ছবি: সংগৃহীত
স্বাধীনতা ও ভারত বিভাজন থেকে পাকিস্তান গঠনের ৭৫ বছরের ইতিহাসে তিনবার ক্ষমতা দখলের পাশাপাশি প্রতিটি বেসামরিক সরকারের ক্ষমতায় আসা-যাওয়ার পেছনে মূল খেলাটি খেলেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পাকিস্তানের জেনারেলরা সে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির খেলাতেও দক্ষ ও পটু খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। যে কারণে পাকিস্তানের পরবর্তী সেনাপ্রধান কে হচ্ছেন- তা নিয়ে আশপাশের দেশ তো বটেই, ওয়াশিংটন-বেইজিং-মস্কোসহ দূরের দেশগুলোরও নজর ছিল।
গণতন্ত্রের বিবর্তন কি হবে : পাকিস্তানের ৩০ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ১৯ জন নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু তাদের একজনও ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। সম্প্রতি রাজনীতিতে অতীত হস্তক্ষেপের কথা স্বীকার করে সেনাবাহিনী বলেছে যে তারা আর হস্তক্ষেপ করবে না। নতুন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসিম মুনির সেই প্রতিশ্রুতিতে থাকবেন কিনা- তা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক বিবর্তনের মূল বিষয় হতে পারে।
মধুচন্দ্রিমা কেমন হবে: পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের খ্যাতি হারিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের পাকিস্তান ইনিশিয়েটিভের পরিচালক উজাইর ইউনুস। তিনি বলেন, সেনাপ্রধান হিসেবে স্থির হতে অন্তত ৩ মাস সময় লাগে। কিন্তু আসিম মুনির সেই সুযোগ পাবেন বলে মনে হয় না। তার সামনে চলমান রাজনৈতিক মেরুকরণে হস্তক্ষেপ করার প্রলোভন রয়েছে। আসিম মুনির সেই প্রলোভন পাশ কাটাতে পারবেন কিনা, তা দেখতে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
পাকিস্তানের লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেছেন, সেনাবাহিনী রাজনীতির খেলা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আসিম মুনিরকে এমন একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে, যাতে রাজনীতির মঞ্চে প্রকাশ্যে না এসেও এ হাইব্রিড সরকারকে চালানো যায়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরেকটি থিঙ্কট্যাংক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, মুনিরের সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ। এক. সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। দুই. সরকার ও ইমরান খানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে তিনি এখন রাজনীতির মাঠে খেলবেন, নাকি সাজঘরে বসবেন- তাই ভাবছেন বিশ্লেষকরা।
ইমরানই বা কী করবেন : সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতেই ক্রিকেট মাঠের জনপ্রিয় অধিনায়ক মাঠের দায়িত্ব ছেড়ে এসেছিলেন দেশের অধিনায়কত্ব
পালন করতে। কিন্তু রাজনীতির জটিল খেলায় একসঙ্গে দশভূজার মতো হাত মেলে সবার সঙ্গে সমান্তরাল সহাবস্থান সম্পর্ক বজায় রাখতে তিনি আর পেরে উঠছিলেন না। বিশেষ করে দেশের বাইরে ওয়াশিংটন ও ভেতরে সেনাসদরের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার বিষয়টিতে। নতুন সেনাপ্রধানের নিয়োগ ইমরান খানের জন্য একটি ধাক্কা হতে পারে- যে মুনিরকে তিনি নিয়োগের ৮ মাসের মধ্যে ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রধান পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
এদিকে ২৬ নভেম্বর থেকে আবারো লংমার্চে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন পিটিআই নেতা ইমরান। গতকাল সংসদে সেনাপ্রধানের নাম ঘোষণার পরেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ অনেকটা হুমকির সুরে ইমরানকে লংমার্চ স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছেন। এ অবস্থায় লংমার্চ অব্যাহত রাখলে পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মনোযোগ যে কারণে : অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরান খানকে সরানোর জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশকেও তিনি দায়ী করেছেন। এপ্রিলে সংসদীয় অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›দ্বীরা মিলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। যদিও তিন পক্ষই তা অস্বীকার করেছে।
ইমরানের অভিযোগ অনুরণন হচ্ছে দেশজুড়ে : ইমরান খানের সামরিক বাহিনী নিয়ে নিরলস অভিযোগ পাকিস্তানিদের মধ্যে গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, বলছেন বিশ্লেষকরা।
ওয়াশিংটনভিত্তিক নিউ লাইনস ইনস্টিটিউশনের বিশ্লেষণাত্মক উন্নয়ন পরিচালক কামরান বোখারির মতে, এই অভিযোগ সম্ভবত ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং আগামী বছরের নির্বাচনে তাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনে দিতে পারে।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা : বাজওয়ার উত্তরসূরি আসিম মুনির ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রকাশ্য ও গোপন হস্তক্ষেপ যে ভালোর চেয়ে বেশি ক্ষতি করে তা উপলব্ধি করলেই দেশটির জন্য মঙ্গল। নতুন সেনাপ্রধানের জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হবে পেছনের আসন গ্রহণ করা। এটি বলা সহজ, তবে পাকিস্তানের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সংযম রক্ষা করা কঠিন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কেএইচ