Image default
আন্তর্জাতিক

ফরাসি সেনারা কেন মালি থেকে পাততাড়ি গোটাচ্ছে

দিন কয়েক আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি থেকে ফরাসি সেনা প্রত্যাহার করবেন।

২০১৩ সাল থেকে মালিতে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে ফরাসি সেনারা। মালি ও তার আশপাশের দেশগুলোতে ৫ হাজার ফরাসি সেনা রয়েছে। তারা মূলত আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

কিন্তু আট বছর ধরে মালিতে ফরাসি সেনাদের উপস্থিতির দিকটি দেশটির সরকারের পাশাপাশি জনগণের কাছে ক্রমেই একটি অপ্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে।

মালি ও সাহেল অঞ্চলে সন্ত্রাসী হুমকি
আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট (আইএস) উভয় জঙ্গিগোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্যে প্রচণ্ড মার খায়। মধ্যপ্রাচ্যে মার খাওয়ার পর উভয় গোষ্ঠী আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সাহেল পশ্চিম আফ্রিকার একটি অঞ্চল। ক্রান্তীয় আধা শুষ্ক জলবায়ুর এই অঞ্চলটি সাহারা মরুভূমির অন্তর্ভুক্ত। অঞ্চলটি মহাদেশটির পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত।

সাহেল অঞ্চলে মালি, চাদ, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, মৌরিতানিয়ার অংশ পড়েছে।

ইসলামিক স্টেট ইন দ্য গ্রেটার সাহারা (আইএসজিএস) ও আল-কায়েদাসংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠন জামাত নুসরাত আল-ইসলাম ওয়াল-মুসলিম (জেএনআইএম) সাহেল অঞ্চলে সক্রিয়। জঙ্গি সংগঠনগুলো এই অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে আসছে। এই হামলায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। হাজারো স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে।

ফ্রান্স কেন যুক্ত হলো
২০১৩ সালে মালি সরকারের অনুরোধে দেশটিতে ৫ হাজার সেনা পাঠায় ফ্রান্স। কারণ, তখন দেশটির সরকার সশস্ত্র বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছিল।

লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির পক্ষে যুদ্ধ করে আসছিল মালির উত্তরাঞ্চলের তুয়ারেগ ভাড়াটে যোদ্ধারা। গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হওয়ার পর এই ভাড়াটে সেনারা নিজ দেশ মালিতে ফিরে আসে। তারা মালির উত্তরাঞ্চলের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে লড়াই শুরু করে।

তুয়ারেগ বিদ্রোহীরা গাদ্দাফির দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আল-কায়েদাসংশ্লিষ্ট ইসলামপন্থীদের সঙ্গে একটি জোট গঠন করে। একই সঙ্গে তারা মালির উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। পাশাপাশি পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ দখলে নেওয়ার হুমকি দেয়।

মালি ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের একটি উপনিবেশ ছিল। তুয়ারেগ বিদ্রোহীদের জোর তৎপরতার মুখে ফ্রান্স সরকার ঘোষণা দেয় যে, তারা মালির জনগণের পাশাপাশি দেশটিতে বসবাসরত ৬ হাজার ফরাসি নাগরিককে রক্ষা করতে চায়।

ফ্রান্স যে ৫ হাজার সেনা পাঠায়, তাদের মধ্যে ২ হাজার ৪০০ জন উত্তর মালিতে অবস্থান নেয়। বাকি সেনারা মালি, চাদ, নাইজার, বুরকিনা ফাসো ও মৌরিতানিয়াজুড়ে পরিচালিত জিহাদি সেল খুঁজে বের করার কাজ যুক্ত হয়।

এ ছাড়া অঞ্চলটিতে জাতিসংঘের ১৪ হাজার শান্তিরক্ষী রয়েছেন। এই শান্তিরক্ষীরা স্থানীয় সামরিক বাহিনীগুলোর সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁরা সাহেলের মরুভূমিজুড়ে টহল দিয়ে থাকেন।

ফরাসি সেনাদের উপস্থিতি কেন অজনপ্রিয় হলো
৯ বছর আগে যখন ফরাসি সেনারা প্রথম মালিতে পৌঁছায়, তখন এই বাহিনীর সদস্যদের বেশ উষ্ণভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারপর ক্রমেই সম্পর্ক খারাপের দিকে যায়।

মালিতে ফরাসি সেনাদের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও দেশটিতে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে যোগদানকারী মালিয়ানদের সংখ্যাও বেড়েছে।

গত ৯ বছরে ইসলামি জঙ্গিদের হুমকি বুরকিনা ফাসো, নাইজারসহ অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।
বিদ্রোহীরা সাহারা মরুভূমিতে অবস্থিত তাদের ঘাঁটি থেকে প্রায়ই অভিযান চালাচ্ছে।

মালির অনেক স্থানীয় মানুষ মনে করেন, ফ্রান্স একটি উন্নত সামরিক শক্তির দেশ। সন্ত্রাসের সমস্যার সমাধানে ফ্রান্সের সক্ষম হওয়া উচিত ছিল। আর ফ্রান্স যদি তা করতে না-ই পারে, তাহলে তাদের এই দেশ থেকে চলে যাওয়া উচিত।

মালির কেউ কেউ অবশ্য সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের সেনাদের উপস্থিতিকে একটি ‘দখলদারি’ হিসেবে অভিহিত করছেন।

আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্সের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নাম ‘অপারেশন বারখান’। এই অভিযানে ফ্রান্সের ৫৫ জন সেনা নিহত হয়েছে। তাই এই অভিযানটি খোদ ফ্রান্সেও জনপ্রিয় নয়।

২০২০ সালের আগস্টে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মালির ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক জান্তা। আট বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার দেশটির বেসামরিক সরকার উৎখাত করে মালির সেনাবাহিনী। ফরাসি সরকারের সঙ্গে মালির সামরিক জান্তার বিরোধ তুঙ্গে।

মালির জান্তা ফেব্রুয়ারিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের চুক্তি থেকে সরে আসে। মালির সামরিক জান্তা ঘোষণা দেয়, তারা ২০২৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। এ নিয়ে আপত্তি জানান ফরাসি রাষ্ট্রদূত। এর জেরে তাঁকে বহিষ্কার করে মালি।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ তাঁর ঘোষণায় বলেছেন, তাঁরা মালির এমন কোনো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সামরিকভাবে যুক্ত থাকতে পারেন না, যাদের কৌশল ও গোপন লক্ষ্যের ব্যাপারে ফ্রান্স একমত না।

মালিতে সক্রিয় ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তিতে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ফ্রান্স। তবে মালির অনেকে এমন একটি চুক্তি সমর্থন করেন।

জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করার জন্য একটি রুশ কোম্পানি থেকে ভাড়াটে সেনা আনার যে সিদ্ধান্ত মালির জান্তা নিয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছে ফ্রান্স।

এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সের সশস্ত্র বাহিনীবিষয়ক মন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লি বলেছেন, ‘আমরা ভাড়াটেদের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকতে পারি না।’

এখন কী হবে
অপারেশন বারখানে যুক্ত ফরাসি সেনাদের আগামী চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে প্রত্যাহার করা হবে।

ফ্রান্স সাহেল অঞ্চলের অন্যান্য দেশে সেনা মোতায়েন করবে। তারা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর ‘তাকুবা টাস্কফোর্সের’ সঙ্গে কাজ করবে। এই টাস্কফোর্সে থাকা দেশগুলো বলছে, তারা ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে কীভাবে কাজ করবে, তার পরিকল্পনা ঠিক করা হবে।

মালি থেকে ফ্রান্সের সেনা প্রত্যাহার অঞ্চলটিকে আরও অস্থিতিশীল করতে পারে বলে ইতিমধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট আলাসানে ওয়াতারা সতর্ক করে বলেছেন, ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্ত একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করবে।

ওয়াতারা আরও বলেন, ‘এখন আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী বাড়ানোর পাশাপাশি আমাদের সীমান্তের সুরক্ষা বাড়াতে বাধ্য হব।’

ঘানার প্রেসিডেন্ট আকুফো-অ্যাডো ফরাসি সেনাদের চলে যাওয়া সত্ত্বেও মালিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

রুশ কোম্পানির ভাড়াটে সেনাদের আগমনকে মালির কিছু মানুষ স্বাগত জানিয়েছেন। এই ঘরানার লোকজন এই ভাড়াটে সেনাদের রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ হিসেবে দেখছেন।

তবে অনেক পশ্চিমা দেশ এই ভাড়াটে সেনাদের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এখানে তারা রুশ সরকারের হাত দেখছে।

Related posts

পাকিস্তানে বন্যায় ৪৭ শিশুসহ ১৩৬ জনের মৃত্যু

News Desk

জেরুজালেমে জোড়া বিস্ফোরণ, নিহত ১

News Desk

ইউক্রেনের ২০ শতাংশ দখল করেও সফল নয় রাশিয়া!

News Desk

Leave a Comment