ছবি: সংগৃহীত
একটা সময় ছিল যখন জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজকরা শুধু গ্রিন হাউস আর কার্বন নিঃস্বরণ প্রতিক্রিয়া নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকত। ধনী দেশগুলো ধরেই নিয়েছিল, খরা, বন্যা, অপুষ্ঠি আর দুর্ভিক্ষ শুধু উন্নয়নশীল বা গরিব দেশেরই সমস্যা। উন্নত বা ধনী দেশেগুলোতে তাপ ও শীতের সমস্যা ছাড়া আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেখা মিলবে না। তৃতীয় বিশ্বের শিশুরাই শুধু বন্যা-খরার মধ্যে মরতে মরতে কোনো রকমে বেঁচে থাকবে। কিন্তু ধনী দেশের শিশুরা এই দুই দুর্যোগের সঙ্গে কখনোই পরিচিত হবে না।
কিন্তু প্রকৃতি বড়ই নির্মম। প্রকৃতিই ধনী দেশগুলোর এই নিষ্ঠুর অহংকারের জবাব দিয়ে দিল। চলমান দশকেই প্রকৃতির এই নির্মম প্রতিশোধের কারণে আজ সেইসব দেশে অকালে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি, দাবানলের লেলিহান শিখা। এসব কারণে শিশুরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে, বাসা বাড়ি ছেড়ে শরণার্থী জীবনের স্বাদ নিচ্ছে ধনীর দুলালরা। এমনি এক আবহে মিশরে শুরু হয়েছে জলবায়ু সম্মেলন কপ ২৭।
একসঙ্গে আত্মহত্যা করি: কপ ২৭ এ জাতিসংঘের প্রধান এন্তোনি গুতরেস বলেন, আমরা জলবায়ু নরকের মহাসড়কে আছি এবং আমাদের পা এখনো এক্সিলেটরে রয়েছে। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। আমরা জীবনের লড়াইয়ে আছি এবং ক্রমাগত হেরে যাচ্ছি। হয় জলবায়ু নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হোন, নইলে সম্মিলিতভাবে আত্মহত্যার চুক্তি করুন। আমাদের মনোযোগ জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে নেই। এটি আমরা মেনে নিতে পারি না। হয় একসঙ্গে আত্মহত্যা করি; না হয় সংহতি করি।
ছোট কিন্তু শুরু: ‘কপ টুয়েন্টি সেভেন’ সম্মেলনটির সঙ্গে আগের সম্মেলনগুলোর রয়েছে একটা গুরুত্বপূর্ণ তফাৎ। আর সেটি হলো- এই প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক তাপমাত্রার ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তার বিষয়টি আলোচনা করতে রাজি হয়েছেন আগত প্রতিনিধিরা। উন্নয়নশীল দেশগুলো বলছে, এটি খুব ছোট পদক্ষেপ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। গরিব দেশগুলো অনেকদিন ধরেই বলে আসছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তাদের দায় খুবই সামান্য। ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো এতদিন এই দায় এবং ক্ষতিপূরণের প্রশ্নটি আলোচনার বাইরে রাখতে চাইছিল, যা এবার পাল্টে গেছে এবং এজেন্ডায় যুক্ত হয়েছে।
আর নয় প্রতিশ্রুতি: উন্নত দেশগুলো ১০০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার অঙ্গীকার করেছিল। স্বাগতিক মিশর বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রশ্নে দেশগুলোকে এখন অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির পর্ব শেষ করে বাস্তবায়নের যুগের সূচনা করতে হবে।
লস এন্ড ড্যামেজ: এতদিন ধরে আলোচনার বড় বিষয় ছিল কীভাবে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানো যায়, আর এর প্রভাব মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রিন হাউস সমস্যার প্রধান কারণই তো শিল্পোন্নত দেশগুলো। যার পরিণামে সবচেয়ে প্রত্যক্ষভাবে ভুগতে হচ্ছে দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশগুলো। তাই শিল্পোন্নত দেশগুলোর কি উচিত নয় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এর মোকাবিলার জন্য অর্থ দিয়ে সাহায্য করা? এটাকেই বলা হচ্ছে ‘লস এন্ড ড্যামেজ।’ এর আওতায় বাড়িঘর, জমি, খামার, ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো অন্যান্য ক্ষতিও- যেমন: মানুষের মৃত্যু, সাংস্কৃতিক এলাকা বা প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের মতো বিষযগুলোও। বিবিসির সংবাদদাতা নবীন সিং খাড়কা বলছেন, মিশরে এবারকার কপ ২৭ এর অন্যতম আলোচিত ‘বাজওয়ার্ড’ বা শব্দবন্ধ হতে যাচ্ছে এই ‘লস এন্ড ড্যামেজ’।
কী চাইছে দরিদ্র দেশগুলো?: ধনী দেশগুলো ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য দরিদ্রতর দেশগুলোকে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার দিতে রাজি হয়েছে। মূলত দুটি ক্ষেত্রে এ সহায়তা দেয়া হবে। একটি হলো মিটিগেশন বা গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানো, আরেকটি হচ্ছে এডাপ্টেশন বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য নেয়া পদক্ষেপ। তবে ‘লস এন্ড ড্যামেজে’র আওতায় যে অর্থ সহায়তার কথা বলা হচ্ছে- তা এর অতিরিক্ত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১০০ জনেরও বেশি গবেষক ও নীতিনির্ধারকের একটি গোষ্ঠী হচ্ছে ‘লস এন্ড ড্যামেজ কোলাবোরেশন’। তাদের রিপোর্টে বলেছে, সবচেয়ে বিপদাপন্ন ৫৫টি দেশে ইতোমধ্যেই (২০০০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত) ক্ষতি হয়েছে ৫০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। আগামী দশকে এ ক্ষতি আরো ৫০ হাজার কোটি হবে। ২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষতির পরিমাণ হবে ২৯ হাজার কোটি ডলার থেকে ৫৮ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত।
জাটিলতা থাকছেই আদায়ে: আন্তর্জাতিক অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত আমলাতান্ত্রিকতার কারণে এ ধরনের অর্থ ছাড় করতে প্রচুর সময় লেগে যায়। তাছাড়া গ্রহীতা দেশগুলোতে সুশাসনের দুর্বলতা এবং দুর্নীতির মতো সমস্যাও রয়েছে। এসব কারণ দেখিয়ে ‘লস এন্ড ড্যামেজ’ সহায়তাটি বার বার ঠেলে একপাশে সরিয়ে দেয়া হবে, দরিদ্র দেশগুলো এটা মানতে চায় না।