ভাইকিংদের চেয়ে অনেক বেশি নির্মমতার আশ্রয় নিয়েছিল। প্রায় তিন শতাব্দী ধরে ভাইকিংরা ইউরোপে আধিপত্য কায়েম করেছিল তাদের সামরিক শক্তির উপর বলীয়ান হয়ে– এ কথাটি বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।
ড্রাগন জাহাজ :
আগেই বলেছি, ভাইকিংরা জাহাজ বানানোতে ছিলো অসম্ভব রকমের পটু। একটা জাহাজ কোন পথে যাবে বা কি পরিমাণ ভার বহন করতে হবে এসব বিবেচনা করে তারা জাহাজ নির্মাণ করতে পারতো। প্রতিটি অভিযান শেষে নিরাপদে ফেরত আসা নাবিকদের মুখে সমুদ্রযাত্রার বিবরণ শুনে সেই রুটের জাহাজের নকশা তৈরী করতো নির্মাতারা।
সাধারনত দুই ধরনের জাহাজ বানাতো, তার মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিলো ‘ল্যাংস্কিপ’ – যেটা ছিলো আদতে যুদ্ধ জাহাজ। এই জাহাজগুলোতে চেপে তারা হামলা করতো বিভিন্ন দেশে। জাহাজগুলোর সামনে ভয়ংকর এক ড্রাগনের নকশা কাটা থাকতো বলে এটি পরিচিত ছিলো ‘ড্রাগন জাহাজ’ নামে।
ল্যাংস্কিপগুলো বানানো হতো সরু আর লম্বা করে। প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাটজন যোদ্ধা বহন করতে পারতো এই জাহাজগুলো। দুই পাশে ষোলজন করে মোট বত্রিশ জন যোদ্ধা দাড় বাইতো। দ্রুতগামী এবং সহজে বাঁক নিতে সক্ষম হওয়ার কারণে নৌপথের যুদ্ধেও ল্যাংস্কিপ ছিলো রীতিমতো অজেয়।
‘নোর’ নামে আর একটি জাহাজ ভাইকিংরা ব্যাবহার করতো মালামাল বহণ আর মানুষ পারাপারের কাজে। এটি তৈরী করা হতো বেশ চওড়া করে। ল্যাংস্কিপের চেয়ে ধীরগতির হলেও ভাইকিংদের বসতি গুলোতে অনায়াসে যাতাযাত করতো ওক কাঠের এই জাহাজগুলো।
দিকচাকতি :
দিক চাকতি ছিলো ভাইকিংদের ‘হাতে বানানো কম্পাস’। খুবই সাধারণ একটি যন্ত্র, নকশা কাটা কাঠের চাকতির ঠিক মাঝখানে পেরেক লাগনো থাকতো।দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেই পেরেকের ছায়া বরাবর একটা রেখা টেনে দিতো জাহাজের ‘ক্যাপ্টেন’।
তারপর নাবিকদের কাজ ছিলো সোজাসুজি সেই রেখা ধরে জাহাজ চালিয়ে যাওয়া।দিক ঠিক রাখার এই কৌশল খাটিয়েই ভাইকিংরা প্রতি বছর হানা দিতো ইংল্যান্ডে। প্রতিবছর খোলা সমুদ্রে জাহাজ চালিয়ে যারা একটা দ্বীপদেশে হানা দিতে পারে, তারা চুম্বকের ব্যাবহার পর্যন্ত জানতো না, বিশ্বাস হয়!
রহস্যময় সূর্যপাথর :
ভাইকিংদের লোকগাঁথা গুলোতে বার বার এক জাদুকরী পাথরের কথা বলা হয়েছে। সমুদ্র পথে চলার সময় এই পাথর সবসময় সাথে রাখতো তারা। এর বিশেষত্য হলো, মেঘলা দিনে যখন আকাশে সূর্য থাকতো না , তখন এই পাথরটি আকাশের দিকে ধরলে তার ভেতরে সূর্যের দেখা পাওয়া যেত। নর্ডিকদের মতে, দেবরাজ ওডিন নাকি সূর্য থেকে একটি টুকরো ভেঙ্গে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন যেনো মেঘাচ্ছন্ন দিনে ভাইকিং জাহাজগুলো পথ হারিয়ে না ফেলে।
আধুনিক গবেষকদের মতে, সূর্যপাথর বলতে তারা আসলে ‘আইসল্যান্ডিক স্পার’ নামের এক ধরনের স্ফটিককে বোঝাতো। সূর্যের হালকা রশ্নি যখন এর ভেতর দিয়ে যায় তখন তা বিভাজিত হয়, ফলে সেই পাথরের ভেতর তাকালে মেঘলা আকাশেও সূর্যের অবস্থান বুঝতে পারা সম্ভব। তবে এই পাথরের খোঁজ ভাইকিংরা কিভাবে পেয়েছিলো সে এক রহস্য বটে!
অসীম জলরাশির মাঝে পথচলা :
যুদ্ধ বা পারাপার যে কারণেই হোক, সাগরে চলার সময় ভাইকিংরা ছিলো পুরোপুরি প্রকৃতি নির্ভর। দিনের আকাশে সূর্য আর রাতে নক্ষত্রের অবস্থান দেখে তারা জাহাজের দিক ঠিক করতে জানতো। আবার, বাতাস ও ঢেউয়ের বেগ দেখে তারা বুঝতে পারতো কখন তীর সন্নিকটে।
যখন তারা কোনো নতুন ভূমি আবিষ্কার করতো, তখন সেখানে যাওয়ার এবং ফিরে আসার পুংখানুপুংখ বিবরন তারা মনে রাখতো। নতুন অভিযাত্রীরা পুরোনো নাবিকদের কাছ থেকে সমুদ্রযাত্রার গোটা বিবরন শুনে নিতো। এভাবে শ্রুতির মাধ্যমে তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পার করে দিতো লব্ধ জ্ঞান।
নারীদের ভূমিকা :
ভাইকিং সমাজে নারীদের স্রেফ উচ্চ আসনেই স্থান ছিল না, বরং তারা সম্মান-পদমর্যাদাও উপভোগ করতো পুরুষদের মতো।পুরুষদের মতোই বর্ম পরিধান করত তারা, শিখত তলোয়ার চালনা ও অন্যান্য যুদ্ধকৌশল। আর জানতো কীভাবে প্রয়োজনের সময় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে নিজের পরিবার, সম্পত্তি আর রাজ্য রক্ষা করতে হয়।
প্রাথমিক ভাইকিং অভিযান :
৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে, উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের উত্তরবারল্যান্ডের উপকূলে লন্ডিসফার্ন মঠটিতে আক্রমণ একটি ভাইকিং যুগের সূচনা করেছিল। অপরাধীরা – সম্ভবত নরওয়েজিয়ানরা যারা সরাসরি উত্তর সমুদ্রের ওপারে যাত্রা করেছিল – মঠটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেনি, তবে এই আক্রমণটি ইউরোপীয় ধর্মীয় জগতকে মূল কেন্দ্রবিন্দুতে নাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যান্য গোষ্ঠীর মতো নয়, এই বিস্ময়কর নতুন আক্রমণকারীদের মঠগুলির মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কোনও শ্রদ্ধা ছিল না, যেগুলি প্রায়শই নিরস্ত্র এবং তীরের কাছে দূর্বল হয়ে পড়ে ছিল। এর দু’বছর পরে, ভাইকিং অভিযানগুলি স্কাই এবং আইওনের (হেব্রাইডে) পাশাপাশি রথলিনকে (আয়ারল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব উপকূলের বাইরে) অপরিবর্তিত দ্বীপ বিহারগুলিতে আক্রমণ করেছিল। মহাদেশীয় ইউরোপে প্রথম রেকর্ড করা আক্রমণটি ৭৯৯ সালে লোয়ার নদীর মোহনার নিকটে নোরিমুটিয়ারে সেন্ট ফিলিবার্টস দ্বীপ বিহারে এসেছিল।
কয়েক দশক ধরে, ভাইকিংরা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ (বিশেষত আয়ারল্যান্ড) এবং ইউরোপের উপকূলীয় লক্ষ্যগুলি (উত্তর সাগর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে ডোরেস্টাডের বাণিজ্য কেন্দ্র, ৮৩০-এর পরে ঘন ঘন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল) এবং তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক আক্রমণ চালিয়েছিল। এরপরে তারা ইউরোপের অভ্যন্তরীণ কোন্দলগুলির সুযোগ নিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকে আরও অভ্যন্তরীণভাবে বাড়িয়ে তুলল: ৮৪০ সালে ফ্র্যাঙ্কিয়ার সম্রাট (আধুনিক ফ্রান্স এবং জার্মানি) লুই দ্য পিউইসের মৃত্যুর পরে, তাঁর পুত্র লোথার আসলে ভাইকিং বহরের সমর্থনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ভাইদের সাথে একটি শক্তির লড়াইয়ে। অনেক আগেই ভাইকিংরা বুঝতে পেরেছিল যে ফ্রাঙ্কিশ শাসকরা তাদের প্রজাদের আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখতে তাদের প্রচুর পরিমাণে দিতে রাজি ছিলেন, ফ্র্যাঙ্কিয়াকে আরও ভাইকিং ক্রিয়াকলাপের অপূরণীয় লক্ষ্য হিসাবে পরিণত করেছিলেন।
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে জয় :
নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ইংল্যান্ড ভাইকিং বন্দোবস্তের পাশাপাশি অভিযানের বড় টার্গেটে পরিণত হয়েছিল। ভাইকিংস নর্দার্ন দ্বীপপুঞ্জের স্কটল্যান্ড (শিটল্যান্ড এবং অরকনিজ), হেব্রাইড এবং মূলভূমি স্কটল্যান্ডের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে। তারা আয়ারল্যান্ডের প্রথম বাণিজ্য শহরগুলি প্রতিষ্ঠা করেছিল: ডাবলিন, ওয়াটারফোর্ড, ওয়েক্সফোর্ড, উইকলো এবং লিমেরিক এবং আয়ারল্যান্ডের অভ্যন্তরে এবং আইরিশ সাগর পেরিয়ে ইংল্যান্ডে আক্রমণ চালাতে আইরিশ উপকূলে তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করেছিল। রাজা চার্লস বাল্ড ৮৬২ সালে যখন আরও শক্তিশালীভাবে পশ্চিম ফ্রাঙ্কিয়াকে রক্ষা করতে শুরু করেছিলেন, শহর, উপকূল, নদী এবং উপকূলীয় অঞ্চলকে শক্তিশালী করে তোলেন, তখন ভাইকিং বাহিনী ফ্র্যাঙ্কিয়ার চেয়ে ইংল্যান্ডের দিকে আরও মনোনিবেশ করতে শুরু করে।
ভাইকিং বন্দোবস্ত: ইউরোপ এবং এর বাইরেও :
এদিকে, ভাইকিং আর্মিরা নবম শতাব্দী জুড়ে ইউরোপীয় মহাদেশে সক্রিয় ছিল, ন্যান্টসকে (ফরাসী উপকূলে) ৮৮২ সালে নির্মমভাবে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং প্যারিস, লিমোজেস, অরলিন্স, ট্যুরস এবং নিমস পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ শহরগুলিতে আক্রমণ করেছিল। ৮৪৪ সালে ভাইকিংস সেভিলকে (তখন আরবদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত) আক্রমণ করেছিল; 859 সালে, তারা পিসা লুণ্ঠন করেছিল, যদিও একটি আরব বহর উত্তর দিকে ফেরার পথে তাদের পিটিয়েছিল। 911 সালে, পশ্চিম ফ্রাঙ্কিশ রাজা রোন এবং তার আশেপাশের অঞ্চলটি রোলো নামে একজন ভাইকিং প্রধানের সাথে চুক্তি করে অন্য আক্রমণকারীদের কাছে সিনে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করার বিনিময়ে সন্ধি দিয়েছিলেন। উত্তর ফ্রান্সের এই অঞ্চলটি এখন নরম্যান্ডি বা “নর্থম্যানদের ভূমি” নামে পরিচিত।
ভাইকিংদের নৃশংস প্রথা :
আজ মৃতদের সৎকারের যতগুলো প্রথা আলোচনা করা হলো, তার মাঝে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে জঘন্য ছিলো ভাইকিংদের প্রথাটি। ‘ছিলো’ বললাম, কারণ এখন এটি কেবলই ইতিহাস, দুঃখের এক ইতিহাস।
ভাইকিংদের কোনো গোষ্ঠীপতি মারা গেলে প্রথম পর্বে তার মৃতদেহটি দশদিনের জন্য এক অস্থায়ী কবরে রাখা হতো। এ সময়ের মাঝে তার জন্য নতুন কাপড় বানানো হতো। একইসাথে তার কোনো ক্রীতদাসীকে তার সাথে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত করা হতে থাকতো। এ সময় তাকে রাত-দিন পাহারার মাঝে রাখা হতো এবং প্রচুর পরিমাণে উত্তেজক পানীয় পান করানো হতো।
এরপর যখন সৎকারের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতো, তখন দুর্ভাগা সেই মেয়েটি একের পর এক গ্রামের সব তাবুতেই যেতে বাধ্য হতো। সেসব তাবুর পুরুষেরা তার সাথে মিলিত হতো আর বলতো, “তোমার মনিবকে বলো যে, এটা তার প্রতি আমার ভালোবাসা থেকেই করলাম”! সবগুলো তাবু ঘোরা শেষে মেয়েটি যেত আরেকটি তাবুতে যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করতো ছয়জন ভাইকিং পুরুষ। তারাও তার সাথে মিলিত হতো। এরপরই দড়ি দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে দুর্ভাগা সেই মেয়েটিকে মেরে ফেলা হতো। মৃত্যু নিশ্চিত করতে সেই গোত্রেরই মহিলা প্রধান তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতেন।
এরপর? এরপর সেই মেয়ে আর তার মনিবের মৃতদেহ একই কাঠের নৌকায় তুলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হতো সেখানে। এটি করা হতো যাতে পরকালে গিয়ে মেয়েটি তার মনিবের ঠিকঠাক সেবা-যত্ন করে সেই ব্যাপারটি নিশ্চিত করতেই।
ভাইকিংদের সমাপ্তি :
ইংল্যান্ডের ১১০৯ সালের ঘটনাগুলি কার্যকরভাবে ভাইকিংদের সমাপ্তি ঘটায়। তাদের সমাপ্তির পর স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের সমস্ত রাজ্যেই খ্রিস্টান ছিল। এবং ভাইকিং সংস্কৃতিগুলো খ্রিস্টান ইউরোপের সংস্কৃতির রূপ নিয়ে ছিল। আজ, ভাইকিং বংশভুত কিছু মানুষ স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের কয়েকটি স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। এছাড়াও উত্তর ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং রাশিয়া সহ আরো কিছু স্থানে তাদের পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র: ইতিহাস, উইকিপিডিয়া,রোয়ারমিডিয়া,ফিলসুফ.ওয়ার্ডপ্রেস |