করোনাভাইরাসের ছোবলে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ভারত। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যস্ত সবাই লেজেগোবরে অবস্থায়। এর মধ্যে টিকা নিয়েও আছে সঙ্কট ও বিতর্ক। তারপরও পরিস্থিতি উত্তরণে কোনোভাবেই এসব ক্ষেত্রে কর ছাড় দিতে রাজি নয় নরেন্দ্র মোদির সরকার। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ দেশটির গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
জানা গেছে, করোনা বা কোভিডের টিকার ওপরে কর বা জিএসটি কোরোভাবেই কমানো হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি কোভিডের চিকিৎসার জন্য ওষুধের ওপরেও নয়। দু’ক্ষেত্রেই ৫ শতাংশ হারে জিএসটি আদায় করতে চায় নরেন্দ্র মোদির সরকার। পিপিই ও করোনা পরীক্ষার কিটের বেলায় একই নীতি। আর হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীর জন্য ব্যবহৃত ভেন্টিলেটরেও জিএসটি ১২ শতাংশ থেকে কমাতে নারাজ মোদি-অমিত শাহেরা।
দেশটির গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মাস্ক পরতে বলছেন সবাইকে। কিন্তু তার সরকার এন-৯৫ বা তিন স্তরের মাস্কের ওপর জিএসটি ৫ শতাংশ থেকে কমাতে রাজি নয়। হাত ধোয়ার স্যানিটাইজার থেকে শরীরের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রেও ১৮ শতাংশ হারে কেন্দ্র জিএসটি বা কর আদায় করতে চায়।
কোভিডের সময় বিভিন্ন পণ্যে কিভাবে জিএসটি কমিয়ে মানুষকে সুরাহা দেয়া যায়, তা নিয়ে শুক্রবার কেন্দ্র ও রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের জিএসটি পরিষদের বৈঠক হয়। কিন্তু কেন্দ্র জিএসটি কমাতে রাজি না হওয়ায় বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলোও পাল্টা রুখে দাঁড়ায়। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, তামিলনাড়ু, ঝাড়খণ্ডের সাথে কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী শাসিত রাজ্যের নয়জন অর্থমন্ত্রী দাবি তুলেছেন, ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে কোভিডের মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় এই প্রতিটি চিকিৎসা উপকরণের ক্ষেত্রে জিএসটির হার শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু ঐকমত্য না হওয়ায় এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি ওই বৈঠকে।
বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেছেন, অন্য কোনো সিদ্ধান্ত হলে তিনি ‘ডিসেন্ট নোট’ দেবেন। কংগ্রেস শাসিত পঞ্জাব, ছত্তীসগঢ়ের অর্থমন্ত্রীরাও একই অবস্থান নেন। ভিডিও কনফারেন্সে ডিসেন্ট নোটের অর্থ বৈঠক থেকে ওয়াক আউট করা।
গুজরাতের অর্থমন্ত্রী নিতিন পটেলও বলেন, মানবিক দিক থেকে বিষয়টি আলোচনা করা উচিত। রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের অনড় মনোভাব দেখে পিছু হটতে বাধ্য হন মোদির কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ঠিক হয়, এ বিষয়ে কিছু রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। ৮ জুনের মধ্যে ওই কমিটির রিপোর্টের পরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে করোনার চিকিৎসা সমঞ্জাম থেকে কর আদায়ের ক্ষেত্রে।
জিএসটি পরিষদের আমলাদের কমিটির প্রস্তাব ছিল, ভ্যাকসিন ও অন্যান্য পণ্যে জিএসটি কমানো যাবে না। তবে অক্সিজেন, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, পালস অক্সিমিটার ও কোভিড টেস্ট কিটে জিএসটির হার ১২ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হোক। কিন্তু বিরোধী শাসিত রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরা এতে রাজি হননি। বৈঠকের পর পঞ্জাবের অর্থমন্ত্রী মনপ্রীত বাদল কেন্দ্রীয় সরকারকে অভিযুক্ত করে বলেন, ‘মোদি সরকারের সহানুভূতির অভাবের জন্যই কোভিড মোকাবিলার সামগ্রীর জিএসটিতে সুরাহা দেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে হলো।’
বিপরীতে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের যুক্তি, ‘এমন নয় যে বৈঠকে একাংশ মানবিকতার পক্ষে সওয়াল করেছে। অন্য পক্ষ মানবিকতার বিরুদ্ধে। কোথায় জিএসটির হার কত হলে শেষ পর্যন্ত জনগণের লাভ হবে, তা নিয়েই বিচার বিবেচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে শনিবারই মন্ত্রীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে।’
এর আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে ভ্যাকসিন থেকে জিএসটি প্রত্যাহারের দাবি তুলেছিলেন। নির্মলার পাল্টা যুক্তি ছিল, এক্ষেত্রে টিকা প্রস্তুতকারীরা কাঁচামালে মেটানো কর ছাড় পাবে না। টিকার দাম বেড়ে যাবে। এরপর পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাবের অর্থমন্ত্রীরা শূন্য হারে জিএসটির দাবি জানান। যাতে করের বোঝা কমে, কর ছাড়ও মেলে। তাতেও কেন্দ্র রাজি হয়নি।
শুক্রবার অমিত শাহ ও মনপ্রীতরা দাবি তোলেন, শূন্য না হলে ভ্যাকসিনে জিএসটির হার ০.১ শতাংশ করা হোক। কিন্তু তাতেও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী রাজি হননি।
জিএসটিতে ক্ষতিপূরণ নিয়েও মোদি সরকারের সাথে ফের রাজ্যগুলোর বিবাদ তৈরি হয়েছে। জিএসটি থেকে রাজ্যগুলোর রাজস্ব আয় ১৪ শতাংশ না বাড়লে কেন্দ্রের সেই ঘাটতি পূরণের কথা। কিন্তু গত বছর কোভিডের ধাক্কার পরে কেন্দ্র নিজের অপারগতা জানিয়ে দিয়েছে। এখন কেন্দ্র নিজে ঋণ করে রাজ্যকে ঋণ দিচ্ছে।
মোদির অর্থমন্ত্রী নির্মলা জানিয়েছেন, চলতি অর্থ বছরেও একই ব্যবস্থা বজায় থাকবে। কেন্দ্রের ধারণা, রাজ্যগুলোর রাজস্ব আয়ের ঘাটতি ২ দশমিক ৬৯ লাখ কোটি রুপি হবে। তার মধ্যে বিলাসবহুল বা ক্ষতিকারক পণ্য থেকে ১ দশমিক ১ লাখ কোটি রুপি আয় হবে। বাকি ১ দশমিক ৫৮ লাখ কোটি রুপি কেন্দ্র ধার করে রাজ্যগুলোকে ধার দেবে।
সূত্র : আনন্দবাজার