যে ফর্মুলা আজ পর্যন্ত কোটি কোটি শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছে, বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের নানা দেশে ঘরে ঘরে যেটি একটি বহুলপ্রচলিত নাম, সেই ওআরএসের উদ্ভাবক ড. দিলীপ মহলানবিশ মারা গেছেন। রবিবার (১৬ অক্টোবর) সকালে কলকাতার একটি হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে চলে আসা লাখ লাখ শরণার্থীর শিবিরে চিকিৎসা করতে গিয়েই প্রথম ওআরএসের ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু করেন ড. মহলানবিশ। তার ওআরএস ফর্মুলা চালু হওয়ার আগে রোগীদের ধমনীতে সূঁচ ফুটিয়ে স্যালাইন দেওয়াই ছিল রীতি। কিন্তু তিনিই প্রথম লবণ,চিনি ও বেকিং সোডার মিশ্রণ পানীয় আকারে খাওয়ানোর প্রথা শুরু করেন।
এটিই পরিচিত হয় ওআরএস (ওরাল রিহাইড্রেশন সল্টস) নামে, যা পরবর্তী পাঁচ দশকে এশিয়া, আফ্রিকায় এমন কী উন্নত বিশ্বেও অগুনতি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে।
একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁর কাছে বাংলাদেশি শরণার্থী শিবিরগুলোতে এই ওআরএস এক জীবনদায়ী ম্যাজিকাল ফর্মুলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। তখনও কিন্তু ওআরএস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতিই পায়নি, ফলে দিলীপ মহলানবিশ কিছুটা ঝুঁকি নয়েই এ কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু এই ওআরএসই তাকে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ধন্বন্তরি বানিয়ে তুলেছিল। কলেরায় আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষকে তিনি সারিয়ে তুলেছিলেন এই ওআরএস দিয়েই।
প্রচারবিমুখ দিলীপ মহলানবিশ তার এই অসাধারণ উদ্ভাবনের জন্য কোনও পেটেন্ট নেননি, তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তাকে এই কাজের সব রকম স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৯০ সালে তাকে ঢাকার বিখ্যাত আইসিডিডিআরবি-র ক্লিনিক্যাল গবেষণার কর্মকর্তা করেও পাঠানো হয়েছিল, বেশ কয়েক বছর তিনি দক্ষতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
জন্মেছিলেন অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে। দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। প্রথমে বরাহনগর, পরে শ্রীরামপুর। কাজের জন্য অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছেন। ১৯৯১ সালে সল্টলেকে নিজের বাড়িতে ‘সোসাইটি ফর অ্যাপ্লায়েড স্টাডিজও তৈরি করেন— ডাক্তারি পাস করা ছেলেমেয়েদের হাতেকলমে গবেষণা এবং ফিল্ডওয়ার্ক শেখানোর উদ্যোগ। ঠিক যেভাবে তিনি চিকিৎসক হিসেবে তার জীবন শুরু করেছিলেন, সেভাবেই ডাক্তারির ছাত্র-ছাত্রীদের শেখাতে চেয়েছিলেন তিনি।
১৯৬০-এ লন্ডনে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস চালু হতে প্রচুর ডাক্তারের চাহিদা তৈরি হয়। দিলীপ মহলানবিশ আবেদন করতেই সুযোগ পান। এর পর লন্ডনে ডিসিএইচ করেন। এডিনবরা থেকে এমআরসিপিও। তার পর কুইন এলিজাবেথ হসপিটাল ফর চিল্ড্রেন-এ রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন এই বাঙালি চিকিৎসক। তখন তার বয়স তখন মাত্র ২৮। ওই পদেও তিনিই প্রথম ভারতীয়।
এরপর আমেরিকায় জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল কেয়ার ফেলো পদে যোগ দেন দিলীপ। তখন ওই প্রতিষ্ঠানের একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ছিল বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে। কলেরা আক্রান্তদের চিকিৎসা হত সেখানে। ১৯৬৪-তে দেশে ফিরে দিলীপ সেখানে যোগ দেন। শুরু করেন ওআরএস এবং স্পেশাল মেটাবলিক স্টাডি নিয়ে গবেষণার কাজ। হাতেকলমে সাফল্য পেলেও গবেষণাপত্র বার করা হয়ে ওঠেনি। তার পরেই ঘটে ১৯৭১ সালের ওই ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ লাখ বাঙালি এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অস্থায়ী শিবিরে। সেই সব শিবিরে হঠাৎ মড়ক লাগে কলেরার। ক্রমশ তা মহামারির আকার নেয়। কয়েক জনকে সঙ্গী করে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন দিলীপ মহলানবিশ। শুরু হয়েছিল চিকিৎসা। দু’মাস অক্লান্ত কাজ করার পর সাফল্য আসে। সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেন আক্রান্তরা।
এর পরই বিশদ তথ্য দিয়ে ওআরএসের প্রয়োগ নিয়ে পেপার লেখেন। ১৯৭৩-এ জন হপকিনস মেডিক্যাল জার্নালে তা প্রকাশিত হয়। পরে ‘ল্যানসেট’ পত্রিকাও স্বীকৃতি দেয় ওই গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণকে। কলেরা কিংবা ডায়েরিয়ার চিকিৎসায় বিশ্বে স্বীকৃতি পায় ওআরএস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ সসম্মানে ডেকে নেয় তাকে।
১৯৮০-র মধ্যপর্ব থেকে ১৯৯০-এর প্রথম পর্ব পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডায়রিয়া ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম-এর মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন তিনি। ১৯৯০-এ বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়েরিয়াল ডিজজ রিসার্চ-এর ক্লিনিক্যাল সায়েন্সের ডিরেক্টর হন। পরে ১৯৯৪-এ রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর সদস্য নির্বাচিত হন। পার্ক সার্কাসে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এও যুক্ত ছিলেন।
কলকাতার বিশিষ্ট শিশু চিকিৎসক দ্বৈপায়ন ঘটক ড. দিলীপ মহলানবিশের অন্তত ঘনিষ্ঠ ও স্নেহধন্য ছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে একটি আলোচনা সভায় তিনি দিলীপ মহলানবিশের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘ওআরএসের জন্য আপনি কেন কোনোদিন পেটেন্ট নিতে চাননি?’
দ্বৈপায়ন ঘটক বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘উনার জবাব শুনে আমি বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম। উনি সেদিন বলেছিলেন, ‘ওআরএস যে শিশুদের প্রাণ বাঁচাচ্ছে তাদের মুখের হাসিটাই তো আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। আমি পেটেন্ট দিয়ে কী করবো?’