করোনা ভাইরাসের প্রকোপ একদিকে যখন বিশ্বজুড়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার নিরাপত্তা ও অর্থনীতির, তখন এই মহামারী যেন পৌষ মাস হয়ে এসেছে কোভিড-১৯ টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে মহামারীর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ার পর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বেশ কয়েকটি কোম্পানি এর টিকা বাজারে নিয়ে আসে। তখনই বলা হয়েছিল, আগামী দিনগুলোয় এই টিকাই হয়ে উঠতে যাচ্ছে ব্যবসার বিরাট ক্ষেত্র। যেসব দেশ ও কোম্পানি এসব টিকা তৈরি করেছে, তারাই অর্থনৈতিকভাবে দাও মারতে চলেছে।
ফলে শুরু হয় টিকা কূটনীতিও। আর এই দৌড়ে এখন চীন, রাশিয়াসহ কোনো কোনো দেশের চলছে শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা আর ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো দেশের তৈরি হয়েছে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা।
বিশ্বজুড়ে ইতোমধ্যে যে কয়টি কোম্পানির কোভিড টিকা বেশি বিক্রি হয়েছে সেগুলো হলো- অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, ফাইজার-বায়োএনটেকের কমিরনাটি, মডার্নার টিকা। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পাওয়ার পর বিক্রি শুরু হয়েছে চীনের সিনোফার্মের টিকা বিবিআইবিপি-কোরভি, রাশিয়ার তৈরি স্পুটনিক-ভি ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা জানসেন।
ব্যবসাবিষয়ক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম করপোরেট ওয়াচ বলছে, ইতোমধ্যেই কোভিডের এই টিকা বিক্রি করে লাভের ঝুলি ফুলেফেঁপে উঠেছে কোম্পানিগুলোর। বিশ্বজুড়ে টিকার মারাত্মক সংকট থাকা সত্ত্বেও এখনো বিপুল অর্ডার আসছে। ফলে আগামী দিনগুলোয় লাভের আরও সুযোগ তৈরি হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর। অথচ গোটা বিশ্বে করোনা-বিপর্যস্ত দেশগুলো যখন টিকা সংকটে ভুগছে, তখন সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসার কথা। প্রতিশ্রুতি ছিল বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে টিকা বিতরণে বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্সে প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু টিকা দান করবে, যা দেওয়া হবে বিভিন্ন দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো- প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের গুড় ষোলোআনা খেলেও দানের ক্ষেত্রে কিপ্টেমি করেই চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, ধনী দেশ ও প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো কোভ্যাক্স কার্যক্রমে যে পরিমাণ টিকা দেওয়ার কথা ছিল, তা এখনো পাওয়া যায়নি। ফলে অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টির পাশাপাশি দেশগুলোকে অনুদান হিসেবে দেওয়া করোনা টিকার সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। যার কারণে কিছুদিন পরই বেশ কিছু গরিব দেশে টিকা প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। আর পৃথিবীর প্রতিটি দেশে যদি টিকা পৌঁছানো না যায়, তা হলে মহামারী শেষের আশা গুড়েবালি ছাড়া কিছুই নয়। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভে ষোলোআনা আর দানে কিপ্টেমির এই নীতিকে করপোরেট ওয়াচ ‘টিকা পুঁজিবাদ’ বলেও আখ্যা দিয়েছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানায়, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু উদ্বৃত্ত টিকা বিভিন্ন দেশকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড ও ফাইজারের কমিরনাটি। এর মধ্যে ফাইজার ‘নট ফর প্রফিট’ শর্তে বিভিন্ন দেশে দানের জন্য ৫০ কোটি ডোজ টিকা দেবে বলে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে। ২০২১ সালে যার ২০ কোটি ও আগামী বছর ৩০ কোটি টিকা দেওয়া হবে। অথচ ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল বলছে, মার্কিন এই প্রতিষ্ঠানটি এ বছরই অন্তত তিন হাজার কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করবে। ইতোমধ্যে আড়াই হাজার কোটি ডোজ টিকা তারা উৎপাদন করে ফেলেছে। অর্থাৎ তাদের উৎপাদন নিশ্চিতভাবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াবে।
আবার বিপুল চাহিদা থাকায় আগামী বছর ফাইজার কমিরনাটির চার হাজার কোটি ডোজ উৎপাদন করবে। অ্যাঙ্গলো-সুইডিস কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা গত মে মাসে জানিয়েছে, তারা ৪৫ কোটি টিকা ১৬০টি দেশে সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে কোভ্যাক্স কার্যক্রমেও দেওয়া টিকা আছে। তারা আরও টিকার ডোজ কোভ্যাক্সে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ কোম্পানিটি এ বছরই অন্তত তিন হাজার কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করবে বলে জানিয়েছে। চেষ্টা চলছে উৎপাদন আরও বাড়ানোর। আরেক মার্কিন কোম্পানি মডার্না জানিয়েছে, তারা ৩ কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিকা কোভ্যাক্সে দেবে। যদিও ৫০ কোটি ডোজ দেওয়ার কথা। প্রতিষ্ঠানটি কথা দিয়েছে বাকি ডোজ আগামী বছর দেবে। চীন সিনোফার্মের টিকা দান করেছে মাত্র আড়াই কোটি ডোজ। অথচ মে পর্যন্ত বিক্রি করেছে প্রায় ৮০ কোটি ডোজ। ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে ৩০ কোটি ডোজ। রাশিয়াও এরই মধ্যে ২৫ কোটি ডোজ টিকা বিক্রি করেছে।
এ তো গেল কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ও দানের চিত্র। কিন্তু টিকা বিক্রি করে তারা যে পরিমাণ লাভ করছে তার অঙ্ক সত্যি ভড়কে দেওয়ার মতোই। দ্য গার্ডিয়ান জানায়, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিজনের জন্য দুই ডোজ টিকা বাবদ ফাইজার ও মডার্না দাম নিচ্ছে ৩০ ডলার করে। ধারণা করা হচ্ছে, এ দুটি কোম্পানি চলতি বছর টিকা বিক্রি করেই অন্তত ৫ হাজার কোটি ডলার লাভ করবে। ইতোমধ্যে চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মডার্না টিকা বিক্রি করে লাভ করেছে ১ হাজার ৭৩ কোটি ডলার। ফাইজার বলছে, মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত যে অর্ডার এসেছে তাতে চলতি বছর নাগাদ তারা টিকা বিক্রি করে ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার লাভ করবে। প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এ দুই কোম্পানি আর কখনো এত বিপুল অর্থ লাভ করেনি।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার সেলস রিপোর্ট বলছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই টিকা বিক্রি করে তারা লাভ করেছে ২৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একমাত্র তারাই কম দামে (ডোজপ্রতি ৪-৮ ডলার) বিভিন্ন দেশে টিকা বিক্রি করছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠান জনসন অ্যান্ড জনসন তাদের এক ডোজের টিকা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে বিক্রি করছে ১০ ডলারে। এর মাধ্যমেই কোম্পানিটি চলতি বছর অন্তত ৬৬০ কোটি ডলার লাভ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে অন্য দেশগুলোর কাছে জনসন প্রতি ডোজ টিকা আরও বেশি দামে বিক্রি করছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানাচ্ছে, চীনের সিনোফার্মও এ বছর টিকা বিক্রি করে বেশ লাভের মধ্যে আছে। স্পুটনিক-ভি টিকা বিক্রি করে লাভ করছে রাশিয়াও।
টিকা নিয়ে ব্যবসায় একটু পেছনেই পড়ে গেছে ভারত। করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে বিপর্যস্ত দেশটি টিকা রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। অথচ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড উৎপাদন করছে। কিন্তু রপ্তানি বন্ধের কারণে সেরামের ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়লেও লোকসান হয়নি। উল্টো বলা হচ্ছে, মহামারীর মধ্যে ভারতে টিকা বিক্রি করেই সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তিটি হলো সেরামের মালিক আদর পুনেওয়ালা।