চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র দখল করেছে রাশিয়ান বাহিনী। ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসনের পরে প্রেসিডেন্সিয়াল উপদেষ্টা মিখাইলো পেডোলিয়াক বলেছেন, এই হামলা পুরোপুরিই কোনো কারণ ছাড়া। ইউরোপের জন্য সবচেয়ে বড় যেসব হুমকি তার অন্যতম এই হামলা। এর আগে ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে। মানব ইতিহাসে এটাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক বিপর্যয়। এতে ভয়াবহভাবে প্রাণহানি ঘটে। মানুষ আহত হন।
বিকলাঙ্গ হয়ে যান অসংখ্য মানুষ। সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে সতর্ক করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার আগ্রাসন যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ওই রকম বিপর্যয় আরও ঘটতে পারে। তিনি টুইটে বলেছেন, আমাদের প্রতিরোধকারীরা তাদের জীবন দিচ্ছেন, যাতে ১৯৮৬ সালের মতো ট্রাজেডি আর না ঘটে। এটা পুরো ইউরোপের বিরুদ্ধে (পুতিনের) যুদ্ধ ঘোষণা। একই রকম সতর্কতা দিয়েছেন ইউক্রেনের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, সেই চেরনোবিলেই আরেকটি ‘ইকোলজিক্যাল’ বিপর্যয় ঘটতে পারে।
১৯৮৬ সালের বিস্ফোরণের পর চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে ৩২ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকাকে ‘এক্সক্লুশন জোন’ বা এড়িয়ে চলতে হবে এমন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। গত ৩৬ বছর ধরে সেখানে জীবনধারণ নেই বললেই চলে। কারণ, বিদ্যুত কেন্দ্রের পারমাণবিক চুল্লি বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়তা মানুষের বসবাসের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে। ২০০০ সালে ওই বিদ্যুত কেন্দ্রের অন্য দুটি চুল্লি বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন থেকে বন্ধ অবস্থায়ই আছে।
১৯৮৬ সালের বিস্ফোরণের পর ওই অঞ্চলে তেজক্রিয়তা ভয়াবহ মাত্রায় দেখা দেয়। এ নিয়ে ২০১৯ সালে এইচবিও মিনি সিরিজ করে। এর ফলে সেখানে পর্যটকরা আকৃষ্ট হয়। বৃহস্পতিবার ওই এক্সক্লুশন জোনে প্রবেশ করে রাশিয়ান সেনারা। সেখানে রাশিয়ান সেনারা স্টাফদের জিম্মি করে রেখেছে বলে রিপোর্ট পেয়েছে হোয়াইট হাউজ।
রাজধানী কিয়েভ থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থান চেরনোবিলের। সেখানে দখল নেয়ার মধ্য দিয়ে আগ্রাসী বাহিনীর তাদের অভিযান জোরালো করতে পারে। তবে ট্রুম্যান ন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রজেক্টের নিরাপত্তা বিষয়ক ফেলো সামান্থা টার্নার বলেন, ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মধ্যে লড়াইয়ের গুরুত্ব নির্ধারণ করার কিছু নেই। তবে এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ান বাহিনী ডনিপ্রো নদীর করিডোর সুবিধা পাবে। এই নদীটি উত্তর থেকে বেলারুশে প্রবেশ করেছে। এই বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্দার লুকাশেঙ্কো নিজেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে প্রমাণ দিয়েছেন। এই রুট রাশিয়ান সেনাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন করিডোরে তাদের সেনাদের মুভমেন্টের পথ খুলে যাবে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে তারা। সামান্থা মনে করেন, ওই এলাকায় কোনো মানুষ বাস করে না। তাছাড়া চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র এখন আর সক্রিয় নয়। তাই সেখানে সক্রিয় যুদ্ধ থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের তেজস্ক্রিয় বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রফেসর ক্লেয়ার কর্কহিল বলেছেন, রাশিয়ানরা পারমাণবিক বিষয়ে অপারেট করতে বিশ্বের সবচেয়ে অভিজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম। চেরনোবিলে আন্তর্জাতিক পরিষ্কার বিষয়ক মিশনে গত ৬ বছর ধরে কাজ করছেন কর্কহিল। এ সময় তিনি তিনবার ওই স্থান সফরও করেছেন। এর মধ্যে তেজস্ক্রিয় চুল্লির আশপাশে ৩২ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার ডোম নির্মাণ করেছেন। এতে অংশ নিয়েছে ৩০টি দেশ। এতে খরচ হয়েছে ১৫০ কোটি ডলার। কিন্তু কর্কহিল এখন উদ্বেগ প্রকাশ করছেন এই ভেবে যে, ইউক্রেনে এই কার্যক্রম এখন কার্যত থেমে যাবে। তিনি বলেন, ৩০ বছর আগে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখনও আমরা সবকিছু পরিষ্কার করতে পারিনি। এখনও যা অবস্থা তাতে ৫০ বছরের কর্মসূচি প্রয়োজন। যদি মানুষজন সেখানে ঠিকমতো কাজ করতে না পারে, তেজস্ক্রিয় পদার্থে ডিকম্পোজিশনে অগ্রগতি না হয়, তাহলে তা আসলেই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।