চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ এখন সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের অঘোষিত বন্দিশিবির। এ জাতিগোষ্ঠীর অন্তত ১১ লাখ মানুষ এখানে ‘কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্রে’ শিক্ষার নামে কার্যত বন্দিজীবন যাপন করছেন। শিকার হচ্ছেন র্নিমম নির্যাতনের। ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে আইনীভাবেই এমনটা চলছে। এর আগে ২০১৪ সালে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী হামলার ঘটনার পর থেকে উইঘুররা যেনো আর চীনের নাগরিক নয়, বরং শত্রুতে পরিণত হয়। সেই থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ বিষয়টি বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়ে আসছে।
চীন শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসলেও দেশটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে এসব অঘোষিত বন্দিশিবিরে আসলে জাতিগত নির্মূলের মতো অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এসব নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল বলে ঘোষণা দিয়েছে। এই অভিযোগে চীনের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং দেশটির বেশ কিছু সংস্থা বা এজেন্সিকে কালো তালিকাভুক্তও করেছে ওয়াশিংটন।
কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রের নামে জিনজিয়াংয়ের এসব অঘোষিত জেলখানায় উইঘুরদের আটকে রাখা হয়। তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। চরম নজরদারি চলে। ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি বলপূর্বক নারীদের বন্ধ্যাত্মকরণ করা হয়। ধর্ষণেরও শিকার হচ্ছে তারা। চীনের সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে বাধ্য করা হয় উইঘুর নারীদের।
চীনের উইঘুরদের ভাষা যেমন তুর্কি, তেমনি এই জাতিগোষ্ঠীর অন্তত ৫০ হাজার মানুষের বসবাস রয়েছে প্রতিবেশি দেশ তুরস্কে। জিনজিয়াংয়ের এই অমানবিক পরিস্থিতি থেকে উইঘুরদের মুক্তির দাবিতে এবার আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন তুরষ্কের এইসব ভ্রাতৃপ্রতীম মানুষেরা। গত জানুয়ারিতে তুরস্কের ১৯ জন উইঘুর নেতা জিনজিয়াং প্রদেশের এসব শিবিরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তুরস্কের আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। বন্দীশিবিরগুলোতে আটকে রেখে বাধ্যতামূলক শ্রমদান, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মপালনে নিষেধাজ্ঞা, বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাত্বকরণসহ আরও বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে।
এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে উইঘুরদের তথ্য সংবলিত একটি নথি ফাঁস হয়। এই নথির শিরোনাম হলো ‘শিনজিয়াং পেপারস’। নথিটি একই বছরের সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে উইঘুর ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। উইঘুরদের তথ্য সংবলিত ওই নথিতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ ছিল। সেখানে বলা হয়েছে, এসব কর্মকর্তার প্রশ্রয়েই উইঘুরদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে স্থানীয় নেতারা। সর্বশেষ এসব নথিতে বেশ কিছু স্পর্শকাতর তথ্য রয়েছে বলে জানা যায়। এর আগে ২০১৯ ও ২০২০ সালে আরও দুটি নথি ফাঁস হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, বন্দি শিবিরগুলোতে থাকা নারী পুরুষদের আচার আচরণও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রশাসনের ইচ্ছেমাফিক আচরণ না করলে তাদের বন্দিশিবিরে আটকে থাকা কেবল দীর্ঘায়িত হয়। পাশাপাশি বাড়ে নির্যাতনের মাত্রা।
উইঘুরদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিষয়ে তুরস্কের আইনজীবী গুলদেন সনমেজ বলেন, মামলায় অন্যতম স্পর্শকাতর অভিযোগ হলো চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পুরুষ সমর্থকদের সঙ্গে উইঘুর নারীদের যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করা। নারীদের হিজাব পরা, রমজানের রোজা রাখা ও দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
বন্দি শিবিরগুলোতে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে সরিয়ে রাখতে জোরপূর্বক চীনা সংস্কৃতি শেখানো হয়। বাধ্য করা হয় এসব নিয়মকানুন মেনে চলতে। আর সেসবের বিরুদ্ধে কথা বললেই শাস্তির খড়গ নেমে আসে উইঘুরদের ওপর। পদে পদে ভুলুণ্ঠিত হয় মানবাধিকার। বিশ্বে সবচেয়ে নিগৃহীত জাতির নাম হয়ে ওঠেছে উইঘুর।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বরাবরের মতো উইঘুরদের ওপর নির্যাতন বন্ধের বিষয়ে সরব থাকলেও বেইজিং কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করে চলেছে। তারা বলে আসছে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের মধ্যে চরমপন্থি ও বিচ্ছিন্নতাবাদিরা রয়েছে। চীনের অখণ্ডভূমি, স্বার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত। তাই চরমপন্থা নির্মূল করতেই চীনের সংস্কৃতিতে একীভূত করে নিতে এসব শিবিরে উইঘুরদের নতুন করে শিক্ষিত করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে জিনজিয়ান পরিদর্শনকালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেখানকার কর্মকর্তাদের ধর্মীয় চরমপন্থার বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করার নামে কার্যত সেখানে উইঘুরদের দমনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন। তিনি বলেন, চরমপন্থার কোনো ক্ষমা নেই। স্বৈরশাসকের মতো এদের দমন করার কথা বলতেও দ্বিধা করেননি তিনি। এরপর ২০১৭ সালের মার্চে, জিনজিয়াংয়ের স্থানীয় সরকার চরমপন্থা বিরোধী একটি আইন পাস করে যেখানে লোকেদের প্রকাশ্যে লম্বা দাড়ি রাখা এবং বোরখা পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবে চরমপন্থা নির্মূলের নামে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের নামে এসব বন্দি শিবির গড়ে উইঘুরদের গণহারে আটকে রাখার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডকে আইনী স্বীকৃতি দেয়া হয়।
প্রশ্ন হলো, এই নির্যাতনের শেষ করে হবে? উইঘুরদের মামলাও কি অদূর ভবিষ্যতে কোনো সুফল বয়ে আনবে? এসব প্রশ্নের আশাপ্রদ কোনো উত্তর শিগগিরই আশা করা যায় না। এক্ষেত্রে প্রথম বাধা হলো চীনের মতো একটি পরাশক্তিধর রাষ্ট্রের নেতাদের কঠোর মনোভাব। তাদের মধ্যে মানবিক বোধ না জাগলে, উইঘুরদের মুক্ত আকাশের নিচে মুক্ত জীবনের স্বপ্ন বাস্তব হওয়া কঠিন। দ্বিতীয় বড় বাধা হলো উইঘুর ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলের নিস্ক্রিয়তা। তবে সবচেয়ে বড় বাধা হলো, জাতিসংঘে চীনের ভেটো ক্ষমতা। কারণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটি হলো চীন। দেশটির ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের কারণে জাতিসংঘে উইঘুর ইস্যুতে কোনো প্রস্তাব বা পদক্ষেপের অনুমোদন পাওয়া ও এর বাস্তবায়ন বলতে গেলে সবসময়েই অসম্ভব হয়ে আছে। অনেক বিশেষজ্ঞ এরই মধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, যে ভেটো ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বকে আরও মানবিক করে তোলার সুযোগ রয়েছে চীনের, সেই চীন কিনা এ ক্ষমতার বলেই উইঘুরদের ওপর আরও অমানবিক আরও নৃশংস হয়ে ওঠেছে।
টিআর