সুমিত বণিক
বাংলা নববর্ষে ধর্ম, বর্ণ ও অঞ্চলভেদে কিছু ঐতিহ্য, লোয়ায়ত সংস্কৃতি রয়েছে। যা সেই এলাকার মানুষদেরসহ আশপাশের এলাকার মানুষের শ্রদ্ধা-ধর্মীয় বিশ্বাস, ভালবাসার প্রতীক হয়ে উঠে। তেমনি কটিয়াদী উপজেলা সদরের শ্রীশ্রী মহামায়া গাছতলা বেদীটি অত্র উপজেলার সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক হয়ে দাড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে এটি প্রতিবছরই নতুন সাজে সজ্জিত হয়। পহেলা বৈশাখ (পঞ্জিকা মতে) সকাল থেকেই এটি হয়ে উঠে হাজারো সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্ত-পূণ্যার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে। সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ নিজেদের মনোবাসনা পূরণার্থে ও শ্রীশ্রী মা মহামায়া দেবীর কৃপা লাভের আশায় ঐদিন বিভিন্ন প্রাণি (পাঁঠা, কবুতর) উৎসর্গ করে থাকেন। এলাকার ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ মানত হিসাবে বলীর জন্য মহামায়া বেদিতলায় পাঠা নিয়ে আসেন।
হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিভিন্ন গ্রন্থ মতে, মহামায়া হল হিন্দু দর্শনে বর্ণিত পরমেশ্বরী শক্তি। নাগোজীভট্টী টীকা অনুসারে মহামায়া “বিসদৃশ-প্রতীতি-সাধিকা ঈশ্বরশক্তি”। তত্ত্বপ্রকাশিকা টীকা মতে মহামায়াই হল “অঘটন-ঘটন-পটীয়সী ব্রহ্মাত্মিকা শক্তি”। ঈশ্বর সৃষ্টি, পালন, সংহার ও জন্ম লীলা প্রভৃতি কার্য এই মহাশক্তির সাহায্যেই সম্পাদন করেন বলে হিন্দুদের বিশ্বাস। এই মহাশক্তিই দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী প্রভৃতি নামে ও রূপে ভক্তদের দ্বারা পূজিতা হন। ইনি শিব কে স্বামী রূপে গ্রহণ করেন। ইনি দক্ষ কন্যা সতী ও হিমালয়ের কন্যা পার্বতী রূপে জন্ম নেন। দেবী ভাগবত গ্রন্থে ব্রহ্মা নারদকে মহামায়া তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। এই গ্রন্থে মহামায়া ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবতী নামে কথিত। রুদ্রযামল তন্ত্রগ্রন্থেও মহামায়াকে পরব্রহ্ম বলা হয়েছে। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে রাজা সুরথ মেধা ঋষির নিকট মহামায়া তত্ত্বব্যাখ্যা জানতে চাইলে সমগ্র চণ্ডীপুস্তকটির কাহিনির অবতারণা করা হয়। এই গ্রন্থে মোট আটবার মহামায়ার উল্লেখ করা হয়েছে। বৈষ্ণবগণ মহামায়াকে ভগবান বিষ্ণুর বহিরঙ্গা শক্তি পূজিত হন।
মহামায়া গাছতলার এই পূজা ও পাঠাবলীর প্রচলন শুরু হয়েছে তার লিখিতভাবে সুনির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে না পাওয়া গেলেও এলাকার সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক রতন ঘোষ জানান, ‘তান্ত্রিক সাধক গঁগন চন্দ্র মোদক এর পূর্ব পুরুষগণ সর্বপ্রথম এই পূজার প্রচলন করেন। পরবর্তীকালে এই পূজার মূল তত্ত্বাবধান করেন স্বর্গীয় নরেন্দ্র চন্দ্র বণিক, স্বর্গীয় রাম দয়াল ঘোষ, স্বর্গীয় হীরা লাল সাহা প্রমুখ। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে এলাকার প্রবীণ-নবীন অনেকেই এই পূজা আয়োজন ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন।’ তার মতে ‘এই পূজার প্রচলন হয়েছে প্রায় চারশত বছরেরও অধিক সময় হয়েছে।’
কটিয়াদী পাইলট বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন সিনিয়র শিক্ষক নিরঞ্জণ বণিক বলেন, ‘পূর্বে এটি কাঠালি বট ছিল, কিন্তু বর্তমানেরটি অশ্বথ বট বৃক্ষ। গাছতলায় পহেলা বৈশাখে মায়ের পূজা ছাড়াও অমবস্যা, পূর্ণিমাতে অমাবস্যা–পূর্ণিমা তিথিতে প্রদীপ প্রজ্বলন ও বিধি অনুযায়ী নিয়মিত পূজার পাশাপাশি কার্তিক মাসে মা মহামায়া’র বেদীতে জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করা হয়। এছাড়া দীপাবলীতে কালী পূজা এবং চৈত্র সংক্রান্তি দিনে হরগৌরি ও শীতলা মায়ের পূজা করা হয়। এবছরও তিন শতাধিক পাঠাবলী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’ বর্তমানে শিক্ষানুরাগী দীলিপ কুমার ঘোষ ও প্রবীণ শিক্ষক নিরঞ্জণ বণিকসহ অন্যান্য স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মহামায়া গাছতলার পূজার সার্বিক তত্ত্বাবধান করে আসছেন। এছাড়াও এলাকার তরুণ শান্ত বণিক ও হিমেল দাস দীর্ঘদিন ধরেই শ্রীশ্রী মা মহামায়া গাছতলার নিয়মিত ত্বত্ত্বাবধান ও পরিচর্যা করে আসছেন।
বিগত বছরগুলোতে প্রাণঘাতী অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের বিস্তাররোধে সরকারিভাবে আরোপিত কঠোর স্বাস্থ্য বিধির কারণে শুধুমাত্র সংক্ষিপ্তভাবে মাঙ্গলিক উপাচারে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়েছিলো। তখন অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পূজা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হতে পারেন নি। সে কারণে অনেকেরই মন খারাপ ছিল। সনাতন ধর্মাবলম্বী সবার মনে একটাই আকুল প্রার্থনা ছিল, মা মহামায়ার কৃপায় দেশ করোনা মুক্ত হলে, আবার পূর্বের ন্যায় মায়ের পূজায় সবাই মিলে একত্রিত হতে পারবে।
পহেলা নববর্ষে উপলক্ষ্যে মেলা প্রাঙ্গণেই শুধু এ মেলার বিস্তার নয়। মেলা উপলক্ষে অনেকেই এলাকার জামাই ও আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ জানায়। তাই বাড়িতে বাড়িতে খই, মুড়কি, নারকেল আর দুধের নাড়ু বানানো হয়। মেলা থেকে নানা জিনিস কিনে নেওয়া বা খাওয়ার রেওয়াজটিও এখনো ধরে রেখেছেন স্থানীয় নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষেরা। নববর্ষের বর্ণাঢ্য উৎসব ছাড়াও স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী অনেকেই বিয়ের পর নববধূকে বাড়িতে নিয়ে উঠার আগে শ্রীশ্রী মা মহামায়া বেদীকে কে প্রণাম করে তারপর নববধূকে নিয়ে বাড়িতে উঠেন। অনেক ক্ষেত্রে ছোট শিশুদের অন্নপ্রাশনের (শিশুর মুখে প্রথম অন্ন স্পর্শ করানোর সামাজিক অনুষ্ঠান) আনুষ্ঠানিকতাও এই মহামায়া বেদী তলায় হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বী বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের কাছেও এটি ধর্মীয় উপাসনালয় ও ঐতিহ্যের অনন্য প্রতীক হয়ে উঠেছে।
লেখক: জনস্বাস্থ্যকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই