Image default
আন্তর্জাতিক

মহামারির মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র কেনা-বেচা তুঙ্গে

দেশজুড়ে চলছে আগ্নেয়াস্ত্রবিরোধী প্রচারাভিযান; নতুন আগ্নেয়াস্ত্র আইন প্রচলন নিয়েও তোড়জোড় শুরু হয়েছে। চলছে করোনা মহমারি; কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র কেনা-বেচা কমা তো দূরের কথা, বরং বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর দেশটিতে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবসা।

যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দশক ধরেই আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে; কিন্তু গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় থেকে এই বিক্রি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।

১৯৯৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রথমবারের মতো অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতার সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করার শর্ত আরোপ করে। এই নিয়মের আওতায় আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে ইচ্ছুক ক্রেতাদের মধ্যে যাচাই-বাছাই করা হয়। কিন্তু ওই বছরের যে মাসে এই নিয়ম প্রবর্তন করে সরকার, সেই মার্চের প্রথম এক সপ্তাহেই ১০ লাখ আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির রেকর্ড হয় দেশটিতে।

এখনও যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়েই মার্কিনীদের অস্ত্র কিনতে হচ্ছে এবং অস্ত্র বিক্রিতে আগের সেই রেকর্ড এবার পেরিয়ে গেছে। এবার চলতি বসন্তের এক সপ্তাহে ১২ লাখ অস্ত্র বিক্রি হয়েছে।

নাগরিকদের আগ্নেয়াস্ত্র কেনার হারের ওপর সম্প্রতি যৌথভাবে একটি জরিপ চালিয়েছে দেশটির নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড ইনজুরি কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টার। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, যারা আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে অভ্যস্ত তারা তো বটেই, এমনকি অতীতে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর অভিজ্ঞতা নেই বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেননি এমন বহু লোকজন চলতি বসন্ত মৌসুমে আগ্নেয়াস্ত্র কিনেছেন।

জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, গত বছর থেকে চলতি বছর মে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে যত সংখ্যক ব্যক্তি অস্ত্র কিনেছেন, তাদের এক পঞ্চমাংশেরই পূর্বে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। নতুন এই ক্রেতাদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই নারী। বাকিদের মধ্যে ২৫ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ও ২৫ শতাংশ স্পেনীয় আমেরিকান।

দেশটির ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ডেভিস শহরের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালফোর্নিয়ার অস্ত্র বিশেষজ্ঞ গ্যারেন জে. উইনটেমিউট বলেন, “আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি এতটা বেড়ে যেতে আমরা আগে কখনও দেখিনি। সাধারণত আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি কমে আসে। কিন্তু এখন তা কেবলই বাড়ছে।

পৃথক আর এক জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯ শতাংশ পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যের কাছে বন্দুক, রিভলবার বা হ্যান্ডগান জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্র আছে। ২০১৬ সালে এই হার ছিল ৩২ শতাংশ।

ক্যালিফোর্নিয়ার যে শহরগুলোতে সম্প্রতি উচ্চমাত্রায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও সহিংসতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম লস অ্যাঞ্জেলেস। সম্প্রতি রাজ্যের সিটি কাউন্সিলের বৈঠকে লস অ্যাঞ্জেলেসের প্রতিনিধি মারকুইস হ্যারিস ডসন বলেন, ‘আমেরিকানরা এখন নিজেদের মধ্যে অস্ত্র কেনা ও ব্যবহারের প্রতিযোগীতায় নেমেছে।’

‘করোনা মহামারি শুরুর সময় টয়লেট পেপার কেনার যেমন হিড়িক পড়ে গিয়েছিল, ঠিক একইভাবে সেই সময় থেকে বন্দুক কেনারও হিড়িক পড়ে গেছে।’

যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে চলতে থাকা রাজনৈতিক বিভাজন ও জনগণের মধ্যে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস বাড়তে থাকায় আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি বিষয়ক বিতর্ক আবার আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। সাধারণত নির্বাচনের সময় দেশটিতে অস্ত্র বিক্রি বাড়লেও এই সময়ে তা বেড়ে যাওয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে দেশটির সমাজবিজ্ঞানীরা। অনেকেই বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন একে অন্যকে কী চোখে দেখছে তার একটি ভয়াবহ চিত্রই পাওয়া যাচ্ছে। মানুষজন এখন নিজেদের সুরক্ষা নিয়েই চিন্তিত বেশি।

আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির দোকানে কাজ করা অনেক কর্মী জানিয়েছেন, গত বছর অস্ত্র বিক্রিতে তারা রেকর্ড করেছেন। নানা ধরনের মানুষ এসব অস্ত্র কিনছেন। কর্মীদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, অস্ত্র কিনতে আসা ক্রেতাদের অনেকেই রক্ষণশীল নন। এমনকী তাদের অধিকাংশই কখনও বন্দুক চালাননি এবং চালানো জানেন না।

বেশি দামি অস্ত্র কিনেছেন তারাই। নতুন এই ক্রেতারা অস্ত্র কেনার সময় জানিয়েছেন, এ অস্ত্র তারা সঙ্গে রাখবেন না, বাসায় রাখবেন। কারণ, মহামারীতে লকডাউনের সময় নিজেদের নিরাপদ রাখতে তারা অস্ত্র কিনছেন।

নর্থ-ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ড ইনজুরি কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টারের হিসাবমতে, ২০২০ সালে ৬.৫ শতাংশ বা ১ কোটি ৭০ লাখ মার্কিনি আগ্নেয়াস্ত্র কিনেছেন। এই হার ২০১৯ সালের তুলনায় ৫.৩ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছেন নর্থ-ইস্টার্নের পাবলিক হেলথ রিসার্চ প্রফেসর ম্যাথিউ মিলার।

ম্যাথিউ মিলার আরও জানান, চলতি বছর অস্ত্রের ক্রেতাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ পুরুষ, ৭৩ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ও ১২ শতাংশ হিসপানিক জাতিগোষ্ঠীর। গত বছরের জুন ছিল সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বিক্রির মাস।

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক বিক্রির তথ্য রাখে এমন একটি নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম দ্য ট্রেস। এ প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারিতে ২৩ লাখ মার্কিন অস্ত্র কিনেছেন। গত জুলাই থেকে এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বিক্রির মাস। গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছর প্রথম তিন মাসে অস্ত্র বিক্রির হার ১৮ শতাংশ বেড়েছে।

দ্য ট্রেসের ডেটা ও গ্রাফিকস এডিটর ড্যানিয়েল নাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সরকার অস্ত্র বিক্রির তালিকা রাখে না; তা ছাড়া ফেডারেল ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ অস্ত্র বিক্রির পূর্ণ চিত্র দিতে পারে না। কারণ, অনেকেই গোপনে অস্ত্র বিক্রি করে থাকে। সারা দেশে মোট অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ৪০ কোটি পর্যন্ত হতে পারে।

অস্ত্র বিক্রি বাড়ার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলাও অনেক বেড়ে গেছে। এসব হামলায় মৃত্যু হচ্ছে বহু মানুষের। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, লস অ্যাঞ্জেলসে গত বছর বন্দুক হামলায় হত্যার ঘটনা ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। আর মে’র মাঝামাঝি সময়ে বন্দুক হামলার শিকার হওয়াদের সংখ্যা ৬৮ শতাংশ ও বন্দুক হামলার ঘটনা ৫৬ শতাংশ বেড়েছে।

লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ বিভাগের প্রধান মাইকেল মুর বলেন, এ বছর সেখানে নানা হামলার ঘটনায় এপ্রিল পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি বন্দুক জব্দ করা হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২৫টি বন্দুক জব্দ করা হচ্ছে। এছাড়া, এসব ঘটনায় চলতি বছর গ্রেপ্তারের হার ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে।

Related posts

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কেউ জয়ী হবে না: মোদি

News Desk

করোনার উৎস তদন্তে চীনের পাশে ডব্লিউএইচও

News Desk

এবার বাহরাইন সফরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী

News Desk

Leave a Comment