Image default
আন্তর্জাতিক

ফিলিপাইনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী যাঁরা

আগামী ৯ মে ফিলিপাইনে নির্বাচন। সেদিন হাজারো আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে। তবে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে প্রচার-প্রচারণা। নির্বাচনে কে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের জায়গায় আগামী ছয় বছরের জন্য ক্ষমতায় আসবেন, তা-ই এখন দেখার বিষয়।

মাদকবিরোধী লড়াইয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য সমালোচিত দুতার্তে গত বছরের অক্টোবরে রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দেন। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট শুধু এক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেন। সে অনুযায়ী দ্বিতীয় দফায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নেই দুতার্তের।

আগামী ৯ মে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, ১২টি সিনেট আসন, নিম্নকক্ষের ৩০০ আসন ও স্থানীয় প্রশাসনের ১৮ হাজার আসন, সিটি মেয়র, প্রাদেশিক গভর্নর, স্থানীয় কাউন্সিলে ভোট গ্রহণ করা হবে। প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিনেটররা ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। অন্যদের মেয়াদ তিন বছর।

সব পদে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে একটি ব্যালট পেপার থেকেই বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবেন একজন ভোটার।

সাত হাজারের বেশি দ্বীপ নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ফিলিপাইন দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত। ১৫২১ সালে এটি স্পেনের উপনিবেশে পরিণত হয়। দেশটি ১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ১৯৪২ সালে জাপানি উপনিবেশের অধীনে চলে যায় এবং ১৯৪৬ সালে স্বাধীন হয়।

ফিলিপাইন স্ট্যাটিসটিকস অথরিটির তথ্য অনুযায়ী, উন্নয়নশীল এই দেশটিতে ধনী-গরিবের বৈষম্য চোখে পড়ার মতো। তবে বছরে মাথাপিছু গড় আয় ৩ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার। দেশটির ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দরিদ্রের মধ্যে বসবাস করে।

ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা বেশ ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে অনেককে ময়লা পরিষ্কারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। অন্যদিকে ধনীরা বিলাসবহুল ও সংরক্ষিত এলাকায় বসবাস করেন। দেশটি প্রধানত তিনটি মূল দ্বীপপুঞ্জে বিভক্ত। উত্তরে লুজন, মাঝখানে ভিসাইয়াস আর দক্ষিণে মিন্দানাও। দেশটির মানুষের বেশির ভাগ রোমান ক্যাথলিজমে বিশ্বাসী। আর মিন্দানাওয়ে বড় অংশ মুসলিম।

মে মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাশাপাশি কংগ্রেস ও আঞ্চলিক সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে করোনা মহামারির ফলে সৃষ্ট তীব্র মন্দা থেকে দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা, সরকারি দপ্তরগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করার মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে। ফিলিপাইন ও চীনের মধ্যবর্তী সাগরে চীনের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির বিষয়টিও প্রাধান্য পাচ্ছে। এ সাগরে চীন কৌশলগত ঘাঁটি তৈরি করেছে ও ফিলিপাইনের জাহাজ চলাচলকে হুমকিতে ফেলতে বড় বড় জাহাজ ব্যবহার করছে।

এই পরিস্থিতিতে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হিসেবে লড়তে যাওয়া বেশ কয়েকজন নানা কারণেই বেশ বিতর্কিত ও আলোচিত। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্টের মেয়ে, সাবেক স্বৈরশাসকের ছেলে এবং বিশ্ববিখ্যাত বক্সার।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অন্যতম ফার্দিনান্দ বংবং মারকোস জুনিয়র। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মারকোসের ছেলে। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট মারকোস মার্শাল ল জারি করে দেশের আদালত, ব্যবসা ও গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নিয়ে নেন। সেনাবাহিনী ও পুলিশ তৎকালীন ভিন্নমতাদর্শের হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর স্ত্রী ইমেলদা ও ঘনিষ্ঠজনেরা সরকারি তহবিল থেকে ১ হাজার কোটি ডলার লুট করেন। ১৯৮৬ সালে তাঁকে জোরপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এর অল্পদিন পরই তাঁর মৃত্যু হয়।

১৯৯৫ সালে বংবং মারকোস সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কর ফাঁকির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভাষ্য, এ কারণে তিনি প্রার্থিতার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন। সমালোচকেরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি তাঁর বাবার স্বৈরতন্ত্রের ইতিহাস মুছে দিতে অর্থকড়ি ঢেলেছেন।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের মেয়ে সারা দুতার্তে। বংবং মারকোসের সঙ্গে রানিংমেট হিসেবে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে লড়বেন। তাঁরা দুজন ইউনি–টিম হিসেবে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করছেন। তাঁদের নির্বাচনী স্লোগান ফিলিপাইনকে ‘আবার জাগিয়ে তুলব’। সারা দুতার্তে ১৮ বছর হলে সেনাবাহিনীর কাজ করা বাধ্যতামূলক করার পক্ষে। আর বংবং বলছেন, যেসব অপরাধীকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যাবে না, তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পক্ষে তিনি।

বংবং ও সারার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ৫৬ বছর বয়সী লেনি রবরেডো। তিনি বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট। এবারের প্রেসিডেন্ট পদে একমাত্র নারী প্রার্থী। তিনি একজন সাবেক মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী। তিনি দুতার্তের গৃহায়ণমন্ত্রীও ছিলেন। মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হলে তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। মাদকবিরোধী অভিযানে দুতার্তের ‘নির্বোধ হত্যাকাণ্ডের’ সমালোচনা করার পর তাঁকে দুতার্তের মাদক জার নিয়োগ করা হয়। কিন্তু মাত্র ১৮ দিন পর বরখাস্ত করা হয় তাঁকে।

রবরেডো সরকারি খাতের স্বচ্ছতার ওপর জোর দিচ্ছেন। তিনি জনগণের প্রতি এমন একটি সরকার গঠনের আহ্বান জানান যে সরকার মানুষের কথা ভাববে ও চিকিৎসাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। রবরেডো জয়ী হলে তিনি হবেন দেশটির তৃতীয় নারী প্রেসিডেন্ট। তাঁর আগে ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন কোরাজন অ্যাকুইনো আর ২০০১ সালে হয়েছিলেন গ্লোরিয়া ম্যাকাপাগাল আরোয়া।

রবরেডোর সমর্থকদের মধ্যে অনেক সেলিব্রিটি ও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিত্ব রয়েছে। তাঁর প্রচারের রং গোলাপি। তাঁর সমর্থকেরা গোলাপি রঙের পোশাক পরেই প্রচারে অংশ নেন। জরিপে জনপ্রিয়তায় তিনি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। রবরেডোর সমালোচকেরা বলছেন, তিনি ফিলিপাইনের অভিজাত ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি লিবারেল পার্টির সদস্য। আর দলটি ঐতিহ্যগতভাবে দেশটির ধনাঢ্য ও ক্ষমতাশালী পরিবারগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত।

প্রেসিডেন্ট পদের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিপাইনের বক্সিং তারকা ৪৩ বছর বয়সী ম্যানি প্যাকিয়াও। তিনি ক্ষমতায় এলে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের জেলে পোরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ছাড়া চীনের সঙ্গে দুতার্তের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কড়া সমালোচকও তিনি।

প্যাকিয়াও একমাত্র বক্সার হিসেবে শিরোপা জিতেছেন আটটি আলাদা ওজন শ্রেণিতে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি বক্সিং ছাড়ার ঘোষণা দেন। বর্তমানে তিনি একজন সিনেটর। এর আগে দুই দফায় ফিলিপাইন কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম প্যাকিয়াওয়ের। কিশোর বয়সে তিনি ম্যানিলায় আসেন। বেঁচে থাকার জন্য বেছে নিতে হয়েছে খুব সাধারণ পেশা। কিশোর বয়সে খেলায় নিজের নাম লেখান। ওই বয়সেই প্রতিযোগিতামূলক বক্সিংয়ে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পেশাদার বক্সিংয়ে অভিষেক হয় তাঁর। ধীরে ধীরে বিশ্বের ধনী অ্যাথলেটে পরিণত হন তিনি।

প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমকে প্যাকিয়াও বলেছেন, ‘আমি একজন যোদ্ধা। রিংয়ের ভেতর ও বাইরে সব সময় একজন যোদ্ধা হিসেবেই থাকতে চাই। আমি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আপনাদের দেওয়া মনোনয়ন গ্রহণ করছি।’

প্যাকিয়াও দুতার্তের কট্টর সমর্থক ছিলেন। দুতার্তের মাদকবিরোধী যুদ্ধ ও মৃত্যুদণ্ড ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে তিনি সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু এখন তাঁদের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হলো, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতি, দুর্নীতি নির্মূল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দরিদ্রদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা। তাঁর রানিংমেট জোস অ্যাতিয়েনজা। তিনি একজন কংগ্রেসম্যান ও সাবেক পরিবেশমন্ত্রী।

৭৩ বছর বয়সী প্যানফিলো ল্যাকসন একজন সিনেটর। ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরেছিলেন। এবারের জরিপে জনপ্রিয়তায় বেশ পিছিয়ে আছেন। তিনি একজন সাবেক পুলিশপ্রধানও। একজন প্রচারকারী ও তাঁর গাড়িচালককে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত হলে ২০১০ সাল থেকে পলাতক। এক বছরের বেশি সময় পালিয়ে ছিলেন। তবে পরে সুপ্রিম কোর্ট থেকে দায়মুক্তি পান।

প্রেসিডেন্ট হতে পারলে ল্যাকসন সরকারের পদগুলো থেকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের হটাবেন। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। ল্যাকসনের রানিংমেট ভিসেন্তে সোট্টো। তিনি সিনেট প্রেসিডেন্ট ও সাবেক অভিনেতা।

ম্যানিলার মেয়র ও সাবেক চলচ্চিত্র অভিনেতা ফ্রান্সিসকো দোমাগোসো। পর্দায় তিনি ইসকো মোরেনো নামে পরিচিত। ৪৭ বছর বয়সী দোমাগোসোর বেড়ে ওঠা বস্তিতে। পেটের ক্ষুধা মিটিয়েছেন রেস্তোরাঁর ফেলে দেওয়া খাবার খেয়ে। দরিদ্র বাবা-মাকে সাহায্য করতে পরিত্যক্ত জিনিসপত্র কুড়িয়ে বিক্রি করেছেন।

১৯৯৮ সালে তিনি সিটি কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হন। তিনবার নির্বাচিত হন ম্যানিলার ভাইস-মেয়র। তবে সিনেটর নির্বাচনে হেরে গেছেন। ২০১৯ সালে ম্যানিলার মেয়র নির্বাচিত হন দোমাগোসো।

এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হলো দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসনকে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। আর তাঁর অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডা হলো আবাসন, শ্রম, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো।

দোমাগোসোর রানিংমেট হলেন উইলি অং। তিনি একজন চিকিৎসক। ফেসবুকে তাঁর ১ কোটি ৬০ লাখ অনুসারী রয়েছে। তিনি সেখানে তাঁদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা পরামর্শ দেন।

Related posts

নিউজিল্যান্ডে বন্যার আশঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি

News Desk

যুক্তরাষ্ট্রের চারটি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করলো রাশিয়া

News Desk

দিল্লিতে শনাক্তের হার কমে ৩.৫৮

News Desk

Leave a Comment