প্রথম বর্ণমালার গল্পটাই অদ্ভুত। তবে তার অদ্ভুতের দিকে অনেকটাই এগোনো গিয়েছে গত সিকি শতকে। তার জন্ম হয়ে থাকতে পারে সম্পূর্ণ নিরক্ষর, সংস্কৃতিজ্ঞানরহিত ‘গরিব-গুর্বো চাষাভুষো’দের মগজেও।
নাহ, তিনি গিজায় ফ্যারাও খুফু-খাফ্রা-মেনকাউরার মতো পেল্লায় পিরামিড বানাননি। কিছু শিল্পকর্মের ফরমাশ করেছিলেন বটে, কিন্তু কোনওটাই তুতানখামুনের সোনার মুখোশের ধারে-কাছে আসে না। এদিক ওদিক যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু মিশরীয় সাম্রাজ্যের দুই প্রতিষ্ঠাতা দ্বিতীয় রামেসেস আর তৃতীয় থুৎমোসের তুলনায় সে সবই নিতান্ত অসম্পূর্ণ।
কিন্তু ফ্যারাও তৃতীয় আমেনেমহাতের একটা কীর্তি আছে। সে কীর্তি কালজয়ী। সে কীর্তি মূল্যের বিচারে আজকের দিনে ছাপিয়ে যায় উপরের সব ক’টা নামকে। কারণ, বিজ্ঞানীরা বলছেন— বিস্মৃত, অজানা এই ভদ্রলোকের জমানাতেই বর্তমান এক প্রযুক্তির উদ্ভাবনা, পৃষ্ঠপোষকতাও। সে প্রযুক্তি—অক্ষরমালা!
সে যুগে বর্ণমালা ছিল নিছক লেখার পদ্ধতির চেয়ে ঢের বেশি, বরং তথ্য রেকর্ড করার এক বৈপ্লবিক উপায়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক ফিলিপ স্টিল এবং ফিলিপ বয়েস তাঁদের সাম্প্রতিক বইয়ে অক্ষরমালাকে বর্ণনা করেছেন ‘সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি’ হিসেবে। এখন দেখা যাচ্ছে, এর শিকড় এমনই হাড়ে-মজ্জায় যে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের শিশুরা পড়তে বা লিখতে শেখার আগেই অনেক সময় দিব্যি বর্ণমালা আবৃত্তি করে ফেলেছ, শুধু শুনে শুনে। পরিচিত এবিসিডি-র বাইরে রুশ থেকে আরবি পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন বর্ণমালা লেখার জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এদের সবার পূর্বপুরুষ একটিই।
সেই প্রথম বর্ণমালার গল্পটাই রহস্যময়। তবে তার রহস্যভেদের দিকে অনেকটাই এগোনো গিয়েছে গত সিকি শতকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, আজকালকার বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে এক মত যে কোনও রাষ্ট্রীয় মদতে, কোনও রাজা-রাজড়ার ফরমাশে, কোনও কুবেরের পৃষ্ঠপোষকতায় এই বর্ণমালার জন্ম হয়নি। বরং তার জন্ম অনেকটাই নন-এলিট। এমনকী, তার জন্ম হয়ে থাকতে পারে সম্পূর্ণ নিরক্ষর, সংস্কৃতিজ্ঞানরহিত ‘গরিব-গুর্বো চাষাভুষো’দের মতো নিম্নবর্গদের মগজেও। জেরুজালেমের হিবরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অরলি গোল্ডওয়েসার বলেছেন, ‘এই প্রতিভারা যে ভাবে লেখার পদ্ধতি বের করেছিলেন, প্রশিক্ষিত মিশরীয় লেখকরা তা দেখলে নিশ্চিত লজ্জা পেতেন!’
বর্ণমালার উদ্ভাবন অবশ্যই ফ্যারাও তৃতীয় আমেনেমহাতের আমলে নয়। এই ভদ্রলোক নীলনদের তীরে রাজত্ব করতেন ৩,৮০০ বছর আগে। তার অন্তত ১,০০০ বছর আগেই বর্ণমালার প্রচলন ছিল। তার মধ্যে দু’টি বর্ণমালা ছিল বিশেষ প্রভাবশালী— দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মেসোপটেমিয়ায় জন্ম নেওয়া কিউনিফর্ম এবং মিশরীয় হায়েরোগ্লিফিক্স। এই ‘পবিত্র লিপি’ই (হায়েরোস + গ্লিফিকোস) ছিল পরবর্তী বর্ণমালার উদ্ভাবকদের মূল অনুপ্রেরণা। এখনই সেই ঐতিহ্যের আবছা প্রতিধ্বনি বহন করে হায়েরোগ্লিফিক্সের উত্তরসূরিরা। ধরা যাক ইংরেজি বর্ণমালার ‘এম’ অক্ষরটির কথাই— যেন জলতরঙ্গ, যেন ঢেউ উঠছে-পড়ছে। এই যে রৈখিক ছাঁদ, এ দান হায়েরোগ্লিফিক্সেরই। তবে হ্যাঁ, পরবর্তী কালে বহু ভাঙাগড়া, বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছে সেই সব অক্ষর, যাকে আমরা বর্তমানের বর্ণমালা বলে চিনি।
কেমন সে ভাঙাগড়া?
মিশরীয় হায়েরোগ্লিফগুলি সাধারণত উচ্চারণ বা সম্পূর্ণ শব্দকে উপস্থাপন করত। বর্ণমালাটি একটি ভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার করে। সমস্ত বর্ণ হল গিয়ে ‘ফোনেম’-এর প্রতিনিধি, যে অবিভাজ্য প্রাথমিক কণা থেকে বিশ্বের সমস্ত কথ্য ভাষার নির্মাণ। ধরা যাক একটা সহজ-সরল তিন অক্ষরের ইংরেজি শব্দের কথা— ‘পেন’ (কলম)। বর্ণনামূলক সিলেবল এতে একটাই, কিন্তু তিনটে অক্ষর তিনটে আলাদা আলাদা ফোনেম-এর প্রতিনিধি। বর্ণমালার যখন প্রথম প্রচলন ঘটে, তখন অল্প কিছু ফোনেমিক উপাদান ছিল বটে, কিন্তু ওই পযর্ন্তই। আর এখনকার বর্ণমালা? পুরোটাই ফোনেম-নির্ভর। এটাই দ্রোহকাল, বিপ্লব এটাই!