ইউক্রেনে রুশ হামলার চতুর্থ দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি। রাজধানী কিয়েভসহ ইউক্রেনের শহরগুলোতে হামলা অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। কিয়েভের কাছে বড় বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। কিয়েভসহ বেশ কয়েকটি শহরে ইউক্রেনের সেনারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি করেছেন।
পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ দেশটির সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ অব্যাহত রেখেছে। আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট পেমেন্ট নেটওয়ার্কে রাশিয়ার কিছু ব্যাংককে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পশ্চিমা নেতারা। রাশিয়ার হামলা মোকাবিলায় ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস।
ইউক্রেন থেকে লাখো মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পাশের দেশগুলোর দিকে ছুটছে। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে।
চলমান ইউক্রেন সংকট নিয়ে পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন আছে। বিবিসি অবলম্বনে সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা রইল এ প্রতিবেদনে।
সাম্প্রতিক ইতিহাস বিবেচনায় নিলে চলমান সংকটের সূত্রপাত ২০১৪ সালে। তবে এ সংকটের মূলে যেতে ফিরে তাকাতে হবে সোভিয়েত আমলে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল ইউক্রেন।
ইউক্রেনে দুটি রাজনৈতিক ধারা প্রবল। একটি ধারা পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগ দেওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে আগ্রহী। অপর ধারাটি রুশপন্থী। তারা রাশিয়ার বলয়ে থাকতে চায়।
ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ রুশভাষী। তারা জাতিগতভাবেও রুশ। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক-সামাজিক ঘনিষ্ঠতা আছে।
বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের পতন হয়। তিনি দেশ ছেড়ে পালান।
ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। তখন পুতিন চাপ বাড়ান। চাপে পড়ে ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসেন। ফলে ইউক্রেনে তাঁর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়।
ইয়ানুকোভিচের পর যাঁরা ইউক্রেনের ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা ইইউপন্থী বলে পরিচিত। তাঁদের নানা পদক্ষেপে পুতিন ক্ষুব্ধ হন।
ইয়ানুকোভিচের পতনের পর পূর্ব ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয় রাশিয়া।
প্রায় ২০০ বছর ধরে রাশিয়ার অংশ ছিল ক্রিমিয়া। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের কাছে ক্রিমিয়া হস্তান্তর করেন। তখন রুশ নেতৃত্ব ভাবতে পারেনি যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হবে।
ক্রিমিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। কৌশলগত কারণে রাশিয়ার কাছে ক্রিমিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সুযোগ পেয়ে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য নয় ইউক্রেন। তবে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে চায়। বিষয়টি মানতে নারাজ রাশিয়া। এ কারণে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে এমন নিশ্চয়তা চায় যে ইউক্রেনকে কখনো ন্যাটোর সদস্য করা হবে না।
রাশিয়ার চাওয়া অনুযায়ী, এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয় পশ্চিমা দেশগুলো।
পুতিন মনে করেন, রাশিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে পশ্চিমা দেশগুলো ন্যাটোকে ব্যবহার করছে। ইউক্রেনকেও এ উদ্দেশ্যে ন্যাটোতে নেওয়া হতে পারে। এ কারণে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করছেন তিনি।
রাশিয়ার অভিযোগ, গত শতকের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি।
রাশিয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত না করার যে দাবি মস্কো জানাচ্ছে, তা নাকচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে ন্যাটো বলছে, এটি একটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক জোট। প্রতিটি দেশের প্রতিরক্ষার পথ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে।
১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। এ ভাঙনকে রাশিয়ার জন্য একটি ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মনে করেন পুতিন। তারপর থেকে রাশিয়া দেখছে, সামরিক জোট ন্যাটো ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ফেলছে। সংগত কারণেই রাশিয়া তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দেয়। ২০০৪ সালে যোগ দেয় বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া। ২০০৯ সালে যোগ দেয় আলবেনিয়া।
জর্জিয়া, মলদোভা বা ইউক্রেনেরও ন্যাটোতে যোগ দেওয়া আকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু রাশিয়ার কারণে এখন পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। তবে এই তিন দেশে রুশপন্থী বিদ্রোহী আছে। এই দেশগুলোর কোনোটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তবে তা রাশিয়ার জন্য মেনে নেওয়া কঠিন হবে।
সমরাস্ত্র ছাড়া রাশিয়ার একটি বড় হাতিয়ার হলো তার জ্বালানি। ইউরোপের মোট তেল-গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশ যায় রাশিয়া থেকে।
ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে রাশিয়ার প্রবেশদ্বার ইউক্রেন। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপলাইনগুলো ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে গেছে।
ফলে ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রভাববলয়ের বাইরে চলে যায়, তাহলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে।
ন্যাটো কি ঐক্যবদ্ধ
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেন প্রশ্নে পশ্চিমা নেতারা ঐক্যবদ্ধ। তবে ইউক্রেনের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সমর্থন-সহযোগিতায় পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে প্রাণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। তবে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মোতায়েন করা হবে না বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ইউক্রেনকে স্বল্পমাত্রার ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়ার কথা বলেছে যুক্তরাজ্য। ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসের মতো ন্যাটো দেশ পূর্ব ইউরোপে প্রতিরক্ষা জোরালো করেছে। ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও দেশটিকে কোনো অস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে জার্মানি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, তাঁর দেশ ইউক্রেনের পক্ষে থাকবে।
ন্যাটোর প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, এ জোটের মূল কাজ হলো সব মিত্রের সুরক্ষা দেওয়া। একজনের ওপর আক্রমণ মানে সবার ওপর আক্রমণ। জোটের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ অন্যান্য দেশকে রক্ষার যে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা রয়েছে, সেটা সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ যেখানে প্রয়োজন হবে, সেখানে ন্যাটো সেনা মোতায়েন করা হবে।