ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান শুরুর আগে দেশটির সীমান্তবর্তী রাশিয়ার বেলগোরোদ শহরফাইল ছবি: রয়টার্স
ইউক্রেনের সীমান্ত থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের বেলগোরোদ অঞ্চল। যে ময়দানে যুদ্ধের উত্তাপ উপেক্ষা করা অসম্ভব। ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের মুখে পিছু হটতে থাকা রুশ সেনারা সেখানে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এ এলাকায় দিনে বেশ কয়েকবার বোমার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। আবারও শরণার্থীতে ভরে উঠেছে শহরটি। শহর পেরিয়ে সীমান্তে এপারে রুশ এবং ওপারে ইউক্রেনীয় সেনারা পাহারায় রয়েছেন।
খারকিভে রুশ বাহিনী পিছু হটার পর সেখানকার রুশপন্থী ইউক্রেনীয় নাগরিকেরাও এখন পালিয়ে এই সীমান্তের দিকে আসছেন। সাধারণ মানুষের মনে এখন ভয়, এ যুদ্ধ রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ পরিস্থিতিতে রুশ এই তিন সেনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘এখন কোথায় যাবেন?’ এর জবাবে তারা বললেন, তাদের তা জানা নেই। তবে তারা মনে করেন, সম্ভবত ‘সীমান্ত রক্ষার জন্য’ তাদের দক্ষিণে ফেরত পাঠানো হবে।
এর পরের দিনই রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ডের প্রায় ৪০০ সেনাকে বেলগোরোদে সীমান্ত রক্ষায় মোতায়েন করা হয়। সেখানকার এক অধিকারকর্মী ওই সেনাদের কথোপকথন শুনেছেন। চলমান এ যুদ্ধ নিয়ে ওই সেনারা নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করছেন।
স্থানীয় বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, বেলগোরোদে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম। এখানে ওলেগের একটি রেস্তোরাঁ আছে। তিনি মূলত ইউক্রেনের বাসিন্দা। তার পরনে ‘জন্ম খারকিভে’ লেখা শার্ট। তিনি যুদ্ধের ভয়ে যদি কখনো তার রেস্তোরাঁর জানালা ঢেকে রাখার প্রয়োজন পড়ে, তাই প্লাইউড বোর্ড কিনেছেন।
ওলেগের রেস্তোরাঁর আরেক অংশীদার ডেনিস। তিনিও বোমা হামলার হাত থেকে বাঁচতে বাড়ির পেছনের উঠানে একটি আশ্রয়স্থল তৈরি করেছেন। তিনি তাঁর দাদিকে পূর্ব ইউক্রেনের একটি শহর থেকে নিয়ে এসেছেন। রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা যে শহরগুলোয় এখন লড়াই চলছে, সেগুলোর একটি ওই শহর। ডেনিসের আশা, এ উত্তেজনা কমবে। তারপরও তাঁরা সতর্কতা অবলম্বন করছেন। ওলেগ বলেন, ‘এই যুদ্ধ এখানে ছড়িয়ে পড়ুক, এটা কেউ চায় না। তবে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’
সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে ইউক্রেনের হামলার মুখে রুশ বাহিনী পিছু হটছে। এত দিন ধরে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে দ্রুত জয় পাওয়ার যে আত্মবিশ্বাস ছিল, তা রাশিয়ার জন্য বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। এ প্রসঙ্গে বোরজিখের অভিমত, যুদ্ধে হিসাবনিকাশ কিছু ভুল হয়েছে, এমন হতে পারে কিংবা রুশ বাহিনীর জন্য এটা কৌশলগত অবস্থানও হতে পারে বলে মন্তব্য তাঁর। রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে সহায়তাকারী অন্যদের মতো বোরজিখও মনে করেন, সম্প্রতি রুশ বাহিনীর পিছু হটার কারণ ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থন। তিনি বলেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ের এক-তৃতীয়াংশের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে রাশিয়া।
বেলগোরোদে সম্প্রতি নীল রঙের ইউনিফর্মে থাকা এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় নরোদনি বুলভারে লাল ইটের লাইসি নং-৯-এর বাইরে একটি কালাশনিকভ রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর ঘণ্টাখানেক আগে খবর আসে, শহরের স্কুল ও গুরুত্বপূর্ণ শপিং সেন্টারগুলো ফাঁকা করা হবে। সাধারণত গোলাগুলি বা বোমা হামলার হুমকি থাকলেই এমনটা করা হয়।
এখানকার সাধারণ মানুষ এখন বুঝতে পারছেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাচ্ছে না। একাধিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে, স্থানীয় লোকজন যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতে ধাক্কা খেয়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে দেশপ্রেমের আবেগ বৃদ্ধি পায়। তখন যুদ্ধ-সমর্থক চিহ্নগুলো যেমন জেড প্রতীকটি গাড়ি ও ভবনগুলোতে দেখা যায়। কিন্তু সেসব চিহ্ন এখন অদৃশ্য। কারণ, বেলগোরোদ একটি দীর্ঘ সংঘাতের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে। আর এটা যে এত দ্রুত হবে, তা স্থানীয় লোকজন আশা করেননি।
রাশিয়ার শহরে যুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড খুব কমই দেখা যায়। ১৯ বছরের ইলিয়া কোস্টিউকভ বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকারবিরোধী মতাদর্শের মানুষ। এ ছাড়া বেলগোরোদ অ্যান্টি-ওয়ার কমিটির প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। ইলিয়া কোস্টিউকভ বলেন, চলমান যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করার কাজটি করছেন তিনি। তবে তিনি এটাও মনে করেন, যুদ্ধের পক্ষের লোকজনের মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা অর্থহীন।
বেলগোরোদে কথা হয় রাশিয়াভিত্তিক এক অধিকারকর্মীর সঙ্গে, যিনি নিয়মিত ইউক্রেনে রুশদের দখলে থাকা এলাকায় আসা-যাওয়া করেন। ইউক্রেন থেকে সাধারণ লোকদের সরিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু এসব মানুষের জন্য রাশিয়ার অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের অভাব দেখে হতবাক হয়েছেন এই অধিকারকর্মী। কুপিয়ানস্কের একটি ফাঁকা মোড়ে দাঁড়িয়ে তিনি যে ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করেন।
ইউক্রেনের ভোভচানস্ক শহরে কয়েক মাস ধরে কোনো আলো বা বিদ্যুৎ ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে একটি। তারা যথেষ্ট সুবিধা দিতে পারেনি। তাই সেখানকার লোকজন ইউক্রেনীয় সেনাদের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছে।’
এমকে