Image default
ইতিহাস

লালবাগ কেল্লা: তিন শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক স্থাপত্য

তিন শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা মুঘল আমলের বাংলাদেশে একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন লালবাগ কেল্লা। পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার বুড়িগঙ্গা নদীর কূল ঘেঁষে কেল্লাটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে প্রাচীন ইতিহাস ও সভ্যতার এই নিদর্শনটি। এ নিদর্শনে ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টি পাথর, মার্বেল পাথর এবং বাহারি রঙের টালির মিশ্রণ।

লালবাগ কেল্লায় প্রবেশের পর দেখা মিলবে সুন্দর ফুলের বাগান ও একাধিক প্রস্রবণের। তবে বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া প্রস্রবণগুলো বন্ধ থাকে। শত্রুদের প্রতিহত করার জন্য দুর্গের ভেতর মুঘল আমলে একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে এই সুড়ঙ্গপথে জনসাধারণের প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনেকের মতে, একসময় এই সুড়ঙ্গপথে দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারত। কিন্তু আজও এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

সুড়ঙ্গপথ প্রসঙ্গে লালবাগ দুর্গের প্রাক্তন কাস্টোডিয়ান মো. হাবিবুর রহমান বলেন,
লালবাগ কেল্লা মানে মুঘল আমলে নির্মিত একটি সুরক্ষিত দুর্গ। প্রায়ই তখন শত্রু, সৈন্যরা, মগ পর্তুগিজ এরা এসে এই নদীপথে ও ঢাকা নগরীতে আক্রমণ করত, সম্পদ লুণ্ঠন করত। এই শত্রুদের প্রতিহত করার জন্য, নগরবাসী এবং নগরকে সুরক্ষিত রাখার জন্যই মুঘল সম্রাট তখন এই দুর্গে সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ করেন। অনেক দর্শনার্থী বলে থাকেন যে এই সুড়ঙ্গ পথ দিল্লির সাথে সংযুক্ত ছিল এবং এটা বুড়িগঙ্গা নদীর নিচ দিয়ে ওপারে যাওয়ার একটা পথ ছিল। আসলে এই সবকিছুই অবাস্তব এবং কল্পকাহিনী।

দুর্গে দর্শনার্থীদের দেখার জন্য বর্তমানে তিনটি স্থাপনা রয়েছে- পরীবিবির সমাধি, হাম্মামখানা বা দরবার হল এবং তিন গম্বুজ মসজিদ।

কেল্লার ইতিহাস:
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, পোস্টার কিংবা যেকোনো জায়গাতে লালবাগ কেল্লার যে চিত্রটি প্রদর্শন করা হয়, সেটি মূলত পরীবিবির সমাধিস্থল। তৎকালীন সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র সম্রাট আজম শাহের সাথে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা দেনমোহরে সুবেদার নবাব শায়েস্তা খাঁ’র কন্যা ইরান দুখত রাহমাত বানু ওরফে পরীবিবির বিয়ে ঠিক হয় ১৬৬৮ সালে। তবে সে সুখ সয়নি। বিয়ের ১৬ বছর পর ১৬৮৪ সালে মারা যান পরীবিবি। তার মৃত্যুর পর দুর্গের অভ্যন্তরে মসজিদ ও দরবার হলের মাঝখানে শায়িত করা হয় তাকে। তারপর থেকে জনসাধারণের কাছে স্থানটি পরীবিবির সমাধিস্থল নামে পরিচিতি লাভ করে।

পরীবিবির সমাধিসৌধে প্রবেশের জন্য তিনটি প্রবেশপথ থাকলেও বর্তমানে দর্শনার্থীদের ব্যবহারের জন্য মাত্র একটি প্রবেশপথ উন্মুক্ত। সমাধিস্থলটি চতুষ্কোণ আকৃতির এবং তারই সাথে মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বাহারি রঙের ফুল-পাতার সুশোভিত মুগ্ধকর টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির এই সমাধিস্থলটির কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের কৃত্রিম গম্বুজটি একসময় স্বর্ণখচিত ছিল, তবে এখন তা তামার পাত দিয়ে আচ্ছাদিত।

লালবাগ দুর্গের প্রাণকেন্দ্র দিওয়ানি আম নামের দরবার হল বা হাম্মামখানা। তৎকালীন সম্রাট আজম শাহ দ্বিতল বিশিষ্ট এই ভবনটি নির্মাণ করলেও এটি ব্যবহার করতেন সুবেদার শায়েস্তা খাঁ। ভবনের নিচতলা ব্যবহার হতো হাম্মামখানা বা নবাব শায়েস্তা খাঁ’র বাসভবন হিসেবে এবং দ্বিতীয় তলা থেকে তখনকার সকল বিচারকার্য পরিচালনা করা হতো। ১৬৮৮ সালে নবাব শায়েস্তা খাঁ শাসনতন্ত্র থেকে বিদায় নিয়ে অবসরে যাওয়ার পর দুর্গের মালিকানা উত্তরাধিকারীদের ওয়াকফ করে আগ্রায় চলে যান।

 

 

বর্তমানে পুরো ভবনটিই জাদুঘরের প্রত্নসম্ভার। মুঘল শাসনামলের অসংখ্য স্মারক ঠাঁই পেয়েছে কেল্লাতে। ভবনের প্রবেশপথে বিদ্যমান মুঘল আমলের কামান দৃষ্টিগোচর হয় যেকোনো দর্শনার্থীর। হাতে লেখা কোরআন শরীফ, তাফসীর, দিওয়ানি হাফিজ নামে কাব্যগ্রন্থ, আকবরের শাহী পরমান ও পরওয়ানাসহ বিভিন্ন গ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি এবং মুঘল চিত্রকলার নানা নমুনা এই জাদুঘরের অমূল্য সম্পদ। তাছাড়াও শায়েস্তা খাঁ’র আমলে ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র, বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক ও তখনকার প্রচলিত মুদ্রাও নজর কাড়ে পর্যটকদের। তবে জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কোনো টিকিটের প্রয়োজন নেই, যে কেউ পরিদর্শন করতে পারে।

লালবাগ কেল্লার স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। পরীবিবির সমাধিস্থলের প্রায় ১৭০ ফুট পশ্চিমে এটি অবস্থিত। সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র সম্রাট আজম শাহ বাংলার সুবেদার থাকাকালে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৬৫ ফুট ও পূর্ব-পশ্চিমে সাড়ে ৩২ ফুট। মসজিদের পশ্চিমে কিবলামুখ জুড়ে রয়েছে তিনটি অবতল মেহরাব। মসজিদের ছাদের মাঝখানে বড় একটি এবং দু’পাশে দুটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। পুরনো এই মসজিদে নামাজ আদায় করতেন দুর্গের তৎকালীন মুঘল রাজেন্দ্রবর্গ। বর্তমানে এই মসজিদে জামাতের সাথে সালাত আদায় করা হয়।

লালবাগ কেল্লার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, তাজমহল নির্মাণে বিশ্ব মহলে ব্যাপক সমাদৃত তৎকালীন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের দৌহিত্র ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় শাহজাদা সম্রাট আজম শাহ ১৬৭৮ সালে দুর্গের উদ্যোগ ও নির্মাণকাজ শুরু করেন। উল্লেখ্য, খুব স্বল্প সময়, অর্থাৎ পনেরো মাস আজম শাহ তখনকার বাংলার মুঘল সম্রাট ছিলেন। দুর্গের একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পরই আজম শাহ তার বাবার ডাকে দিল্লিতে চলে যান তখনকার মারাঠা বিদ্রোহ দমন করার জন্য।

তিনি চলে যাবার পর দুর্গ নির্মাণের কাজ যদিও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার এক বছর পর তৎকালীন সুবেদার নবাব শায়েস্তা খাঁ’র উদ্যোগে সেই নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু হয়। কাজ শুরু হওয়ার প্রায় চার বছর পর, ১৬৮৪ সালে নবাব শায়েস্তা খাঁ’র কন্যার মৃত্যুতে দুর্গের নির্মাণকাজ আবারও বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর নির্মাণকাজ আর সামনে এগোয়নি। দুর্গ নিয়ে সবার মাঝে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয় এবং একে সবাই দুর্ভাগ্যের কারণ ভাবতে শুরু করে। পরীবিবির মৃত্যুর পর তাকে দুর্গে নির্মাণাধীন মসজিদ ও দরবার হলের মাঝখানে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়।

ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করার কারণে নবাব শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ত্যাগ করেন। রাজকীয় এই মুঘল আমল সমাপ্ত হওয়ার পর দুর্গটি পড়ে থাকে। ১৮৪৪ সালে এলাকাটির প্রাচীন নাম ‘আওরঙ্গবাদ’ পরিবর্তিত হয়ে ‘লালবাগ’ হয়। এক্ষেত্রে অনেকের মতে, এলাকার নাম লালবাগ হওয়াতে দুর্গটি লালবাগ দুর্গ হিসেবে বেশ পরিচিতি পায়। অতঃপর দুর্গের প্রাচীর ১৯১০ সালে সংরক্ষিত স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় এনে সংস্কারের মাধ্যমে এর পূর্বের রূপ ফিরিয়ে আনা হয়।

পরিদর্শন বিষয়ক তথ্য:
কাল ও মাস ভেদে লালবাগ কেল্লা পরিদর্শনের সময়সূচি পরিবর্তিত হয়। এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাসে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং অক্টোবর-মার্চে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কেল্লা খোলা থাকে। উল্লেখ্য, সোমবার দুপুর ২টা থেকে কেল্লার ফটক খোলা থাকে। উল্লিখিত দুই সময়ে দুপুর ১টা থেকে ১:৩০ পর্যন্ত এবং শুক্রবার সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত এটি বন্ধ থাকে। তাছাড়াও সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার ও সরকারি যেকোনো বিশেষ দিবসে কেল্লা বন্ধ থাকে।

লালবাগ দুর্গে প্রবেশের জন্য টিকিট কাউন্টার থেকে প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য জনপ্রতি টিকিট মূল্য ২০ টাকা এবং বিদেশী নাগরিকদের টিকিটের জন্য গুনতে হয় ২০০ টাকা। পাঁচ বছরের নিচে ছোট বাচ্চাদের টিকিটের প্রয়োজন নেই।

লালবাগ দুর্গে যাওয়ার জন্য বেশ কিছু পথ রয়েছে। যেকোনো একটি পথ অবলম্বন করে খুব সহজেই যাওয়া যাবে সেখানে।

Related posts

কৃষির ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে কৃষি জাদুঘর

News Desk

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের অনন্য ভূমিকা

News Desk

বুদ্ধিজীবী ডা. আজহারুল: স্টেথোস্কোপ হয়ে উঠেছিল যার অস্ত্র

News Desk

Leave a Comment