ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকা জ্বালানি স্থাপনাগুলো থেকে ক্রমাগত নিঃসরণ হচ্ছে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্তকারী ভয়ংকর গ্যাস মিথেন। এগুলোর মধ্যে অনেক জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা ন্যূনতম পর্যবেক্ষণের অভাবে বাতাসে মিশে যাচ্ছে ক্ষতিকর এই গ্যাস। বৃহস্পতিবার এক বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। পরিবেশবাদী দাতব্য সংগঠন ক্লিন এয়ার টাস্কফোর্স (সিএটিএফ) দেখতে পেয়েছে, অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইতালি, পোল্যান্ড এবং রোমানিয়ার অন্তত ১২৩টি তেল ও গ্যাস স্থাপনা থেকে মিথেন নিঃসরণ হচ্ছে।
রয়টার্সের তথ্যমতে, সিএটিএফ ইইউভুক্ত সাতটি দেশের দুই শতাধিক স্থাপনা ঘুরে মিথেন নিঃসরণ পর্যবেক্ষণ করেছে। খালি চোখে এই গ্যাস দেখা না যাওয়ায় তারা এক লাখ ইউরো দামের একটি ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করেছে। সব মিলিয়ে ২৭১টি জায়গা থেকে মিথেন বের হতে দেখেছে সিএটিএফ। এর মধ্যে কয়েকটি স্থাপনার একাধিক জায়গা থেকে গ্যাস লিক হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে তারা।
সংগঠনটির মুখপাত্র জেমস টুরিটো জানান, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, ইতালি, পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় তার ঘুরে দেখা স্থাপনাগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশ থেকেই মিথেন নিঃসরণ হতে দেখেছেন। তবে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার স্থাপনাগুলো থেকে এটি নিঃসরণের হার সবচেয়ে কম। গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী মিথেন। এটি গত দুই দশকে কার্বন ডাই অক্সাইডের (যাকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়) চেয়েও ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে বায়ুমণ্ডলের। ঘ্রাণহীন বর্ণহীন এই গ্যাস পৃথিবীতে আসা সূর্যের তাপ ধরে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা আরও দ্রুত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জ্বালানি খাতে সাধারণত গ্যাস স্টোরেজ ট্যাংক, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল, পাইপলাইন কম্প্রেসর স্টেশন এবং তেল-গ্যাস প্রক্রিয়াজাতকরণ স্থাপনাগুলো থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা দুর্ঘটনাক্রমে মিথেন নিঃসরণ ঘটে। স্টোরেজ ট্যাংকে ছিদ্র সিএটিএফ দেখেছে, ইতালির পিনেতো শহরে এনি’র মালকানাধীন গ্যাস স্থাপনার একটি ট্যাংকের মরিচাধরা ছিদ্র থেকে মিথেন নির্গত হচ্ছিল।
তাদের ফুটেজে যেহেতু খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের নিঃসরণ শনাক্ত হয়, তাই সেখান থেকে ঠিক কতদিন ধরে মিথেন নির্গত হচ্ছে তা জানা যায় না। তবে এসব ঘটনায় একটি বিষয় পরিষ্কার- স্থাপনাগুলোর মালিকেরা যদি আরেকটু সতর্ক থাকতেন এবং ন্যূনতম ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে এসব নির্গমন খুব সহজেই এড়ানো যেত। টুরিটো জানিয়েছেন, তিনি এনির গ্যাস স্থাপনা থেকে মিথেন নিঃসরণের কথা জানাতে ইমারজেন্সি নম্বরে কল করেছিলেন, কিন্তু সেটি বন্ধ পেয়েছেন।
অবশ্য এনি কর্তৃপক্ষ পরে জানিয়েছে, পিনেতোর ওই স্থাপনায় একটি পানির ট্যাংক থেকে মিথেন নির্গত হচ্ছিল, তবে এর হার ছিল খুবই সামান্য। তারপরও সেটি শনাক্ত করে বন্ধ করা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত নিঃসরণ মার্কিন প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা এক বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রচলিত আছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক গ্যাস সিস্টেম বাকি বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি ছিদ্রযুক্ত। কিন্তু যখন এই ভিডিওগুলোর (সিএটিএফের ফুটেজ) দিকে তাকাই, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য দেখা যায় না।
সারা বিশ্বেই মিথেন নিঃসরণ বাড়ছে। গত এপ্রিলে জাতিসংঘ বলেছে, চলতি দশকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে মিথেন নিঃসরণ কমানো না গেলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুসারে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার লক্ষ্য হাতছাড়া হয়ে যাবে। মিথেন একবার বায়ুমণ্ডলে মিশে গেলে তার উৎস শনাক্ত করা আর সম্ভব নয়। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে নিঃসরণের সময় উৎস শনাক্তই একমাত্র পথ।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম প্রধান হটস্পট হিসেবে শনাক্ত হয়েছে রাজধানীর মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল। সেখান থেকে প্রতি ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন নির্গত হচ্ছে বলে জানিয়েছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ পর্যবেক্ষক জিএইচজিস্যাট। এভাবে স্যাটেলাইটের বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মিথেন নিঃসরণের বৃহত্তম উৎসগুলো শনাক্ত সহজ হয়ে গেছে। তবে ছোটখাটো উৎসগুলো অশনাক্তই থেকে যাচ্ছে।