আনোয়ারার ‘পরৈকোড়া জমিদার বাড়ি’
ইতিহাস

আনোয়ারার ‘পরৈকোড়া জমিদার বাড়ি’

অজয় মিত্র

চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার পরৈকোড়া, ১৮০ বছর আগেও ছিল ঝাঁকজমকপূর্ণ, লোকে লোকারণ্য, জৌলুশপূর্ণ ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত প্রতাপশালী জমিদার যোগেশ চন্দ্রের রাজধানী।

জমিদার যোগেশ চন্দ্র রায় ১৮৩৪ সালের দিকে মূল জমিদারী স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী, জনদরদী, মহানুভব ও দানশীল এবং বিলাসী প্রকৃতির মানুষ। তাই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি দিয়েছিলেন- তেমনটাই বলছিলেন সুব্রত কান্তি নাথ।

সুব্রত কান্তি নাথ পেশায় আইনজীবী হলেও, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে যার চর্চা অনবদ্য। ধ্বংসাবশেষ পুরো এলাকা ঘুরে তার সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতায় জানলাম পরৈকোড়া জমিদার বাড়ির ইতিবৃত্ত। পুরানো পত্রপত্রিকা ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলেও মিললো এর সাদৃশ্যতা।

জমিদার শান্তিরাম কানুনগো ১৬০০ শতকের দিকে এই জমিদার বংশের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র দেওয়ান বৈদ্যনাথ এই জমিদারী পরিচালনা করেন। তার দুটি জমিদারি, বহু হাট বাজার, দীঘি আজও কীর্তি হয়ে আছে।

কথিত আছে, চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ান হাট, দেওয়ান বাজার, দেওয়ানজী পুকুর পাড় আজও তার নামের স্বাক্ষী বহন করে।

দেওয়ান বৈধ্যনাথের পরে জমিদারী পরিচালনা করেন তার পুত্র হরচন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তিনি দত্তক নেন গিরিশ চন্দ্রকে। এরপর তিনিই এই জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু গিরিশ চন্দ্র রায় মাত্র ২৭ বৎসর বয়সে মারা গেলে তার স্ত্রী নয়নতারা রাউজান উপজেলার কৈলাশ চন্দ্র চৌধুরীর ৮ বছরের পুত্র যোড়সা’কে দত্তক নিয়ে তার নাম রাখেন যোগেশ চন্দ্র রায়।

পরবর্তীতে ১৮৯০ সালের ১৪ জুলাই নয়নতারা মৃত্যু বরণ করলে এই পুরো জমিদারীর হাল ধরেন যোগেশ চন্দ্র রায়। এরপর তিনি দক্ষতার সাথে এই জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন।

তার রাজপ্রাসাদটি প্রায় ৪০ কানি জায়গার উপর নির্মিত । ১৮৫০ সালের দিকে বাড়িটির বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ শুরু হয়। রাজপ্রাসাদের কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথে ৪টি বলয়রেখা অঙ্কিত ও হরেক নকশা করা তোরণ। যা উঁচু উঁচু খুঁটি ও পুর্তগীজ সভ্যতার শৈলী শিল্পে করা নকশা খচিত তোরণ গুলো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বেলতলা পুকুরের মাঝ খানে পিতলের তৈরি পান্থশালা ছিল সেসময়। আর ও রয়েছে ৪টি বড় বড় পুকুর, খেলার মাঠ, নাচ ঘর, খাজনা ঘর, মাগুব ঘর, বৈঠকখানা,  অভ্যর্থনা প্রাচীর, পুঁড়াবাড়ি, শীতলা মন্দির, জ্বালাকুমারী মন্দির, দশভূজা মন্দির, বিশ্রামাগার।

উত্তর পাশে সুউচ্চ গম্বুজসম্পন্ন মন্দিরের নিদর্শন – লোক মুখে শুনা যায়, জমিদার সেখানে বসে জ্যোৎস্না দেখতেন।

ভেতরে অসাধারণ সব কারুকাজ। কিছু কিছু চুন-সুরকি খসে পড়লেও ছাদের বড় বড় লোহার পাটাতন দেখেই বোঝা যায় হারানো দিনের জৌলুশ। কয়েকটি ভবন একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। জমিদারবাড়িতে এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যাওয়ার জন্য সাতটি তোরণ ছিল। এখন টিকে আছে দুটি। তিনটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও চোখে পড়ে।

যোগেশ চন্দ্র রায় ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ও প্রজাহিতোষী জমিদার। তিনি পরৈকোড়া এলাকার একটা মধ্য ইংরেজি স্কুলকে তার পালক মায়ের নামে “নয়নতারা উচ্চ বিদ্যালয়” নামকরণ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। তিনি প্রজাদের সুবিধার জন্য অনেক রাস্তাঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট ও পুকুর-দিঘী খনন করেন। এছাড়াও তিনি প্রজাদের চিঠি আদান-প্রদানের জন্য তার জমিদারী এলাকায় একটি পোস্ট অফিস এবং চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তাই তিনি প্রজাদের কাছে একজন সু-পরিচিত জমিদার ছিলেন। তাই এখনো এই জমিদার বাড়িকে তার নামেই অনেকে চেনেন।

যোগেশ চন্দ্র রায় মারা যান বাংলা ১৩৫০ সনের ১৫ মাঘ। এরপর তাঁর তিন ছেলে পূর্ণেন্দু বিকাশ রায়, সুখেন্দু বিকাশ রায় ও অমলেন্দু বিকাশ রায় জমিদারির হাল ধরলেও ধীরে ধীরে জমিদারি জৌলুশ হারাতে থাকে।

“যোগেশ চন্দ্র রায় মেমোরিয়াল ট্রাস্ট”। এই ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠায় রয়েছে ভিন্ন মত।

জন্মসূত্রে পরৈকোড়া গ্রামের বাসিন্দা ভাষ্কর দাশ, বয়স ৪৫ বছর। তিনি তাঁর বাবাদের মুখে শুনেন, জমিদার যোগেশ চন্দ্র রায়ের বাড়ি সহ সমুদয় সম্পত্তি তাদেঁর উত্তরসুরী প্রয়াত শ্রী মতি পারুল কুসুম রায় ,বাবু বিশ্বশ্বের দাশগুপ্ত, ডঃ গুরুপদ চক্রবত্তী, আহমদ মিয়া, মরহুম শামসুল ইসলাম, প্রনব দাশ, মরহুম অধ্যক্ষ হোসেন খাঁন, জিতেন্দ্রলাল দত্ত(এডভোকট) সহ গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তির অনুরোধে প্রায় ২৯ বছর পূর্বে তদানিন্তন সংসদ সদস্য জনাব আকতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সক্রিয় ভূমিকায় যোগেশ চন্দ্র রায় মেমোরিয়াল ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। তাতে যোগেশ চন্দ্র রায় বাহাদুরের মূল ভিটার ২২ একর জায়গা ও দুটি দীঘি ট্রাষ্টের নামে দান করা হয়”।

স্থানীয় কিছু অধিবাসীরা বলতো, জমিদারের উত্তরসূরি আমেরিকায় বসবাসরত অণুজীব বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনিমেষ রায় আরও কয়েকজন গুনীজনকে নিয়ে ১৯৮৮ সালে যোগেশচন্দ্র রায় মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠস করেন বলে শুনেছিলেন ভাষ্কর।

পরে ২০০২ সালে যোগেশ চন্দ্র রায় বাহাদুরের বেঠক খানায় ট্রাস্ট এর নেতৃত্বে এবং গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তিদের সক্রিয় সহযোগিতায় সেখানে একটি কারিগরী কলেজ প্রতিষ্টিত হয়।

নানান স্থাপনা, পরিবর্তন, পরিমার্জনের পরও কিছু জরাজীর্ণ ধ্বংসাবশেষ ও স্থাপনা এখনো জমিদার বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন বয়ে চলে।

সারাবাংলা/এজেডএস

Source link

Related posts

ইহুদী জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও তাদের ধর্ম বিশ্বাস

News Desk

আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই—শেখ হাসিনা

News Desk

মোবাইল ফোনের ইতিহাস ও ইতিকথা – ডঃ মার্টিন কুপার

News Desk

Leave a Comment