গেলো এপ্রিলে মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’ বা এনইউজি গঠন করা হয়েছে। জান্তা বিরোধীপক্ষ এ সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়। সেনা অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া পার্লামেন্ট সদস্য, অভ্যুত্থান বিরোধী বিক্ষোভের নেতা এবং জাতিগত সংখ্যালঘু নেতাদের নিয়ে উক্ত সরকার গঠন করা হয়। তাদের লক্ষ্য সেনাবাহিনীকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
এদিকে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। মিয়ানমারের তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ নিকট অতীতে এ নিয়ে নানা টালবাহানা করেছে। এখন আবার ক্ষমতা দখলকারী জান্তা সরকার বলছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর চিন্তাটি তাদের পরিকল্পনায় নেই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হতে পারে বলে মনে করেন ড. আজিম ইব্রাহিম।
ড. আজিম যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের নিউলাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি এন্ড পলিসির পরিচালক এবং স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউট ইউএস আর্মি ওয়ার কলেজের রিসার্চ প্রফেসর। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট এর মতো পত্রিকায়ও তার লেখা ছাপা হয়। সম্প্রতি আরব নিউজে লেখা এক নিবন্ধে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
শরণার্থী থেকে আশ্রয়প্রার্থী সবার জন্যই উত্তম সমাধান হচ্ছে, শরণার্থীরা তাদের পৈত্রিক ভূমিতে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু মিয়ানমারে আগে যেখানে অং সান সু চির সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে ‘এমন একটা ভাব’ দেখাতো, সেখানে নতুন জান্তা সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা ‘এমন একটা ভাব’ দেখাতেও রাজি নয়। বাংলাদেশ সরকার এতে ঝামেলায় পড়েছে। মিয়ানমার যেহেতু প্রতিবেশী দেশ, তাই সেখানে যে সরকারই থাক তার সঙ্গে একধরনের সম্পর্ক রাখতে চাইবে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, মিয়ানমারের নতুন জান্তা সরকার দুই দেশের মধ্যকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচনার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের এ বিষয়ে চুপচাপ বসে থাকার সুযোগ নেই। তাদের পাল্টা জবাব দিতে হবেই। রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাদ দিলে মিয়ানমারের বাংলাদেশের কাছ থেকে বাড়তি কোনো সুবিধা নেয়ার নেই, তাই এক্ষেত্রে মিয়ানমার ছাড় দেয়ার কথা নয়। তদুপরি, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের স্থায়ী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে দেশটির ঘরোয়া রাজনীতি কিছুতেই তা মেনে নেবে না। তাহলে পাল্টা জবাব দেয়ার উপায়? উত্তরটি এরই মধ্যে জেনে যাওয়া উচিত: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতিমধ্যেই জান্তা সরকারের ব্যাপক নিন্দা করেছে, অং সান সু চির ক্ষমতাচ্যুত গণতান্ত্রিক সরকার এবং মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) গঠিত হয়েছে। আর মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে জাতীয় ঐক্যের সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার সম্ভাবনাও ক্রমবর্ধমান।
বর্তমান জান্তা সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রেখে যদি বাংলাদেশের কোনো লাভই না হয়, তাহলে জাতীয় ঐক্যের সরকারকে দেশটির বৈধ সরকার এবং আলোচনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য একমাত্র কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে আর বাধা রইলো না। বাংলাদেশ এখনো অবশ্য সে জায়গায় পৌঁছায়নি। তারা সম্ভবত ধীরে চলো (অন্তত দেখাবে) নীতিতে এগোতে চাইবে। তদুপরি, সম্ভবত এনইউজিকে সম্পূর্ণ স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম দেশ হতেও অনিচ্ছুক হবে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে এনইউজির মনোভাবও পরস্পরবিরোধী। কারণ এনইউজির কিছু সদস্য বা এনএলডি (ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি) নেতাও বিগত বছরগুলোতে রোহিঙ্গা গণহত্যায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতিমধ্যে এনইউজিকে তাদের কাঠামো এবং আন্দোলনে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের আরো অধিকতর সম্পৃক্ত করতে চাপ দিচ্ছে যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় সুযোগ। ‘নিরাপদ হলে শরণার্থীরা নিজ ঘরে ফিরে যাবে’ তাদের এই নীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব, যখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের স্বাভাবিক অংশ হয়ে উঠতে পারবে। অতএব, বাংলাদেশ সরাসরি এনইউজিকে বলতে পারে: তোমরা রোহিঙ্গাদের তোমাদের দেশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করলে এবং তাদের নিজ দেশে ফেরার পথ উন্মুক্ত করলে আমরা তোমাদের মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেবো। আপাতত বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে জান্তা সরকারের সঙ্গে প্রকাশ্য সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। যদিও এর ফল ‘যেই লাউ, সেই কদু’ হবে। তাই, পর্দার আড়ালে ঢাকাকে অবশ্যই এনইউজিকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে যেন তারা রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকার দেয়। এই মুহুর্তে, এনইউজির সাথে এ ধরনের চুক্তি ‘না হওয়ার’ চেয়ে ‘হওয়ার’ সম্ভাবনাই বেশি।